সাক্ষাৎকার: অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক করাই সরকারের করণীয়-জাইদী সাত্তার

জাইদী সাত্তার

অর্থনীতিতে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনাই এখন সরকারের করণীয়। যার মাধ্যমে দেশের রপ্তানীমুখী অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। তবে রপ্তানি বৃদ্ধি করতে বাংলাদেশের বাণিজ্য নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে বলে মনে করেন বাণিজ্য অর্থনীতিবিদ জাইদী সাত্তার। ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণ ঘটার কথা। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য কাঠামোতেও পরিবর্তন আসবে। বাংলাদেশের বাণিজ্য নীতি, শুল্ক নীতি এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নানা দিক নিয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান জাইদী সাত্তারের সঙ্গে কথা বলেছে সকাল সন্ধ্যা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আশফাকুর রহমান
সকাল সন্ধ্যা: ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে ব্যাপক সহিংসতার মধ্য দিয়ে দেশে সরকার পতন হয়েছে। এসময় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মুখ থুবড়ে পড়েছে। এছাড়াও আগে থেকেই অর্থনীতিতে নানা ধরনের সংকট বিদ্যমান। একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে। এ অবস্থায় নতুন সরকার কী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে?

জাইদী সাত্তার: সরকারের করণীয় হচ্ছে, স্বাভাবিক অবস্থা যত দ্রুত ফিরিয়ে আনা যায় সেই চেষ্টা করা। যত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আছে সেটাও স্বাভাবিক করে তোলা। এখন এটাই হওয়া উচিত সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য। যে অগ্রগতির ধারায় আমরা ছিলাম সেটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া একান্ত প্রয়োজন।

বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত্তি কিন্তু এত দুর্বল নয়। তৈরি পোশাক শিল্প ও প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ আমাদের ভিত্তি। প্রায় ১০-১২ লাখ মানুষ এখন প্রতি বছর দেশের বাইরে যায় কাজ করতে যায়। তৈরি পোশাক শিল্পে আমরা এখনও বিশ্বে দুই নম্বর। তুলনামূলক মূল্যের বিচারে এবং দক্ষতার জায়গায় আমরা শক্ত অবস্থানে আছি। তাই সাময়িক অসুবিধায় পড়লেও আমাদের অর্থনীতি এত সহজে ভেঙে পড়বে না।

এই মুহূর্তে সরকার শিল্পাঞ্চল ও কারাখানা এলাকাগুলোয় নিরাপত্তা জোরদার করতে পারে। এর মধ্যে প্রাধান্য দিতে হবে যেন কারখানা সংশ্লিষ্ট শ্রমিক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিরাপদে যাওয়া আসা নিশ্চিত করা। এছাড়া বন্দর ব্যবস্থা ব্যবসায়ীদের জন্য আরও সহজ করা উচিত। কোনও কোনও ক্ষেত্রে শিথিল করা যেতে পারে। প্রবাসীদের অর্থ পাঠানোর পদ্ধতি সম্পূর্ণ ডিজিটাইজড করা দরকার। এর ফলে টাকা পাঠানো আরও সহজ হবে। গুরুত্বের ভিত্তিতে এই কাজটি করতে হবে।

আমরা গবেষণা করে দেখিয়েছি যে, অন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে অন্তত ৫০০-র মতো পণ্যের রপ্তানি আমাদের পক্ষে বাড়ানো সম্ভব। এই পণ্যগুলো অনেক বেশি কম্পিটেটিভ— প্রতিযোগিতামূলক। ভিয়েতনাম, চীনের মতো ৩০-৪০ টি দেশ এই পণ্যগুলো রপ্তানি করে থাকে। এদের সঙ্গে কিন্তু আমরাও প্রতিযোগিতা করে রপ্তানি করতে পারি। কিন্তু এসব পণ্য আমরা রপ্তানি করতে আগ্রহ দেখাচ্ছি না। কেন?

সকাল সন্ধ্যা: এখন ডলারের মূল্য ঊর্ধ্বগামী। এটাতো অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করেছে। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?

