অদক্ষ ব্যবস্থা রেখে সামাজিক সুরক্ষার আওতা বাড়িয়ে সুফল মিলবে না
ডিসেম্বর ১৩, ২০২০
ড. বজলুল হক খন্দকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক। গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) চেয়ারম্যান ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) পরিচালক। ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব অরউইক থেকে মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। দারিদ্র্য ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, ডাটা অ্যানালাইসিস ও ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট, নীতি প্রণয়ন, আঞ্চলিক বৈষম্য, রাজস্বের প্রভাব, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নসহ নানা বিষয়ে তার গবেষণা বিস্তৃত। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার কয়েকটি খাতের কারিগরি কাঠামো তৈরিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ রয়েছে তার। তিনি বিভিন্ন দেশের সোস্যাল অ্যাকাউন্টিং ম্যাট্রিক্স প্রণয়ন, রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কার, আয় বণ্টন সহায়ক নীতি প্রণয়নে ভূমিকা রেখেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থায় কাজ করার সুদীর্ঘ ইতিহাস সমৃদ্ধ এ অর্থনীতিবিদ দেশের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বিভিন্ন দিক নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা
বাংলাদেশের একটি জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল রয়েছে। আপনি এ–সংক্রান্ত বেশকিছু গবেষণাও করেছেন। আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল কতটা যুগোপযোগী?
জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল (এনএসএসএস) অনুমোদন হয়েছে ২০১৫ সালের জুনে। অনুমোদনের পর আমরা কী কী কাজ করব, তার একটি সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এর মধ্যে বড় একটি কাজ ছিল কী ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি আমরা পরিচালনা করব তা নির্ধারণ। একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার, তখনই (২০১৫-১৬ সাল) আমাদের ১০৫টি সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি ছিল। এগুলো সামলানোর জন্য ২৩টি মন্ত্রণালয় ও এজেন্সি যুক্ত ছিল। এটি বড় ঝক্কির বিষয় ছিল। ফলে অপচয় হতো বেশি। এখনো হচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের একটি পরিকল্পনা ছিল যে ছোট ছোট কর্মসূচিকে ছয়টি বড় কর্মসূচিতে নিয়ে আসা। একটি শূন্য থেকে চার বছর বয়সী শিশুর জন্য, একটি বিদ্যালয়গামী শিশুদের জন্য, একটি কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর জন্য, একটি নারীদের জন্য, একটি বয়স্কদের জন্য এবং একটি প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি। ওই কৌশলপত্রে আমরা আরেকটি বিষয় বলেছিলাম, পন্থার দিক থেকে বাংলাদেশে সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থাকে ভিন্ন দিকে নিতে হবে। বর্তমানে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সাহায্য করা হচ্ছে। সেজন্য এসব কর্মসূচি দারিদ্র্য বিমোচনকেন্দ্রিক। আমরা এ ধরনের কর্মসূচি প্রবর্তন করেছিলাম ১৯৭৪ সালে। সেগুলোই বিবর্তন হচ্ছিল। বিবর্তন হতে হতে আমরা এ পর্যন্ত এসেছি। এখন দরিদ্র অনেক কমে গেছে। সর্বসাম্প্রতিক তথ্যানুযায়ী, দেশে দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। কাজেই সামাজিক সুরক্ষার দিক থেকে আমাদের দারিদ্র্য থেকে সরে আসতে হবে। তবে করোনার এ সময়ে দারিদ্র্য ও বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পাওয়ার খবর আসছে। সেক্ষেত্রে করোনার বিষয়টি সামনে রেখে আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সাজাতে হবে।
ভবিষ্যতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ক্ষেত্রে আমাদের কী ধরনের অ্যাপ্রোচ নিতে হবে?
