সাক্ষাৎকার: আহসান এইচ মনসুর
ব্যাংকগুলোর মধ্যে মানের পার্থক্য অনেক বেশি
শেখ আবদুল্লাহ
প্রতিষ্ঠাকালীন উদ্দেশ্য ও মূল চরিত্র অপরিবর্তিত রেখেই ব্র্যাক ব্যাংককে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ব্যাংকে রূপান্তরে কাজ করতে চান ব্যাংকটিতে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর। তিনি মনে করেন, প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন, পরিপূর্ণ স্বচ্ছতা ও উন্নত গ্রাহক সেবার মাধ্যমে ব্র্যাক ব্যাংক অনেক এগিয়ে গেছে। ব্যাসেল-৪সহ ব্যাংক পরিচালনার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিশ্চিত করার মাধ্যমে ব্যাংকটি আন্তর্জাতিক মানসস্পন্ন ব্যাংকে পরিণত করা সম্ভব।
গত বুধবার তার কর্মস্থল পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) কার্যালয়ে সমকালের সঙ্গে ব্র্যাক ব্যাংক ও দেশের ব্যাংক খাত নিয়ে একান্ত আলাপচারিতায় তিনি এমন মতামত দেন। ব্যাংক খাতের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেন। দেড় বছর ধরে পর্ষদে থাকার অভিজ্ঞতা .বর্ণনায় পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক বলেন, ব্র্যাক ব্যাংকে ব্যবস্থাপনার মান অনেক উন্নত। ব্যাংকটি প্রধানত স্বতন্ত্র ও মনোনীত পরিচালকদের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। পরিচালকরা স্বাধীনভাবেই কাজ করেন। অন্যান্য বেসরকারি ব্যাংকে যেমন পারিবারিক ব্যবসার প্রভাব থাকে, ব্যক্তিগত লাভ-লোকসানের ইস্যুতে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে স্বার্থের দ্বন্দ্ব দেখা যায়, ব্র্যাক ব্যাংকে তা নেই।
তিনি বলেন, ব্যাংকটির পরিধি আরও বাড়ানো এর প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদেরই পরিকল্পনা। এজন্য ১০ বছরের একটি পরিকল্পনা প্রণয়নে ইতিমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা (এসএমই), যা নিয়ে ব্যাংক যাত্রা শুরু করেছিল, তা আরও গুরুত্ব পাবে। যদিও এসএমই খাতে ঝুঁকি আছে। তবে ব্র্যাক ব্যাংক ঝুঁকি মোকাবেলার অনেক কৌশল ইতিমধ্যে সাফল্যজনকভাবে আয়ত্ত করেছে। যে কারণে এসএমই ঋণের মাত্র ৩ শতাংশ খেলাপি। ব্র্যাক ব্যাংকের সামাজিক ভাবমূর্তি আরও উন্নয়ন করে নারী ও নতুন উদ্যোক্তাদের প্রতি মনোযোগ দেওয়া হবে।
স্যার ফজলে হাসান আবেদ সম্পর্কে মূল্যায়ন জানতে চাইলে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আবেদ সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় থাকলেও ব্যক্তিগত সখ্য ছিল না। ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতার অতুলনীয় কাজের সঙ্গে পরিচয় ছিল। বছর দেড়েক আগে আমাকে উনি ফোন করে বললেন যে, ব্র্যাক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে আমাকে নিতে চান। শুনে অভিভূত হলাম। আসতেও রাজি হলাম। কারণ, আমি মনে করেছি যে, কিছু হলেও কাজ করতে পারব। আমার আইএমএফে চাকরিসহ দেশের অর্থনীতি নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। সে জন্যই এসেছিলাম। আবেদ সাহেব অবশ্যই দেশের একজন ‘আইকনিক ফিগার’। কারণ যেখানে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান নিয়ম ভাঙার প্রতিযোগিতায় আছে, সেখানে তিনি ব্র্যাক, ব্র্যাক ব্যাংক ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির মতো নিয়মতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।