জাইদী সাত্তার: এটাকে আমি সাময়িক অবস্থা মনে করি। এটা নমনীয় বিনিময় হারের বৈশিষ্ট্য। সদ্য সমাপ্ত অর্থ বছরে প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলার প্রবাসীরা বাংলাদেশে পাঠিয়েছে। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ গত কয়েক সপ্তাহে কমেছে। কিন্তু এটাও সাময়িক অবস্থা। পরিস্থিতি পরিবর্তনের সঙ্গে এটা আবার বৃদ্ধি পাবে। তবে সরকারকে বাণিজ্য নীতি, কর নীতি ও বিনিয়োগ বাড়াতে কিছু মৌলিক সংস্কার করার বিষয়ে উদ্যোগী হতে হবে।

সকাল সন্ধ্যা: এদিকে সদ্যসমাপ্ত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি কমলেও বেড়েছে চীন-রাশিয়ায়। তবে গত অর্থবছরেই রুপিতে বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য শুরু হয়েছে। ভারত-চীন-রাশিয়া তিনটি দেশই বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার। বাংলাদেশ কীভাবে এই তিন দেশে রপ্তানি বৃদ্ধিতে আরও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে?

জাইদী সাত্তার: চীনে আমাদের পণ্য ও সেবা আরও বেশি রপ্তানি হওয়া দরকার। ভারত ও চীন কিন্তু আমাদের জন্য খুব বড় একটা বাজার। আমাদের রপ্তানি দিয়ে সেই বাজারে ভালো করে প্রবেশ করতে পারিনি। আগামী ১৫-২০ বছরের মধ্যে বাজারের হিসেবে বিশ্বে সেরা যে চারটি দেশ হবে তার মধ্যে ভারত ও চীন থাকবে। এর ফলে আমাদের বাজারকে বড় করার সুযোগ তৈরি হবে। এতে ‘স্কেইল ইকোনমি’র সুবিধা আছে।

রপ্তানির সুবিধাটা কী? দেশীয় বাজারে পণ্য বা সেবা বিক্রি করার একটা সীমা আছে। তবে দেশের বাজার যত বড় ততই পণ্য তৈরি করা যাবে। ধরা যাক, তৈরি পোশাক যদি আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি না করে দেশের বাজারে বিক্রি করা হতো তাহলে সেটার পরিমাণ কত হতো? ধারণা করি, ১-২ বিলিয়ন ডলারের বেশি নয়।

এখন আন্তর্জাতিক বাজারে তৈরি পোশাক বিক্রি করে আমরা ৪৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করি। এর মাধ্যমে দেশে অনেক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। দেশে আর কোনও খাত নেই যেখানে এত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে। এ খাতে চাকরি করা পরিবারের সদস্যরাও নানাভাবে তাদের জীবনযাত্রায় উপকৃত হচ্ছে। তৈরি পোশাক খাতে সংশ্লিষ্ট কর্মজীবীদের ওপর ভিত্তি করে প্রসাধনী খাতও নানাভাবে বিকশিত হয়েছে— বাজারও বড় হয়েছে।

এছাড়া তৈরি পোশাক খাতকে কেন্দ্র করে ‘ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ ইন্ডাস্ট্রি’ হিসেবে সুতা-কাপড় তৈরি করে টেক্সটাইল খাতে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের বাজার হয়েছে। আরও আছে তৈরি পোশাক শিল্পকে নির্ভর করে এক্সেসরিজ খাত। এগুলো সবই রপ্তানীমুখী তৈরি পোশাকখাতের অবদান।

গত ২০ বছর ধরে সরকার বলছে, সবাই বলছে— আমরা রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে চাচ্ছি। এ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে আমাদের শুল্ক কাঠামো। এর মাধ্যমে আমরা যে সুরক্ষা দিচ্ছি— যার মাধ্যমে আমরা স্থানীয় উৎপাদকদের মুনাফার পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছি। উৎপাদনশীলতা দিয়ে আমরা তাদের মুনাফা বাড়াইনি। কিন্তু তৈরি পোশাক খাতের প্রস্তুতকারকরা উৎপাদনের মাধ্যমে তাদের মুনাফা বাড়িয়েছে। তারা শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্প। দেশের বাজারের প্রতি আকর্ষণ তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়।

আমাদের রপ্তানিযোগ্য পণ্যের প্রায় পুরোটাই হলো তৈরি পোশাক। ভারত-চীন-রাশিয়ায় আমরা শুধু তৈরি পোশাক রপ্তানি করি। এ খাতে ২১৬টির মতো পণ্য রপ্তানি করি। বড় বাজারের এই দেশগুলো অবশ্যই আমাদের রপ্তানির গন্তব্য হতে পারে। কিন্তু তৈরি পোশাক খাতের বাইরে আমাদের ১৫০০-র মতো রপ্তানি পণ্য আছে। আন্তর্জাতিক বাজারে এসব পণ্যের রপ্তানির পরিমাণ খুবই অল্প।

