খুবই দুঃখজনক যে অর্থনৈতিক নেতৃত্ব বলতে দেশে কিছু নেই। অর্থনৈতিক নেতৃত্বের প্রধান ব্যক্তি হচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তাঁর একটি অর্থনৈতিক দল অর্থাৎ ইকোনমিক টিম থাকার কথা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দক্ষ লোকদের নিয়ে দলটি থাকা উচিত।
এই যে অর্থনীতিতে খারাপ পরিস্থিতি চলছে, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে আমরা কি কিছু পেয়েছি? পাচ্ছি? না। অর্থমন্ত্রীই বা কিছু কি বলেছেন? না। অথচ পরিস্থিতি প্রশমনে কী করা উচিত, কত দিনে সংকট সমাধান করা যাবে, তার একটি রোডম্যাপ থাকা উচিত। বিক্ষিপ্তভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর কিছু কথা বলছেন।
জিনিসপত্রের দাম নিয়ে টুকটাক কথা বলছেন বাণিজ্যমন্ত্রী। পরিকল্পনামন্ত্রীও কিছু কথা বলে যাচ্ছেন। এগুলো অনেকটা ব্যক্তিগত মন্তব্য ধরনের কথাবার্তা। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির গভীরতা এত বেশি যে দরকার এখন রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রধান ভূমিকা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে আমলাতান্ত্রিকতা এখানে প্রাধান্য পাচ্ছে বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বলি আর অর্থসচিবের কথাই বলি না কেন, বিশ্ব অর্থনীতির বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় দেশের অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতির তাল মেলানোর কৌশল তাদের খুব জানা থাকবে এমন নয়। তাঁদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি। তাই প্রায় সব দেশে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় উপদেষ্টা কমিটি থাকে। আমাদের দেশে এখনো তা নেই।
বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বার্ষিক সভায় অর্থমন্ত্রী যে গেলেন না, বদলে গভর্নরকে দায়িত্ব দিলেন, এটা কতটা উচিত হলো ভাবার বিষয়। এটা ছোট কোনো বিষয় ছিল না। অর্থমন্ত্রী জানেন, আমলা নেতৃত্ব দিয়ে ভালো কিছু হয় না। আগে কখনোই এমনটা দেখা যায়নি যে অর্থমন্ত্রী এত গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে যোগ দেননি। আমরা জানি না, অর্থনৈতিক নেতৃত্বের এই শূন্যতা কীভাবে, কত দিনে মেটানো সম্ভব হবে?
দেশের অর্থনীতিতে যা চলছে, প্রথমে মুদ্রা বিনিময়ের হারের কথাই যদি বলি, কী দেখতে পাচ্ছি আমরা? ডলারের বাজার অস্থিতিশীল। বাজারে আবার কয়েক ধরনের ডলারের দর রয়েছে, যা গ্রহণযোগ্য নয়। এখন যে ১০৫ টাকা একটা দর আছে, এটাও সরকার করেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকও করেনি, করেছে বাজার। খোলাবাজারের সঙ্গে পার্থক্য কমিয়ে আনার ব্যাপারে বাস্তবে সরকারের কোনো কাজ নেই।
আবার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিচের দিকে নামছে। চার মাস পরে তা ২ হাজার ৩০০ কোটি ডলারে নেমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অথচ নানাভাবে ডলারের অপচয় হচ্ছে। আর সুদের হারে তো সরকার হাতই দেয়নি। নয়-ছয়ের ব্যাপারটা অন্যতম বাধা। অথচ আমরা ছাড়া প্রায় সব দেশ তাদের সুদের হার বাড়িয়েছে।
আমার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, তিনি (অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল) একজন ‘অ্যাবসেন্ট অর্থমন্ত্রী’। তিনি নিয়মিত অফিসে আসেন না। তবে নিশ্চয়ই বাসায় বসে কাজ করেন। একজন অর্থমন্ত্রীর শুধু বাসায় বসে কাজ করা যথেষ্ট নয়। তিনি একনেক বৈঠকে যান না—এটা অবশ্য পুরোনো খবর। ক্রয় কমিটির বৈঠক চাইলে এখন অনলাইনের পরিবর্তে সরাসরি করতেই পারেন।
কেন করেন না, এটা তিনিই ভালো বুঝবেন। তবে অসুস্থ থাকলে ভিন্ন কথা। অসুস্থ যে কেউই থাকতে পারেন। সে ক্ষেত্রে হয় তিনি নিজে অব্যাহতি নেবেন অথবা সরকার তাঁকে অব্যাহতি দেবে। অর্থমন্ত্রীর জন্য দেশ কেন ভুগবে। অর্থমন্ত্রীর ভালো করেই জানা উচিত যে আর্থিক খাত আমলাতন্ত্র দিয়ে চলবে না। তা–ও যদি বুঝতাম প্রজ্ঞাবান, স্বাধীন চিন্তার অধিকারী ঝানু কোনো আমলা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন। তা তো নেই। তা হলে? আমরা বিভ্রান্ত, অর্থমন্ত্রী বা তাঁর মন্ত্রণালয়ের নিষ্ক্রিয়তায় কোন দিকে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি।
আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পিআরআই
https://www.prothomalo.com/business/po6c1857o5