সামাজিক সুরক্ষার ক্ষেত্রে এখন আমাদের জীবনচক্রভিত্তিক অ্যাপ্রোচ নিতে হবে। জীবনচক্রের বিভিন্ন ধাপে যেসব ঝুঁকি আছে, সেগুলো মোকাবেলায় যে ধরনের কর্মসূচি জরুরি, সেগুলো নিতে হবে। যখন শিশুর বয়স শূন্য থেকে চার বছর, তখন একটি কর্মসূচি দরকার; স্কুলগামী শিশুদের জন্য একটা কার্যক্রম দরকার; তারপর তরুণ ও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর জন্য (এর মধ্যে নারীদের জন্য স্বতন্ত্র কর্মসূচি দরকার) একটা কর্মসূচি দরকার, বয়স্কদের জন্য একটি এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য একটি কর্মসূচি দরকার। এনএসএসএসে আমরা এ ধরনের কর্মসূচি নেয়ার কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম আমরা দারিদ্র্যবিষয়ক অ্যাপ্রোচ থেকে জীবনচক্রভিত্তিক অ্যাপ্রোচে চলে যাব। জীবনচক্রভিত্তিক অ্যাপ্রোচে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কর্মসূচি পড়ে যায়। কিন্তু সমস্যা হলো, কর্মসূচিভিত্তিক তেমন কোনো সমন্বয় এখনো তৈরি হয়নি। এদিক থেকে আমরা খুব একটা এগোতে পারিনি। আমাদের এখনো ১৩০-১৪০টি ছোট কর্মসূচি রয়েছে। অনেক কর্মসূচি বর্তমানে উন্নয়ন বাজেটে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এখন এডিপির অধীনে অনেক কর্মসূচি-প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এখানে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন।
অনেকেই বলেন, সামাজিক খাতে বরাদ্দ অপ্রতুল। আবার যা–ও দেয়া হয়, তা যথাযথ ব্যক্তির হাতে পৌঁছাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। এর সমাধান মিলবে কীভাবে?
অনেকাংশে সত্য যে প্রকৃত অসচ্ছল-দরিদ্রদের আমরা ধরতে পারছি না; অর্থটা তাদের কাছে যাচ্ছে না। এখন সামাজিক সুরক্ষায় জিডিপির প্রায় ২ দশমিক ২ শতাংশ খরচ করছি আমরা। যদি পেনশন বাদ দিই, তাহলে এটি জিডিপির ১ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসবে। এ সুবিধা যার পাওয়ার কথা, তাকে দিতে পারছি না। কারণ সুফলভোগী নির্বাচনে আমাদের অনেক সমস্যা রয়ে গেছে। যে দরিদ্র মানুষকে নির্বাচন করব, তাকে আমরা ঠিকমতো নির্ধারণ করতে পারছি না। এটিকে বলা হয় ‘আন্ডারকাভারেজ অব পুওর’। ২০১৬ সালের হিসাবে এটি (আন্ডারকাভারেজ অব পুওর) ৭০ শতাংশ। তার মানে আমরা যদি ১০০ জন দরিদ্রকে সুবিধা প্রদানের জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করি, তাহলে ৭০ জনের ক্ষেত্রেই আমরা ভুল ব্যক্তিকে দিচ্ছি। আরেকটি হলো অন্তর্ভুক্তির সমস্যা। সেটি হলো, তুলনামূলকভাবে যারা সচ্ছল, তাদের আমরা সুবিধার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে ফেলছি। সেটি প্রায় ৪৬ শতাংশ ছিল ২০১৬ সালের হিসাবে। এই অদক্ষ-অকার্যকর ব্যবস্থা না বদলালে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা ও ব্যয় বাড়িয়ে কোনো লাভ নেই।
সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের ব্যবস্থাপনা বা পদ্ধতি উন্নয়নে আমাদের কী করতে হবে?
সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম উন্নয়নের জন্য একটি প্রকল্প নিয়েছে সরকার। পুরো বিষয়টিকে সরকার একটি ডিজিটাল ফর্মে নিয়ে আসতে চাইছে। আর তা হলো এমআইএস। এমআইএস করলে কিছুটা ভালো হবে। তবে এটিও মনে রাখতে হবে এমআইএস কিন্তু সব সমস্যা সমাধান করে দেবে না। তার জন্য আমাদের সুনির্দিষ্ট কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এখন সরকার বিবিএসের মাধ্যমে জাতীয় খানা তথ্যভিত্তি (ন্যাশনাল হাউজহোল্ড ডাটাবেজ) তৈরি করছে। এটি প্রায় তিন বছর আগে শুরু হয়েছে। এখন মনে হচ্ছে শেষ করতে আরো দুই বছর লাগবে। এটি একটি অর্থনৈতিক শুমারি। এ তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিটি পরিবারের অর্থনৈতিক তথ্য থাকবে। ওই শুমারিতে বিবিএস ১৮টি বিশেষ তথ্য সংগ্রহ করেছে। এগুলোর মাধ্যমে তারা একটি তথ্যভিত্তি তৈরি করছে। এই ১৮টি তথ্যের মাধ্যমে তারা একটি কর্মসূচি তৈরি করবে। এটিকে বলা হচ্ছে ‘প্রক্সি মিনস টেস্ট’।
প্রক্সি মিনস টেস্ট সম্পর্কে একটু বলবেন কি?