এসব পণ্যের রপ্তানি বাড়াতে গেলে প্রথম প্রশ্ন হলো— আপনি রপ্তানি করবেন কিনা। যারা এই ১৫০০ পণ্য প্রস্তুত করেন, তারা দেশের বাজারে বিক্রি করে যে মুনাফা পায় সেটা রপ্তানি করে পায় না। দেশের বাজারে এসব পণ্যের মুনাফার হার এত বেশি যে তারা রপ্তানি করতে উৎসাহিত হয় না। আর এসব পণ্য আমরা রপ্তানি করতে চাইও না। তাই এই বিষয় নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে।

আমরা গবেষণা করে দেখিয়েছি যে, অন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে অন্তত ৫০০-র মতো পণ্যের রপ্তানি আমাদের পক্ষে বাড়ানো সম্ভব। এই পণ্যগুলো অনেক বেশি কম্পিটেটিভ— প্রতিযোগিতামূলক। ভিয়েতনাম, চীনের মতো ৩০-৪০ টি দেশ এই পণ্যগুলো রপ্তানি করে থাকে। এদের সঙ্গে কিন্তু আমরাও প্রতিযোগিতা করে রপ্তানি করতে পারি। কিন্তু এসব পণ্য আমরা রপ্তানি করতে আগ্রহ দেখাচ্ছি না। কেন?

গত ২০ বছর ধরে সরকার বলছে, সবাই বলছে— আমরা রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে চাচ্ছি। এ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে আমাদের শুল্ক কাঠামো। এর মাধ্যমে আমরা যে সুরক্ষা দিচ্ছি— তাতে আমরা স্থানীয় উৎপাদকদের মুনাফার পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছি। উৎপাদনশীলতা দিয়ে আমরা তাদের মুনাফা বাড়াইনি। কিন্তু তৈরি পোশাক খাতের প্রস্তুতকারকরা উৎপাদনের মাধ্যমে তাদের মুনাফা বাড়িয়েছে। তারা শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্প। দেশের বাজারের প্রতি আকর্ষণ তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়।

আমরা শুল্ক আরোপ করে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছি। এর ফলে একই ধরনের স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের দাম বেড়ে গিয়েছে। বাজেট থেকে এসব পণ্যের পরোক্ষ ভুর্তকি দিতে হয় না। সাধারণ মানুষই এই টাকাটি দিয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক বাজারে দামের তুলনায় অনেক বেশি দাম দিয়ে এসব পণ্য আমরা কিনে থাকি।

আমরা নাইকির জুতা এখানে যে দাম দিয়ে কিনি, সেটা ভারতের বাজার থেকে কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের বাজার থেকে আরও কম দামে কিনতে পারি। এই অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা দরকার।

সকাল সন্ধ্যা: এর মধ্য দিয়ে রুপি, ইউয়ান, রুবেলে লেনদেন করার কতটা সুযোগ তৈরি হবে?

জাইদী সাত্তার: বাংলাদেশ কিন্তু প্রথম থেকেই তৈরি পোশাক উন্নত দেশে রপ্তানি করে থাকে। এই দক্ষতা সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই।এই রপ্তানির মূল্য পরিশোধ ডলারেই হয়ে থাকে। এখনও আন্তর্জাতিক লেনদেনের ৮০ শতাংশই ডলারেই হয়। ভারত-চীন-রাশিয়ার ক্ষেত্রে আমরা যে পরিমাণ রপ্তানি করি সেই পরিমাণ তাদের টাকায় দিলেও দিতে পারে।

তবে এসব দেশে রপ্তানি বাড়াতে পারলে আমাদের আমদানির সুযোগ বাড়বে। ফলে আমরা যার যার দেশের স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেন করতে পারব। যদিও প্রত্যেকটি দেশের জাতীয় স্বার্থ ও নীতি আছে। তাই সেই অনুযায়ী আমাদের সুযোগ তৈরি করে নিতে হবে।

সকাল সন্ধ্যা: বাংলাদেশের এক্ষেত্রে আর কোনভাবে অগ্রসর হতে পারে?