যে কোনো ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের মুখ্য দায়িত্ব কী- জানতে চাইলে আহসান মনসুর বলেন, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের প্রধান কাজ হচ্ছে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে সামগ্রিক দিকনির্দেশনা দেওয়া। সেক্ষেত্রে আইনানুগ কৌশল থাকবে। থাকবে পর্যবেক্ষণও। নিয়ম মাফিক যা হওয়ার কথা তা হচ্ছে কি না দেখবে, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করবে। এসব কর্মকাণ্ড করার ক্ষেত্রে শুধু প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ ও লক্ষ্যকে প্রাধান্য দিতে হবে, কোনোভাবেই ব্যক্তি স্বার্থ নয়। এছাড়া আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে বোর্ডে অবশ্যই ‘উপযুক্ততা ও সঠিকতার’ মানদণ্ডে উত্তীর্ণ ব্যক্তিদের আসতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, আমাদের দেশে এ কাজটি ঠিকমত হয় না বা গুরুত্বসহকারে দেখা হয় না। যার নেতিবাচক প্রভাব ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠানের ওপরে পড়ে। ব্যাংকের ক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদ হচ্ছে আমানতের কাস্টডিয়ান। ফলে আমানত ঝুঁকিতে পড়ে এমন সিদ্ধান্ত তারা নিতে পারেন না।
আইন করে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের মেয়াদ বাড়ানো ও এক পরিবারের একাধিক সদস্যের থাকার সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তকে কীভাবে দেখেন- এর জবাবে তিনি বলেন, এ ধরনের সিদ্ধান্তের ফলে অনেক ব্যাংককে পরিবারতান্ত্রিক করে ফেলা হয়েছে। পর্ষদ অনেকটা পারিবারিক কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে পড়েছে। প্রতিষ্ঠানকে উপেক্ষা করে তাদের স্বার্থে অনেক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এর ফলে দেশের উন্নয়নগতিতে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আর্থিক খাত অর্থনীতির গতিশীলতায় জ্বালানি হিসেবে কাজ করে। বিনিয়োগ ও দৈনন্দিন কার্যক্রমে ঠিকমতো অর্থায়ন না হলে এবং অর্থ অনুৎপাদনশীল খাতে আটকে পড়লে বা বিদেশমুখী হলে অর্থনীতি গতিশীলতা হারাতে বাধ্য।
সামগ্রিকভাবে ব্যাংক খাত কেমন সময় পার করছে এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ব্যাংক খাত বর্তমানে অনেক ধরনের সমস্যায় আছে। অনেক ক্ষেত্রেই যথাযথ মান বজায় থাকছে না। ব্যাংকগুলোর মধ্যে মানের মধ্যে পার্থক্য অনেক বেশি হয়ে গেছে। কোনো কোনো ব্যাংক অনেক ভালো করছে। তারা ১০ নম্বরের মধ্যে ৮ থেকে ৯ পেতে পারে। আবার অনেক ব্যাংক রয়েছে যারা ১০-এর মধ্যে ২ থেকে ৩-ও পাবে না। পারফরম্যান্সের ব্যবধানটা অনেক বেশি হয়ে গেছে। সবাই সেরা হবে না, তবে অন্তত ৫ থেকে ৬ নম্বর পাওয়ার পর্যায়ে থাকতে হবে। নতুবা বাজার প্রতিযোগিতায় সামঞ্জস্য থাকে না, আমানতকারীরা আস্থাহীনতায় ভোগে। ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা আরও খারাপ। গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠান বাদে বাকিদের টিকে থাকাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার প্রভাব ব্যাংকিং খাতের ওপরও পড়তে বাধ্য। ব্যাংকিং খাতের আরও দুটি সমস্যা তৈরি হয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে ঋণ কেন্দ্রীভূতকরণ হয়েছে ব্যাপকভাবে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের মালিকানাও নামে-বেনামে কেন্দ্রীভূত হয়েছে।
২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট নিয়ে ৯ শতাংশ সুদে দীর্ঘমেয়াদে পরিশোধের সুযোগ-সংক্রান্ত খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের সিদ্ধান্ত ব্যাংক খাতে কোনো ধরনের প্রভাব ফেলবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা ‘নন কমপ্লায়েন্স’ সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করবে। যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করত, তাদের একটি অংশ এ সুবিধা নিতে ঋণের কিস্তি দেওয়া বন্ধ রেখেছে, যা অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে দেবে ও সামগ্রিকভাবে ঋণমানকে কমিয়ে দেবে।