অনেক দেশেই মিনস টেস্ট করা হয়। মিনস জানা থাকলে লক্ষ্য স্থির করা যায়। এই সীমার নিচে থাকলে সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা পাবে, এই সীমার ওপরে পাবে না। আমরা আমাদের বেশির ভাগ মানুষের আয় জানি না। কারণ আমাদের এখানে দক্ষ ট্যাক্স ব্যবস্থা নেই। এক্ষেত্রে একটি বৈশ্বিক চর্চা হলো প্রক্সি মিনস টেস্ট (পিএমটি)। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে ১৮টি সূচক ব্যবহার করা হচ্ছে। কিছু জনমিতিভিত্তিক, কিছু খানাভিত্তিক, কিছু ভোগভিত্তিক। সব মিলিয়ে ১৮টি সূচক। এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাংক বা সরকার একটি পিএমটি মডেল করবে। মডেল করার পরে প্রতিটি পরিবার-খানার জন্য ১৮টি নাম্বার ও তার ভার অনুযায়ী একটি করে নাম্বার প্রদান করা হবে। যেমন ৫০০, ৫১০ এভাবে নাম্বার দেয়া হবে। এরপর সরকার একটি কাট অফ পয়েন্ট তৈরি করবে। বলবে এর নিচে অবস্থানকারীদের এই পরিমাণ অর্থ দেয়া হবে। তারা সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর অধীনে আসবে, বাকিরা আসবে না।
এতে কি সমস্যার সমাধান হবে?
বিশ্বব্যাংক নিজেও সন্দিহান। তারা ২০১৬ সালের তথ্য নিয়ে ১০টি মডেল করেছিল। তারা এর মধ্যে তিনটিকে বলেছিল বেস্ট ফিট মডেল। আমরা যদি ২০ শতাংশ দরিদ্রকে টার্গেট করি, তাহলে তাদের মডেল অনুযায়ী ৭০ শতাংশের ‘এক্সক্লুশন’ সমস্যা তাত্ত্বিকভাবে দাঁড়াবে ৬০ শতাংশ। তার সঙ্গে আরো ৫ শতাংশ কম করে যোগ করুন। আমরা যখন বাস্তবায়নে যাব আরো ৫ শতাংশ যোগ হবে। চূড়ান্তভাবে এই মডেল করে প্রায় ৭০ শতাংশই পাচ্ছি। তাহলে খুব একটা লাভ হচ্ছে না। আমাদের প্রশ্ন হলো, এটি আসলে পিএমটি মডেলের সমস্যা নয়। এটি সুন্দর ও ভালো মডেল। সমস্যা হলো, আমরা কত লেভেলে এটি অন্তর্ভুক্ত করব। কম লেভেলে করলে পিএমটি মডেলেও আমাদের ৭০ শতাংশ এক্সক্লুশন সমস্যা থেকে যাবে। আন্ডারকাভারেজ দূর করতে পারব না। আমাদের মতো দেশে আন্ডারকাভারেজ দূর করতে চাইলে ২০ শতাংশ দরিদ্রকে সহায়তার লক্ষ্য নির্ধারণ করলে তা কাজ করবে না। যে মডেলেই পছন্দ করা হোক না কেন, সেখানে সমস্যা রয়ে যাবে। অন্তত ৫০-৬০ শতাংশ মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আনতে হবে। আমরা বলেছি, জাতীয় দারিদ্র্যসীমা অনুযায়ী বাংলাদেশের দারিদ্র্য সাড়ে ২০ শতাংশ হলেও এখানে অনেক লোক অরক্ষিত (ভালনারেবল)। দারিদ্র্য সীমারেখা যদি আরো একটু ওপরে ওঠানো হয়, অর্থাৎ যদি ২০ শতাংশ বাড়ানো হয়, তাহলে অনেক মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতায় আসবে। কারণ বেশির ভাগ লোকই দারিদ্র্যরেখার আশেপাশে অবস্থান করছে। এ সমস্যা দূর করার জন্য অন্তত মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশকে অন্তর্ভুক্ত করার কথা আমরা বলেছিলাম। এটা করলে সমস্যা অনেক কমে যাবে। তখন এক্সক্লুশন সমস্যা কমে ৩০ শতাংশের কাছে চলে যাবে। ৭০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ একটা বিশাল কার্যকারিতা নিশ্চিত হচ্ছে। তাত্ত্বিকভাবেই ভুল লোককে নির্ধারণ করা হচ্ছে। এটি পিএমটি মডেলের সমস্যা নয়। বিষয়টি অনেকে বোঝেন না। অনেকে মনে করেন যে এমআইএস বা পিএমটি মডেল করলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ভারতও আধার কার্ড বা এমআইএস কার্ড প্রবর্তন করেছে। তাদের লাভ হয়নি।
আমাদের করণীয় কী হবে?