জাইদী সাত্তার: আমদানির ক্ষেত্রে ভারত ও চীন আমাদের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য লেনদেনকারী দুই দেশ। ফলে এই দুই দেশে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ লেনদেন ভারসাম্যের সঙ্গে রক্ষা করা যথার্থ হবে। ভূ-রাজনীতির বিবর্তনের মধ্যে বাংলাদেশকেও ইতিবাচকভাবে সক্রিয় হতে হবে।

সকাল সন্ধ্যা: সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌদি আরব তেলচুক্তি আর নবায়ন করেনি। এর ফলে ডলারের ওপর চাপ কতটা কমবে? বিশ্ব বাণিজ্য লড়াইয়ে ডলার বনাম ইউয়ানে বাংলাদেশ কতটা সুবিধা পাবে?

জাইদী সাত্তার: এখনও বিশ্বের সবগুলো দেশ নানাভাবে দুই কারণে বিভক্ত। বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন ঘটনায় স্যাংশন দেওয়া একটি নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা। তারপরও আমাদের কাছে যে হিসাব আছে তাতে আমরা দেখেছি যে, স্যাংশনসহ নানা কারণে বিভিন্ন দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমেনি।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌদি আরব তেলচুক্তির নবায়ন না করার প্রভাব বুঝতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। চীন চাইছে যে, তাদের কারেন্সি ‘কনর্ভাটেবল কারেন্সি’ হয়ে উঠুক। কিন্তু সেটা এখনও তেমন অবস্থায় যায়নি। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে ডলারের প্রভাব এখনও কমেনি। আগে এটা ছিল ৭০ শতাংশ— এখন সেটা ৬০ শতাংশ হয়েছে।

সকাল সন্ধ্যা: বাংলাদেশ গত দুই বছর ধরে রিজার্ভ সংকটে আছে। ডলারের মূল্য বাড়ছে। আপনি বলছেন, রপ্তানি বৈচিত্র্য আনার বিকল্প নেই। সঠিক বাণিজ্য নীতির কথাও বলেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ সংকট কাটাতে বিভিন্ন পদক্ষেপও গ্রহণ করছে। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে রিজার্ভে কতটা স্বস্তি ফিরবে বলে আপনার মনে হয়?

জাইদী সাত্তার: আমরা দীর্ঘদিন ধরে টাকার সঙ্গে ডলার বিনিময় হারকে নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছি। এর নানা পর্যায় আছে— পর্ব আছে। এর ফলে বাজারের প্রয়োজন অনুযায়ী রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে হয়েছে। তবে এখন আমরা এই বিনিময় হারটি বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েছি। আমরা ফ্লেক্সিবল একচেঞ্জ রেইট পদ্ধতিতে গিয়েছি। এই বিষয় থেকে কিছুটা সুবিধা পেতে আমরা শুরু করেছি। তবে আমাদের রিজার্ভ বাড়াতে রপ্তানিতে আরও জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

সকাল সন্ধ্যা: আপনি বলেছেন, অতিরিক্ত আমদানি শুল্ক বাংলাদেশে বিনিয়োগের প্রধান বাধা। বাংলাদেশের গড় আমদানি শুল্ক প্রায় ২৭ দশমিক ৬ শতাংশ। আমদানি শুল্কের এই হার বাংলাদেশের রপ্তানি ও বিনিয়োগ প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। অন্যদিকে আমরা দেখছি, বাংলাদেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিম্নগামী। উচ্চ মূল্যস্ফীতির অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবেও আপনি উচ্চ আমদানি শুল্ককে চিহ্নিত করছেন। সরকারের এই বিষয়ে করণীয় কী?

জাইদী সাত্তার: বিষয়টি আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশে যে আমদানি শুল্ক কাঠামো সেটির কারণে দেশের বাজারে স্বাভাবিকভাবেই পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ঘটবে। যার ফলে মূল্যস্ফীতি হবে। এছাড়া সুরক্ষা ব্যবস্থার কারণে দেশে আমদানি করা সম ধরনের উৎপাদিত পণ্যের দাম বেড়েছে। এই সবকিছু মিলিয়ে আমাদের মূল্যস্ফীতিতে নিয়ন্ত্রণ আনা যাবে না। আর পণ্যের উচ্চমূল্য ব্যবসায়ীদের জন্য উপভোগ্য হলেও সেটি কখনও রপ্তানিমুখী পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হয় না।