মুদ্রার বিনিময় হার ব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত জানতে চাইলে তিনি বলেন, মুদ্রার বিনিময় হার শুধু ব্যাংকের বিষয় নয়, সামগ্রিক অর্থনীতির বিষয়। বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষা ও রফতানি আয় বাড়ানোর জন্য বিনিময় হার একটি নীতি কৌশল। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো এই নীতির কার্যকর ব্যবহারের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক রফতানি বাজারে নিজেদের অবস্থান শক্ত করেছে এবং তাদের অবস্থান শক্তভাবে ধরে রাখার কৌশল নিচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারেরও উচিত হবে বিনিময় হারের নীতিকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করে রফতানি আয় ও দেশের উন্নয়নকে উচ্চমাত্রায় নিয়ে যাওয়া।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের তহবিল সরকারি কোষাগারে নিতে সরকার আইন করতে যাচ্ছে। এই আইন কার্যকর হলে ব্যাংক খাতের আমানতের ওপর প্রভাব পড়বে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা নির্ভর করছে সরকার কীভাবে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করে তার ওপর। এসব অর্থ কত দ্রুত তুলে নেওয়া হবে এবং কোথায় রাখা হবে তা গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আছে যাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানতের ওপর নির্ভরশীলতা রয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানতের ৬১ ভাগ রয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকে, ২৬ ভাগ বেসরকারি ব্যাংকে এবং ৭ ভাগ ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকে। হঠাৎ করেই সরকার এই অর্থ তুলে নিলে অনেক দুর্বল ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়বে। যার নেতিবাচক প্রভাব সার্বিক তারল্যের ওপর পড়তে পারে। সরকারের উচিত পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ধাপে ধাপে সিদ্ধান্ত কার্যকর করা।
সরকার আমানতের সুদহার ৬ শতাংশে আর ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে আনার চেষ্টা করছে। বাস্তবে এ উদ্যোগের প্রতিফলন বিশেষ দেখা যাচ্ছে না কেন জানতে চাইলে আহসান মনসুর বলেন, ব্যবসা, বিনিয়োগ তথা অর্থনীতির স্বার্থে সুদহারের কাঠামো নামিয়ে আনার সিদ্ধান্তে কোনো দ্বিমত নেই। বিশ্বের অনেক দেশেই এরকম কাঠামো রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমানে মূল্যস্ম্ফীতির হার ৫ থেকে ৬ শতাংশ, যা ওইসব দেশের চেয়ে তুলনায় অনেক বেশি। খেলাপি ঋণের হারও বাংলাদেশে অনেক বেশি। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারও বাজারভিত্তিক নয়। অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাজারের তুলনায় অনেক বেশি। এ পরিস্থিতিতে আমানতে ৬ শতাংশ সুদহার বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোর পরিচালন ব্যয়ও বেশি। সরকার আন্তরিকভাবে এই সুদহার কার্যকর করতে চাইলে মূল্যস্ম্ফীতি ও খেলাপি ঋণ কমিয়ে উভয়কে ৩ শতাংশের মধ্যে আনতে হবে। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় কমাতে হবে। আর সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাজারভিত্তিক করতে হবে। নতুবা এ উদ্যোগ বাস্তবায়নযোগ্য হবে না এবং বলপূর্বক করা হলে আর্থিক খাতের অপূরণীয় ক্ষতি হবে।