আমাদের ‘পিএমটি প্লাস’ করতে হবে। সরকার পিএমটি করেছে, এটি ভালো কথা। এর মাধ্যমে আমাদের যোগ করতে হবে। আমরা আরো কী কী করতে পারি। অনেকেই বলেন পিএমটির সঙ্গে কিছু পণ্য (কমোডিটি) যোগ করতে। আমরা এটি করে দেখতে পারি। পণ্যভিত্তিক কিছু যোগ করে এটি উন্নত করা যায় কিনা। কিছু তথ্য আমি জানি, পণ্যভিত্তিক নিরীক্ষা খুব একটা সফল হয়নি। আমরা আসলে ২০ শতাংশ লোককে টার্গেট করে কার্যকরভাবে সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারব না। বিশ্বব্যাংক দাবি করে যে পিএমটি দিয়ে তারা ‘ইউনিভার্সেল কাভারেজ অব পুওর’ করতে পারবে। সব দরিদ্রকে তারা সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতায় আনতে পারবে, সেটি আসলে সম্ভব নয়। আমরা আসলে কতটা অন্তর্ভুক্ত করব—এটি আমাদের জন্য একটি বড় ইস্যু হিসেবে রয়ে গেছে।
আমার ধারণা, ৬০ শতাংশ কাভারেজ করলে একটি যৌক্তিক বা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক লোককে উন্নয়ন করতে পারব। সবাইকে পারব না। এটি বুঝতে হবে যে আমাদের কী করতে হবে। আমাদের এখনই সংস্কার করতে হবে। এটি একটা দিক। আরেকটি দিক, সামাজিক সুরক্ষার দুটি খুঁটি আছে। একটি খুঁটি হলো, সরকার তার অর্থটা ট্রান্সফার করবে, যেটি এখন আমরা করছি। আরেকটি বড় খুঁটি, সামাজিক বীমা পণ্যগুলোর (সোস্যাল ইন্স্যুরেন্স প্রডাক্ট) উন্নয়ন ঘটানো। বেকারত্ব বীমা, স্বাস্থ্য বীমা, সবার জন্য পেনশন এগুলো প্রবর্তন করতে হবে। বাংলাদেশে এ বীমা পণ্যগুলো ব্যাপকভাবে নেই। আমাদের আর্থিক ব্যবস্থার মধ্যে বীমা খাতটি এখনো দুর্বল। ব্যাংকিং খাত মোটামুটিভাবে একটি পর্যায়ে আছে। কিন্তু বীমা খাতের উন্নয়নে এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আমরা যেহেতু ধনী হচ্ছি, মানুষের কাছে টাকা আছে, সেহেতু তারা অন্তত এ পণ্যগুলো কিনতে পারবে। যেমন কেউ স্বাস্থ্য বীমা কিনবে, কেউ শিক্ষা বীমা কিনবে, আবার কেউ পেনশন বীমা কিনবে। বীমা খাতের সম্প্রসারণে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া দরকার। ধনীরা মোটামুটি নিজেরাই ঝুঁকি বহন করতে পারে। তাদের সঞ্চয় আছে, তাদের রেজিলিয়েন্স অনেক বেশি। তবে বাংলাদেশে এ রকম ধনীর সংখ্যা ১০ শতাংশের বেশি নয়। তাহলে বাকি ৪০ শতাংশ লোক কোথায় যাবে? তারা সরকারি সাহায্যও পাচ্ছে না, তাদের সঞ্চয়ও নেই। তাদের জন্য সামাজিক সুরক্ষার একটি বড় উপায় বা রাস্তা হতে পারে বীমা।
বীমা নিয়ে অভিযোগ রয়েছে। কীভাবে এর সমাধান সম্ভব?