ফলে শুল্ক ব্যবস্থাকে যৌক্তিক করা একান্ত প্রয়োজন। এ জন্য একটি ‘জাতীয় শুল্ক নীতি ২০২৩’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন করতে পারলে রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ ও বৃদ্ধিতে আমরা সুফল পাব বলে প্রত্যাশা করতে পারি।

আমরা শুল্ক আরোপ করে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছি। এর ফলে একই ধরনের স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের দাম বেড়ে গিয়েছে। বাজেট থেকে এসব পণ্যের পরোক্ষ ভুর্তকি দিতে হয় না। সাধারণ মানুষই এই টাকাটি দিয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক বাজারে দামের তুলনায় অনেক বেশি দাম দিয়ে এসব পণ্য আমরা কিনে থাকি।

সকাল সন্ধ্যা: দেশে রপ্তানি বৈচিত্র্য সৃষ্টি, বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের নীতি ও পরিবেশের উন্নতি নিয়েও দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা হচ্ছে। এ বিষয়ে এখনও আশানুরূপ অগ্রগতি পাওয়া যাচ্ছে না কেন?

জাইদী সাত্তার: তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য খুব ভালো নীতি আছে বাংলাদেশে। কিন্তু অন্য সব পণ্যের জন্য তেমন নীতি নেই।

এই যে মূল্যস্ফীতি হলো, এতে টাকার অবমূল্যায়ন হলো। এর ফলে প্রায় ৩৬ শতাংশ টাকার মূল্যহ্রাস হয়েছে। যদিও রপ্তানিকারকরা এর মাধ্যমে লাভবান হচ্ছে। এই অবমূল্যায়নে তারা ভুর্তকি পাচ্ছে একঅর্থে। অন্যদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড যে শুল্ক পাচ্ছে সেটাও তারা ৩৬ শতাংশ বেশি পাচ্ছে। যার ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গিয়েছে। আমি ভেবেছিলাম যে, এবারের বাজেটে অন্তত ১০ শতাংশ শুল্ক কমাবে। কিন্তু সেটা হয়নি।

আমদানির কারণে যেভাবে মূল্যস্ফীতি হলো— পণ্যের দাম বেড়ে গেল— বিনিময় হারের কারণে টাকার অবমূল্যায়ন হলো— হুট করে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশে চলে গেল। আইএমএফ’র হিসাবে দেখা গিয়েছে, মূল্যস্ফীতির ৫০ শতাংশ টাকার অবমূল্যায়ন থেকে এসেছে।

সকাল সন্ধ্যা: স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে এবারের বাজেটে তৈরি পোশাক ও চামড়াসহ ৪৩টি খাতের পণ্যে নগদ প্রণোদনা কমানো হয়েছে। পণ্যভেদে এই হার নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলার খরচ কমানো ছাড়াও স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের অংশ হিসেবে এই পদক্ষেপ। রিজার্ভকে ভিত্তি করে তৈরি করা এক্সপোর্ট ডেভলপমেন্ট ফান্ড কতটা সঠিকভাবে ব্যবহার করা যাবে? এই বিষয় সামগ্রিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে আপনার কাছে জানতে চাই।

জাইদী সাত্তার: এই নগদ প্রণোদনা কমানো যৌক্তিক। অর্ধেক করে দিয়েছে। আর স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ ঘটলে আমাদের আর রপ্তানিতে প্রণোদনা দেওয়ার সুযোগ থাকবে না। যদিও উত্তরণের বিষয়টি একটু দীর্ঘায়িত হতে পারে। এই সময় কিন্তু ‘এন্টি ডাম্পিং ডিউটি (AD)’ এবং ‘কাউন্টার ভেলিং ডিউটি (CVD)’ আরোপ করা কোনও দেশ বন্ধ রাখবে না।

গত বাজটেও প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা আমাদের রপ্তানিতে প্রণোদনার জন্য ছিল। এবারের বাজেটে সেটা ৪ হাজার কোটি করা হয়েছে। আর দেশীয় বাজারে যারা পণ্য বিক্রি করে তারা যে ‘শুল্ক সুরক্ষা’ পায় সেটিও কিন্তু পরোক্ষভাবে ভর্তুকি। সংরক্ষিত শুল্কের এই টাকাটা সাধারণ ভোক্তরা দিচ্ছে।

আমরা হিসাব করে দেখেছি যে, যেসব পণ্যে আমরা রপ্তানি প্রণোদনা দিয়ে থাকি সেটার গড় হার ১১ শতাংশ। কিন্তু একই ধরনের পণ্যে সুরক্ষা শুল্কের গড় হার ৩০ শতাংশ। একই ধরণের পণ্যের ক্ষেত্রেও এই ঘটনা ঘটেছে। এর মাধ্যমে আমরা কি রপ্তানিকে উৎসাহিত করছি নাকি স্থানীয় বাজারকে সুরক্ষা দিচ্ছি?

