একটি দেশের অর্থনীতি কত শক্তিশালী, তা অনেকাংশে নির্ভর করে তার আর্থিক ব্যবস্থা কতটা সুদৃঢ় তার ওপর।
বাংলাদেশের আর্থিক খাত গত দুই দশকের বিভিন্ন সংস্কারমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে ক্রমে বেশ শক্তি অর্জন করছিল। বিশ্বমন্দার মধ্যেও তাদের পারফরম্যান্স ছিল আশাজাগানিয়া। আরও সংস্কার এবং প্রক্রিয়াগত কার্যক্রমের প্রয়োজন অবশ্যই রয়েছে, যার কিছু কিছু চলমান বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে। সংস্কারের এ ধারাকে এগিয়ে নেয়া গেলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আরও জোরালো ভূমিকা রাখতে পারে আর্থিক খাত। এ লক্ষ্যে প্রথমেই আর্থিক খাতের অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে হবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বলতে আমরা সাধারণত বুঝি— ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, স্টক মার্কেটে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান, নন-ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনস (এনবিএফআই) প্রভৃতি। এদের ব্যবস্থাপনা নিয়েই আজকের নিবন্ধ—
বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক অবস্থা মোটামুটি ভালো বলা যায়। এ ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোয়। বেসরকারি ব্যাংকেও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে কিছু সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অবস্থা বেশি নাজুক। ব্যাংকিং খাতের সার্বিক স্থিতির জন্য রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে কঠোর ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে সমস্যা— কে নিয়ন্ত্রণ করবে তাদের? এসব ব্যাংক বর্তমানে পরিচালিত হচ্ছে অর্থমন্ত্রণালয়ের অধীন ব্যাংকিং বিভাগের মাধ্যমে। পক্ষান্তরে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে দেখা দিচ্ছে সমন্বয়হীনতা। সম্প্রতি পত্রিকা মারফত জানা গেল, গত তিন বছরে ১০ হাজার কোটি টাকার ওপর নিয়মবহির্ভূত ঋণ দিয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো। বড় বিষয় হলো, এ অর্থ ফেরত আসার সম্ভাবনা কম। এটি নতুন কোনো সমস্যা নয়, অতীতেও ছিল। তবে গত এক দশক এ সমস্যা অনেকাংশে সংকুচিত ও স্থিতিশীল ছিল। বর্তমানে তা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। সরকার মাঝে মধ্যে নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে এগুলো রিক্যাপিটালাইজ করার চেষ্টা হয়েছে মাত্র, কিন্তু পুনর্গঠন ও সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হয়নি। মূলত ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণেই বারবার ঘুরে ফিরে আসছে এ সমস্যা।
বর্তমান ‘হলমার্ক’ কেলেঙ্কারি হতে পেরেছে শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ব্যাংকগুলোর কাঠামোগত দুর্বলতার কারণেই। লোকসান হচ্ছে এবং সরকারকে আবার রিক্যাপিটালাইজ করতে হচ্ছে তাদের। সার্বিক ব্যবস্থাপনায় বড় রকমের সমস্যা রয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক এখনো অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়। এ ক্ষেত্রে আমার অবস্থান খুবই সরল, কিন্তু শক্ত। এ পরিচালনা কোনোমতেই অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা উচিত নয়। বিগত সরকারের সময় ব্যাংকিং ডিভিশন বিলুপ্ত করা হয়েছিল এবং সেটাই ছিল সঠিক সিদ্ধান্ত। অতিদ্রুত বেসরকারি খাতের অনুরূপ সরকারি ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে পরিচালনার নীতি নিতে হবে। ব্যাংকিং বিভাগের অধীনে পরিচালিত হওয়ায় ব্যাংকগুলোর কার্যকরী পরিষদেও দলীয়করণ পোক্ত হচ্ছে। ঋণদানে দলীয় হস্তক্ষেপ ও প্রশ্রয়ের কারণে খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বেরিয়ে আসতে তো পারছেই না, বরং আরও ডুবতে চলেছে।
ব্যাংকিং খাতে দ্বিতীয় বড় সমস্যা, রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোকে আমানত সংগ্রহের জন্য ব্যবহার করা হতো আগে এবং সেটা তারা ইন্টার ব্যাংক মার্কেটের মাধ্যমে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে দিত ঋণ হিসেবে। রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো দেশব্যাপী বিশাল ব্রাঞ্চ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আমানত সংগ্রহে বড় ভূমিকা পালন করত। কিন্তু এটাও জানা ছিল যে, অভ্যন্তরীণ সুশাসনের অভাবে এসব ব্যাংকের ঋণমান সর্বদাই খারাপ ছিল, যার স্বীকৃতিস্বরূপ ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ওপর একটা সুস্পষ্ট নিয়ন্ত্রণ রাখা হতো। এটা ছিল খুবই কার্যকর। বর্তমান সরকার ধীরে ধীরে এ নীতি থেকে সরে এসেছে। আগে ৫ শতাংশের বেশি ঋণ রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো দিতে পারত না। পরে সেটাকে বাড়িয়ে ১০ এবং এখন তা আরও বাড়ানো হয়েছে বলে খবর রয়েছে। বলতে গেলে ঋণের পরিমাণের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই এখন। ফলে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো আমানতের টাকা প্রদানের পর ইন্টার ব্যাংক মার্কেটে ঋণ গ্রহণে নেমেছে। এ কারণে একদিকে ইন্টার ব্যাংক মার্কেটে টানাপড়েন বেড়ে গেছে, অন্যদিকে ঋণের মান কমে যাচ্ছে। এটাকে কীভাবে সমাধান করা হবে বা করা যাবে, তা বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারকেই ভাবতে হবে।
ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর সমস্যাও গভীর। এখানে লুকানো রয়েছে কিছু ফাঁদ। এতে পলিসিহোল্ডারদের বড় ধরনের লোকসানের সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ দেশের ইন্স্যুরেন্স উপখাত অনেকাংশেই আনরেগুলেটেড। তবে আশার কথা, বর্তমানে কিছু উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ইন্স্যুরেন্স রেগুলেটরি অথরিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু আইনের প্রয়োগ ও লোকবল সংকটসহ নানা কারণে এ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না বলে জানা যাচ্ছে। প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দলীয় হস্তক্ষেপের কারণে নিয়ন্ত্রণ সংস্থাই দিশেহারা অবস্থায় আছে। সরকারকে তাদের নিরাপত্তা ও আইনগত সহায়তা দেয়া উচিত, যাতে তারা সুষ্ঠু পদ্ধতিতে কাজ করতে পারে। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় ইন্স্যুরেন্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে কঠোর আইনি কাঠামোয় আনতে হবে সর্বাগ্রে। নইলে শক্তিশালী আর্থিক খাত কল্পনা করা যাবে না। প্রতিটি বীমা কোম্পানির সেবা, কাজ ও আর্থিক অবস্থার প্রকৃত মূল্যায়ন প্রয়োজন। এটি প্রতি পাঁচ বছর পর অ্যাকচুরিয়াল মূল্যায়নের মাধ্যমে হওয়া আবশ্যক এবং প্রয়োজনে আগেও তা করা যেতে পারে। তাদের আয়-ব্যয়, আয়ের প্রবৃদ্ধি, লায়াবিলিটি প্রভৃতি বিষয়ের পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন। বীমা কোম্পানিগুলোর উদ্দেশ্য হবে, পলিসিহোল্ডাররা যেন সর্বোচ্চ রিটার্ন পায়। আমাদের দেশে একটা অভিযোগ রয়েছে, এ ধরনের ব্যবসা পরিচালনায় তাদের প্রশাসনিক ব্যয় অনেক বেশি। এটা অবশ্যই কমিয়ে আনতে হবে, রেগুলেটরেরও এখানে বড় ভূমিকা রয়েছে। এ দেশে যত বীমা কোম্পানি রয়েছে, তার প্রয়োজন আছে কি না, সেটিও এক বড় প্রশ্ন। এত ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি রয়েছে, অথচ মানসম্পন্ন বীমা কোম্পানির সংখ্যা হাতে গোনা। অন্যদিকে বিদেশী ভালো বীমা কোম্পানিকে দেশে আসতে দেয়া হচ্ছে না। এটিও কাম্য নয়।
সম্প্রতি একটি বিষয় ভাবিত করছে সবাইকে, আর তা হলো— ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স তথা বিদ্যমান আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থের একটি বড় অংশ চলে যাচ্ছে ভূমি খাতের অনুত্পাদনশীল বিনিয়োগে। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইন্স্যুরেন্স রেগুলেটরি অথরিটি এরই মধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। নির্দেশনাও জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে বেশ দেরি হয়ে গেছে বলে আমার ধারণা। কেননা এরই মধ্যে ব্যাংকের অনেক অর্থ রিয়েল এস্টেটে চলে গেছে, যার প্রভাবে জমি ও ফ্ল্যাটের দাম বেড়েছে অবিশ্বাস্যভাবে। জমি ও ফ্ল্যাটের দামের ক্ষেত্রে বুদবুদ (বাবল) তৈরিতে এ দুই খাতের অবদান অনস্বীকার্য। অনেক আগে থেকেই এটি পরিহার করা গেলে দেশের অর্থনীতির জন্য তা ভালো হতো।
গত কয়েক বছরে এ দেশে এক ধরনের ইনফরমাল আর্থিক খাত প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে কো-অপারেটিভ বিজনেস, ল্যান্ড কো-অপারেটিভ ও মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম)। এরা বিভিন্ন নামে নানা ধরনের এমএলএম কার্যক্রমে নিয়োজিত এবং তাদের মূলধন সংগৃহীত হচ্ছে অনভিজ্ঞ সদস্যদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহের মাধ্যমে। ডেসটিনি, ইউনিপেটুইউ, যুবক প্রভৃতি সংস্থার নাম আমরা জানি তাদের বিভিন্ন আইনবহির্ভূত কার্যক্রমের জন্য। কিন্তু এসব কার্যক্রমে যে কত হাজার কোটি টাকা বিনিয়োজিত আছে, তা কেউ জানে না। আজ হোক কাল, এ ধরনের পিরামিড স্কিম মুখ থুবড়ে পড়বে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে লাখ লাখ নিরীহ মানুষ। যত দ্রুত সম্ভব এটি প্রতিরোধে পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে।
প্রশ্ন হলো, পিরামিড স্কিমের মাধ্যমে যে ক্ষতি এরই মধ্যে হয়ে গেছে তার দায় কে নেবে? সরকারিভাবে কেউ নিচ্ছে না, নেয়ার উদ্যোগও লক্ষীয় নয়। অথচ এসব কর্মকাণ্ড বন্ধের উদ্যোগ জরুরি ভিত্তিতে নেয়া প্রয়োজন। কেননা এর দায়ভার নেয়ার মতো প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা কারও আছে বলে মনে হয় না। তাই উত্তম উপায় হলো, এসব অবৈধ কর্মকাণ্ড অবিলম্বে বন্ধ করে দেয়া। বাংলাদেশে এমন কোনো কার্যকর ও দক্ষ রেগুলেটর গড়ে ওঠেনি, যারা দেশব্যাপী এসব কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। এসব