হ্যাঁ, অভিযোগ আছেই। এসব বন্ধে যা করতে হবে তা হলো, শক্ত নিয়ন্ত্রণ বিধি (রেগুলেশন)। আমাদের নতুন কিছু বীমা পণ্য তৈরি করতে হবে। যেগুলো আমাদের জন্য সাশ্রয়ী বা সামর্থ্যযোগ্য হবে। আমাদের বেশির ভাগ লোক এখনো অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। সেখানে আসলে বড় বীমা কোম্পানিগুলো যায় না। আমাদের বীমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে অধিকাংশই জীবন বীমা কোম্পানি এবং বাণিজ্যিক ধরনের বীমা কোম্পানি। কিন্তু সামাজিক সেবা দেয়ার মতো বীমা কোম্পানি এখনো তৈরি হয়নি। এক্ষেত্রে নতুন ধরনের পণ্য তৈরি করতে হবে। সেখানে সরকারের ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা-সমর্থন লাগবে। একটি বীমা নিয়ন্ত্রণ সংস্থা আছে। সেটিকে আরো শক্তিশালী করতে হবে।
আমাদের দুটি বিষয় পরিবর্তন হচ্ছে। এক. আমরা দ্রুত বুড়িয়ে যাচ্ছি। আমরা ওয়ান অব দ্য ফাস্টেস্ট এইজিং নেশন। ২০-২৫ বছর পর বিপুলসংখ্যক মানুষ অবসরে চলে যাবে। তাদের আয় সুরক্ষা নেই। তাদের জন্য কী করা হবে তা এখনই চিন্তা করতে হবে। এখনই পেনশন শুরু করলে তারা কিছুটা পরিত্রাণ পাবে। নইলে সরকারের ওপর বিশাল বোঝা চাপবে। পরিবার তাদের টানতে পারবে না। ঐতিহ্যিক পারিবারিক বন্ধন ধীরে ধীরে ভেঙে যাচ্ছে। ছেলেমেয়েরা আর পারছে না। এখন একসঙ্গে থাকতে পারছে না। বাস্তবতা হলো, তাদের আয়-বেতনও খুব বেশি নয়। সেখান থেকে বাঁচিয়ে তারা মা-বাবাকে দেবে। তারাও সমস্যার মধ্যে আছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক হেল্প এইজড নামে একটি সংগঠন আছে, যারা বয়স্ক লোকদের নিয়ে কাজ করে। তারা নেপাল, বাংলাদেশ, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশের লোকদের নিয়ে একটি জরিপ করেছিল। সেখানে ছেলেমেয়েদের প্রশ্ন করা হয়েছিল। বলেছিল, তারা পারছে না। আবার মা-বাবাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। তারা বলেছিল, ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে চাইতে তাদের লজ্জা লাগে। আমরা জানি, তারা কষ্টে আছে। তাহলে কীভাবে তাদের কাছ থেকে টাকা চাইব। সরকারের বড় চিন্তার বিষয় হওয়া উচিত, বয়স্কদের জন্য আমরা কী করব। এজন্য নতুন বীমা পণ্য আনা দরকার।
আমরা সবাই বলছি বাংলাদেশে এখন জনমিতিক লভ্যাংশ বা বোনাসের কাল চলছে। তরুণ এ জনগোষ্ঠীকে সদ্ব্যবহারে আমরা কি কোনো উদ্যোগ নিয়েছি?
জনমিতিক লভ্যাংশের একটি উৎপাদনশীল ও কর্মক্ষম জনশক্তি দরকার। অনেকেই জানেন না, একটি শিশুর ব্রেন ডেভেলপমেন্ট হয় প্রথম এক হাজার দিনে। শূন্য থেকে তিন বছর বয়সে যদি শিশু পুষ্টিকর খাবার পায়, তাহলে সে লম্বা হবে, তার ব্রেন তৈরি হবে। এরপর যতই পুষ্টিকর খাবার দিই না কেন, তার ব্রেইন ডেভেলপ হবে না। কাজেই এটি গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির একটি বড় গ্যাপ হলো, শূন্য থেকে চার বছর বয়সী শিশুদের জন্য আমাদের কোনো বড় ধরনের কর্মসূচি নেই। এ কারণে আমাদের খর্বকায়ত্বের সমস্যা রয়ে যাচ্ছে। এর হার কমছে, কিন্তু অত বেশি কমছে না। এজন্য এতে আমাদের জোর দিতে হবে। আমার ব্যক্তিগত প্রত্যাশা হলো, শিশুদের জন্য যে কর্মসূচি নেয়া হবে, সেটিকে ইউনিভার্সাল প্রোগ্রাম করা হবে। কীভাবে করব? প্রথমে সরকারি লোকজন বলবে, এটি সামর্থ্যযোগ্য (অ্যাফোর্ডেবল) নয়, আমাদের এত পয়সা নেই। আমি চাইছি না এত পয়সা। আমি চাইছি একটি মডেল করব, যেটি আর্জেন্টিনাসহ অনেক দেশ করেছে। ধরুন, আমার ১০০ জন শিশু আছে। তাদের মধ্যে