এক্সপোর্ট ডেভলম্পমেন্ট ফান্ড থেকে ডলারে স্বল্প সুদে ঋণ রপ্তানিকারকদের দেওয়া হয়। আইএমএফ এই বিষয়ে আমাদের বলেছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যালেন্স অব পেমেন্টেস ম্যানুয়াল (বিপিএম ৬) অনুযায়ী, এই ফান্ডটি রিজার্ভে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। সেই অনুযায়ী আমাদের এখন রিজার্ভ হিসাব করতে হচ্ছে।

আমরা বাণিজ্য নীতিতে তৈরি পোশাক খাতের জন্য একটা নীতি করে রেখেছি। আর অন্য সব খাতের জন্য আরেকটা নীতি। এই অবস্থাকে আমি বলছি ‘ডুয়েলিজম’। আমাদের দেশে দুই ধরনের বাণিজ্য নীতি আছে। একটা হলো উন্মুক্ত বাণিজ্য। আরেকটি খুবই সংরক্ষিত— সীমিত— রক্ষণশীল। আমাদের যে বাণিজ্য নীতি সেটা রপ্তানিবান্ধব নয়।

সকাল সন্ধ্যা: বাংলাদেশের বাণিজ্য নীতিতে আপনি ‘ডুয়েলিজম’র কথা বলেছেন। কেন এটি হয়েছে? এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন?

জাইদী সাত্তার: আমরা বাণিজ্য নীতিতে তৈরি পোশাক খাতের জন্য একটা নীতি করে রেখেছি। আর অন্য সব খাতের জন্য আরেকটা নীতি। এই অবস্থাকে আমি বলছি ‘ডুয়েলিজম’। আমাদের দেশে দুই ধরনের বাণিজ্য নীতি আছে। একটা হলো উন্মুক্ত বাণিজ্য। আরেকটি খুবই সংরক্ষিত— সীমিত— রক্ষণশীল। আমাদের যে বাণিজ্য নীতি সেটা রপ্তানিবান্ধব নয়।

এই কারণে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে আসে না। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা কেন বাংলাদেশে আসবে? তারা যা উৎপাদন করে সেটি দেশীয় বা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করার জন্য? নাকি তারা যে পণ্য এখানে উৎপাদন করবে সেটা রপ্তানি করবে?

সবাই মনে করছে, আমরা রপ্তানিতে সফল একটা দেশ। কিন্তু আমাদের সাফল্য শুধু তৈরি পোশাকে— অন্যকিছুতে নয়। আমাদের রপ্তানির ৮৮ শতাংশ তৈরি পোশাক খাত থেকে আসে। গত ২৫ বছরে তৈরি পোশাক ছাড়া আমাদের অন্য পণ্যের রপ্তানির হার বাড়েনি। আমাদের শুল্ক কাঠামোও রপ্তানিবান্ধব নয়। তৈরি পোশাক খাত রপ্তানিতে সফল হলেও অন্য রপ্তানি পণ্যের ব্যাপক কোনও সফলতা পাওয়া যায়নি।

সকাল সন্ধ্যা: অচিরেই নবম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শুরু হবে। রূপকল্প ২০৪১ এবং জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এ পরিকল্পনায় প্রাধান্য পাবে। আপনি বেশ কয়েকবার সদস্য হিসেবে এই পরিকল্পনা প্রণয়নে যুক্ত ছিলেন। এই অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে জানতে চাই, হতে যাওয়া এই পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আপনি কী প্রত্যাশা করছেন?