আমি মনে করি ৫০ জন দরিদ্র। তাদের পক্ষে নিজেদের কিছু টাকা দেয়া সম্ভব নয়। তাদের অংশ সরকার দিয়ে দেবে। বাকি যে ৫০ জন আছে, তারা মোটামুটি টাকা দিতে পারবে। তাদের জন্য সরকারি পয়সা লাগবে না। তার জন্য লাগবে একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং কিছু পণ্য। আমি এই ১০০ জনকে পুরোপুরি সুবিধা প্রদান করব। ৫০ জনকে আমি দেব সরকারি পয়সা হিসেবে। আর বাকি ৫০ জনের জন্য আমি কিছু পণ্য তৈরি করব এবং শর্ত দেব। শর্ত পূরণ করতে না পারলে সে স্কুলে ঢুকতে পারবে না, কলেজে ঢুকতে পারবে না। আর সামর্থ্যবান মা-বাবারা প্রতি সন্তানের জন্য প্রতি মাসে ১ হাজার টাকা সঞ্চয় করবেন। আর যারা দরিদ্র, তাদের জন্য সরকার ১ হাজার টাকা দেবে। এটি সরকার তার রাজস্ব আয় থেকে দেবে। তাহলে কিন্তু আমাদের একটি বড় ফান্ড তৈরি হবে। এ ফান্ড শিশুদের পুষ্টি নিশ্চিতে সহায়তা জোগাবে। সবার জন্য একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করতে হবে, কীভাবে খাদ্য তৈরি করলে সর্বোচ্চ পুষ্টি পাওয়া যাবে। এটা নয় যে খাবার খেলেই পুষ্টি পাব। খাদ্য কী হবে, সেটি কীভাবে তৈরি করতে হবে—এজন্য একটি প্রচারণা চালাতে হবে। এ কর্মসূচি আমি করতে চাইছি সব শিশুর জন্য। বাংলাদেশের শূন্য থেকে চার বছর বয়সী প্রতিটি শিশুই এ কর্মসূচির মধ্যে আসবে। এটিকে আমি বলব ‘ইউনিভার্সেল চাইল্ড বেনিফিট প্রোগ্রাম’, যার একটি অংশ অর্থায়ন হবে সরকারি অর্থে আর বাকি অংশ হবে জনগণের নিজস্ব অর্থে। কিন্তু বিষয়টি একটু কঠিন। এটিকে নিয়ন্ত্রণ ও তদারক করতে হবে সরকারের। যেকোনো মা-বাবা তার শিশুর জন্য এ কার্যক্রমে অংশ নিতে চাইবেন। তারা যদি বোঝেন এটি ভবিষ্যতে কাজ দেবে, তাহলে প্রতিটি মা-বাবাই আলোচ্য কর্মসূচিতে বিনিয়োগ করবেন। আমি সব শিশুর জন্য এটি নিশ্চিত করতে চাইছি।
এর ফলাফল কী হবে?
চার বছর পার হওয়ার পর সে যখন স্কুলে ভর্তি হবে, তখন সে একটি স্বাস্থ্যবান শিশু হিসেবে প্রবেশ করবে। এরপর স্কুল প্রোগ্রামগুলো এটিকে টেকওভার করবে। স্কুলে আমরা কিছু নির্ধারিত প্রোগ্রাম দেব। এ প্রোগ্রামগুলোর পরিবেশ ভালো করতে পারলে শিশুরা দ্রুত শিক্ষা লাভ করবে। প্রাথমিক স্কুলে আরেকটি কর্মসূচি চালু করতে হবে। সেখানে আমরা দেখব, যাতে কোনো শিশু ঝরে না পড়ে। সেখান থেকে শিশুটি মাধ্যমিকে চলে যাবে। সেখানেও যেন কোনো ড্রপআউট না হয়, সেজন্য আমাদের আরেক ধরনের ইন্টারভেনশন লাগবে।
বর্তমানে শিক্ষা বৃত্তি রয়েছে। এটি কি যথেষ্ট?
শিক্ষা বৃত্তি কার্যক্রম সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারছে না। আমরা বৃত্তি প্রোগ্রামের মাধ্যমে ১০০ টাকা দিচ্ছি। এটি শিশুদের সুযোগ ব্যয়ের প্রতিফলন ঘটাচ্ছে না, যার বয়স ১০-১৫ বছর, তার মার্কেট ভ্যালু কত? সে যদি বাজারে কাজ করতে যায়, তাহলে ৩০০ টাকা পাবে। এখানে সুফল কে পাচ্ছে? আসলে সুফল পাচ্ছে পরিবার। তার দারিদ্র্য হার কমছে। আর সুবিধা পাচ্ছে কর্মনিয়োজনকারী। একজন বয়স্ক লোককে কাজে নিয়োজিত করলে লাগবে ৬০০ টাকা, আর শিশুকে দিতে হবে ৩০০ টাকা। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত কে হচ্ছে? শিশু এবং পুরো জাতি। একটি হিসাব আমি দিই। একটি শিশু যদি খর্বকায় (স্টান্টেড) অবস্থায় বড় হয়, তাহলে ভবিষ্যতে তার আয় কমে যায় ১২-২৬ শতাংশ। শিশুদের ক্ষতি তো আছেই, এটি দেশের লোকসান। এজন্য আমি চাইছি এ প্রোগ্রাম সফল করতে। এটি না করতে পারলে আমরা কর্মক্ষম ও উৎপাদনশীল জনশক্তি পাব না।
স্কুল মিল প্রোগ্রামকে কীভাবে দেখেন?
স্কুল মিল শুনতে বা বলতে ভালো শোনায়, কিন্তু এটি পরিচালনা করা কঠিন। কারণ আমরা দেখেছি যে খাদ্যভিত্তিক কর্মসূচিগুলো অনেক ব্যয়বহুল। আর এখানে অপচয় অনেক বেশি। সারা বিশ্বেই এটি প্রমাণিত। আমাদের আরো চিন্তা করতে হবে, আমরা স্কুল মিল কর্মসূচি নেব কিনা। এটা গবেষণা করতে হবে। আমরা যদি এ কার্যক্রম পরিচালনা করিও তাহলে দেখতে হবে এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করা যাবে কিনা। তদারকি জোরদার করা হবে কিনা। এতগুলো স্কুল তদারক করা সম্ভব কিনা। প্রতিটি স্কুলে একই লেভেলে খাওয়া যাচ্ছে কিনা। সেখানে কোনো অপচয় হচ্ছে কিনা। এসব বিষয় আমাদের দেখতে হবে। স্কুল ম্যানেজমেন্টকে আরো দক্ষ হতে হবে। নইলে শিশুরা স্কুল মিলের সুফল পাবে না। খরচ হবে অনেক টাকা, কিন্তু তারা সুফল পাবে না। কাজেই স্কুল মিল কর্মসূচি চালুর আগে হোমওয়ার্ক ঠিকমতো করতে হবে।
গত বছর আমি উগান্ডায় গিয়েছিলাম। সেখানকার অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করেছি। তারা সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি সম্প্রসারণ করতে চাইছে। তারা স্কুল মিল প্রোগ্রাম সফলভাবে করতে পারছিল না। বৈশ্বিকভাবে তারা সফল কোনো প্রোগ্রাম পাচ্ছে না। আমাদেরও দেখতে হবে কোথায় সফল স্কুল মিল প্রোগ্রাম রয়েছে। আমি সেটি অনুসরণ করতে পারি কিনা। একটা বিষয় পরিষ্কার ও প্রমাণিত, খাদ্যভিত্তিক কর্মসূচিগুলো অনেক ব্যয়বহুল এবং সেখানে লিকেজ বেশি হয়। প্রকিউরমেন্ট থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে অনেক ফাঁকফোকর থাকে। সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম থেকে সর্বোচ্চ সুফল পেতে এসব সমস্যা নিরসন করতে হবে।
সামাজিক সুরক্ষায় সরকারি অর্থায়ন কি যথেষ্ট?
এনএসএসএসে আমরা বলেছি, সামাজিক সুরক্ষায় বিনিয়োগ আমাদের জিডিপির ৩ শতাংশে নিতে হবে ২০৩০ সাল নাগাদ। সরকারের পেনশন বাদ দিয়ে সেটি এখন ১ দশমিক ৬ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। আমাদের সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থায় আরো দেড় শতাংশ অর্থ যোগ করতে হবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অনেকে বলেন যে এটা আমরা কোথা থেকে পাব? এখানে বড় সমস্যা, বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত এত নিম্ন যে এর ভিত্তিতে অর্থায়ন করা সম্ভব নয়। উন্নয়নের এ পর্যায়ে আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত হওয়া দরকার ছিল নিদেনপক্ষে ১৫ শতাংশ। তাহলে আমাদের অর্থায়নের সমস্যা থাকে না। সরকারের ঋণ নেয়ার সমস্যাও থাকে না। কর-জিডিপি অনুপাত যে বাড়াতে পারছি না, এটি আমাদের একটি বড় ব্যর্থতা। এটি ঠিক না হলে সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা সম্প্রসারণ করা আমাদের জন্য কঠিন হবে।
আপনি যেভাবে বললেন, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পুরো জীবনচক্রই সামাজিক সুরক্ষার অধীনে থাকতে হবে। যার সামর্থ্য আছে সে অর্থ দেবে, যার নেই তারটা সরকার দেবে। বাংলাদেশের বিদ্যমান সামাজিক নিরাপত্তায় সেটি নেই, পরবর্তী সময়ে যা হবে বা হচ্ছে, তাতে কি এটি থাকবে?