জাইদী সাত্তার: বাজেটের মতো সংসদে পাস হওয়া আইনগত নথি নয় এই পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। আইনিভাবে এই পরিকল্পনা বাধ্যতামূলকও নয়। বরং এটা আমাদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। আমাদের এই আকাঙ্ক্ষার লক্ষ্য আছে।

বর্তমানে আমাদের এই অর্থনৈতিক অবস্থা ধরে রাখতে পারলে একটু সময় লাগলেও ২০৩৩ সালের মধ্যেই আমরা উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হতে পারব। এরপরই তো মূল চ্যালেঞ্জ— উন্নত দেশ হওয়া। ভারত ও চীনও উন্নত দেশ হওয়ার লক্ষ্যে আছে। ভারত স্বাধীনতার ১০০ বছরে ২০৪৭ সালে উন্নত দেশের পর্যায়ের যাওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। অবশ্য চীন এ লক্ষ্যের বিষয়ে কোনও সময় নির্ধারণ করে দেয়নি।

এমন পরিস্থিতিতে আমাদের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা হওয়া উচিত দারিদ্র্য কমিয়ে আনা। বাংলাদেশ এখন অতি দারিদ্র্যের হার ৫.৬ শতাংশে নামিয়ে নিয়ে এসেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছাড়া দারিদ্র্য বিমোচন হয় না। তাই আমাদের কমপক্ষে ৭-৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে।

কী কৌশলে আমাদের এই প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে? দেশীয় বাজারে শিল্পায়ন করে, দেশীয় বাজারে পণ্য বিক্রি করে— কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে বেশি প্রবৃদ্ধিও অর্জন সম্ভব হবে না। রপ্তানির মাধ্যমেই আমাদের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব।

১৯৪৭ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ভারতের বাণিজ্য কৌশল কী ছিল? অন্দরমুখী।

আমদানি প্রতিস্থাপন শিল্পায়ন (Import Substitution Industrialization)। তখন ভারতে প্রবৃদ্ধি ছিল গড়ে ৪ শতাংশ। ১৯৯১ সাল থেকে দেশটিতে ট্রেড লিবারালাইজেশন— বাণিজ্য উদারীকরণ হলো। তখন থেকে অর্থনীতি বদলাতে শুরু করল। বাংলাদেশকেও একই পথে এগিয়ে যেতে হবে।

টেকসই প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য সবচেয়ে ভালো কৌশল হচ্ছে রপ্তানিমুখী অর্থনীতি গড়া। তাই আমাদের বাণিজ্য নীতি আরও উন্মুক্ত করতে হবে। তাতে আমাদের রপ্তানিমুখী বৈদেশিক বিনিয়োগ আসবে। এর ফলে রপ্তানির প্রতি আগ্রহ বাড়বে। সরকারকে সেই রপ্তানির পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

সকাল সন্ধ্যা: আর দুই বছর পর, ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের কাঠামো বদলে যাবে। এর জন্য বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত হয়েছে? এক্ষেত্রে আর কোন কোন বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া দরকার?

জাইদী সাত্তার: আবারও ঘুরে ফিরে রপ্তানিমুখী বাণিজ্য নীতির কথা বলতে হয়। টেকসই প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য সবচেয়ে ভালো কৌশল হচ্ছে রপ্তানিমুখী অর্থনীতি গড়া। তাই আমাদের বাণিজ্য নীতি আরও উন্মুক্ত করতে হবে। তাতে আমাদের রপ্তানিমুখী বৈদেশিক বিনিয়োগ আসবে। এর ফলে রপ্তানির প্রতি আগ্রহ বাড়বে। সরকারকে সেই রপ্তানির পরিবেশ তৈরি করতে হবে। যেভাবে তৈরি পোশাক খাতের জন্য করা হয়েছে। একই ব্যবস্থা অন্যান্য খাতের জন্যও করতে হবে। এ জন্য আমাদেরকে নতুন করে কোনও কৌশল আবিষ্কার করতে হবে না। আমাদের কৌশল আমাদের কাছেই আছে।

সকাল সন্ধ্যা: বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নানা দেশের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্ব বাড়াতে চায় বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে বর্তমান ভূ-রাজনীতি ও ভূ-অর্থনীতি বাংলাদেশের জন্য কতটা সহায়ক অবস্থায় আছে?

জাইদী সাত্তার: বর্তমান ট্রেড ওয়ার-এর বাইরে আছি আমরা নানা কারণে। এর ফলে আমরা কিছু সুবিধা পাচ্ছি। ‘চায়না প্লাস ওয়ান (C+1)’ সুবিধার কথা এক্ষেত্রে বলা যায়। তাই আমাদের ইতিবাচক সক্রিয়তার কোনও বিকল্প নেই।

সকাল সন্ধ্যা: আপনাকে ধন্যবাদ।

জাইদী সাত্তার: আপনাকেও ধন্যবাদ।   

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক করাই সরকারের করণীয়

gog