আমাদের দারিদ্র্যসংক্রান্ত সামাজিক নিরাপত্তা থেকে জীবনচক্রভিত্তিক অ্যাপ্রোচে যাওয়া দরকার। পরিকল্পনার দিক থেকে নয়, তবে প্রকৃত প্রস্তাবে ৬০ শতাংশ কর্মসূচি এরই মধ্যে জীবনচক্র অ্যাপ্রোচে আছে। কিন্তু গ্যাপ আছে অনেক। যেমন শিশুদের জন্য কর্মসূচির একটি গ্যাপ আছে। প্রতিবন্ধীদের জন্য আমাদের কোনো কর্মসূচি নেই। তাদের মূলধারায় আনতে হলে তাদের জন্য কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে। তার মানে বাকি ৪০ শতাংশ কর্মসূচি আমাদের এমনভাবে নিতে হবে, যাতে গ্যাপগুলো পূরণ করতে পারে। সে কারণে কর্মসূচি নেয়ার আগে চিন্তা করতে হবে।
আরেকটি বিষয় উল্লেখ করি, সামাজিক সুরক্ষায় যে এত টাকা খরচ করছি, তারও একটি প্রশাসনিক ব্যয় আছে। এই প্রশাসনিক ব্যয় নিয়ে আসলে আমরা কখনো চিন্তা করিনি। ব্যয়টা কত হওয়া উচিত? আমাদের হিসাবে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বব্যাপী ক্যাশ প্রোগ্রামগুলোর জন্য এ ব্যয় ৮ শতাংশের মতো। খাদ্যভিত্তিক প্রোগ্রামের জন্য ব্যয় হয় ২২-২৫ শতাংশের মতো। যা অনেক বেশি। এজন্য এনএসএসে বলা হচ্ছে, খাদ্যভিত্তিক সব কর্মসূচিকে আমরা ধীরে ধীরে ক্যাশে নিয়ে আসব। যাতে ওই কার্যকারিতা আমরা পাই। সানেম থেকে আমরা একটি গবেষণা করেছিলাম। সেখানে আমরা দেখেছি বাংলাদেশে নগদ অর্থভিত্তিক কর্মসূচিতে প্রশাসনিক ব্যয় ৪ শতাংশের মতো এবং খাদ্যভিত্তিক কর্মসূচিতে ৮-৯ শতাংশের মতো। তার মানে প্রশাসনিক ব্যয়ের দিক থেকে আমরা অনেক আন্ডার-ফান্ডেড। এর প্রতিফলন আমরা পাচ্ছি সিলেকশনে, মনিটরিংয়ে। একজন লোক হয়তো মারা গেছে, সে এখনো পেনশন পেয়ে যাচ্ছে। কিংবা একজন ভুল লোক পেনশন পাচ্ছে। এই অসঙ্গতিগুলো দূরের জন্য অন্তত ঠিক করতে হবে আমাদের প্রশাসনিক ব্যয় কী হবে। ইউরোপে হওয়া একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব দেশে প্রশাসনিক ব্যয় পর্যাপ্ত, সেখানে সামাজিক সুরক্ষার প্রভাব অনেক বেশি প্রশাসনিক ব্যয় অপর্যাপ্ত থাকা দেশগুলোর তুলনায়। তারা সামাজিক সুরক্ষার প্রশাসনিক ব্যয়ে গড়ে ১ শতাংশ মতো খরচ করে। কিন্তু কিছু দেশ আছে, যারা ১ শতাংশের বেশি করে। যেমন ডেনমার্ক, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস। তাদের সামাজিক নিরাপত্তার প্রভাব অনেক বেশি। রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া; যারা শূন্য দশমিক ২-৩ শতাংশ খরচ করছে প্রশাসনিক ব্যয়ে। সংস্কার যখন করব তখন এসব বিষয় আমাদের আনতে হবে। আমরা বিষয়গুলো বুঝছি কিনা, যথাযথভাবে তদারক করছি কিনা, এমআইএস সিস্টেম আছে কিনা—সবই প্রশাসনিক ব্যয়ের ব্যাপার। কিংবা কর্মসূচি পরিচালনার জন্য আমাদের পর্যাপ্ত লোকবল আছে কিনা প্রভৃতি বিষয় নিশ্চিত করা না হলে অর্থ দেয়া হবে ঠিকই, কিন্তু সেটি হবে অপচয়। বাংলাদেশে এখন সামাজিক নিরাপত্তা খাতের অর্থ অপচয় হচ্ছে। কারণ ৭০ শতাংশ দরিদ্র পাচ্ছে না, ৩০ শতাংশ পাচ্ছে। টাকা সরকার প্রদান করছে ঠিকই। তার মানে যার দরকার নেই, সে পাচ্ছে। সেজন্য বলছি, বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তার অর্থনৈতিক মূল্য কম। [চলবে]
https://bonikbarta.net/home/news_description/249930