প্রতিষ্ঠান গ্রাম-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে, যা নিয়ন্ত্রণ করা নতুন তৈরি হওয়া কোনো রেগুলেটরের পক্ষে কঠিন। দেশে কো-অপারেটিভ সোসাইটি রয়েছে, আছে কো-অপারেটিভ অ্যাক্ট ও তাদের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা। তবে তাদের সক্ষমতা নেই বললেই চলে। ছোট ও মাঝারি সাইজের ডেসটিনির মতো কত প্রতিষ্ঠান যে গ্রাম-গঞ্জে একই ধরনের কাজে নিয়োজিত, তা আমরা জানিও না। কো-অপারেটিভ এক ধরনের ক্ষুদ্র ঋণ দানকারী প্রতিষ্ঠান, যা ব্রিটিশ আমল থেকেই চালু রয়েছে। এ-সংক্রান্ত আইন ও তাদের নিয়ন্ত্রণও সেভাবেই রয়ে গেছে, পরিচালিত হচ্ছে মান্ধাতার আমলের নিয়ম অনুযায়ী। আইনের আড়ালে বা সব আইনের বাইরে থেকে সূক্ষ্মভাবে জালিয়াতি করছে এমএলএম কোম্পানিগুলো। একসময় এসব কোম্পানির পরিচালকরা ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবেন। এতে কোটি কোটি লোক হবে সর্বস্বান্ত।
এর প্রভাব অর্থনীতিতে অবশ্যই নেতিবাচক। এটা আমাদের ব্যাংকিং খাতের আমানত সংগ্রহকে বাধাগ্রস্ত করছে। অর্থ ব্যাংকে না গিয়ে এসব সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের কাছে চলে যাচ্ছে। ফলে অর্থের সদ্ব্যবহার হচ্ছে না। সরকারের উচিত, যত দ্রুত সম্ভব এ ধরনের যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ করে গ্রাহকের জমা করা অর্থ দ্রুত ফেরত দেয়া। এ জন্য তাদের ছয় মাস বা এক বছর সময় বেঁধে দেয়া যেতে পারে। এ সময়ের মধ্যে তারা নতুন করে আমানতও সংগ্রহ করতে পারবে না। এর দুটো ভালো প্রভাব হবে। প্রথমত. সাধারণ জনগণের সঞ্চয় ব্যাংকিং খাতে চলে আসবে। ফলে আমাদের ব্যাংকিং খাতে যে তারল্য সংকট বিরাজ করছে, তা দূরীকরণে সহায়তা করবে এটি। আমানতের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঋণপ্রবাহেও প্রবৃদ্ধি আসবে ব্যাংকিং খাতে, যা অর্থনীতির চাকাকে করবে আরও গতিশীল। অধিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে এটি আমাদের বড় প্রয়োজন এখন। দ্বিতীয়ত. জমির ফটকাবাজারি থেকে জাতীয় সঞ্চয়কে ফরমাল উত্পাদশীল খাতে আনা সম্ভব হবে। এটা আমাদের জন্য আরও মঙ্গলজনক। কারণ বর্তমানে ভূমির সমস্যা ও স্বল্পতা বাংলাদেশের উন্নয়নে সবচেয়ে বড় বাধা। জমির দাম বেড়েছে অবিশ্বাস্যভাবে। মামলা-মোকদ্দমাও বেড়েছে। সবকিছুর মূলে রয়েছে জমির অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি। একে ধরনের ফটকাবাজারি প্রতিষ্ঠান, জমি কিনে ফেলে রাখছে। তাদের প্রবণতা হলো, দাম বাড়লে সেটি বিক্রি করে দেয়া। এ স্পেকুলেশনের ফলে বাজারে কোনো বাসস্থানের জোগান আসছে না। আসছে শুধু সাইনবোর্ডসর্বস্ব ভূমির সরবরাহ। এদিক সেদিকে আমরা অনেক হাউজিং প্রকল্পের সাইনবোর্ড দেখছি। কিন্তু একটা ইটও বসছে না এসব প্রকল্পের কোথাও। বলা যায়, এ ক্ষেত্রে আমাদের সবার একটি মানসিক ও প্রক্রিয়াগত পরিবর্তন হয়ে গেছে। সবাই যেন জমিতে বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকে পড়ছি। এ পরিবর্তন থেকে বেরিয়ে আসতে এবং সমাজকে রক্ষা করতে হলে এখনই এ ধরনের বিনিয়োগের রাশ টেনে ধরতে হবে। এটা আমাদের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে। আমানত বৃদ্ধির মাধ্যমে সুদের হার কমবে এবং তারল্য সংকটের স্থায়ী সমাধানও হবে এর মাধ্যমে। নইলে আরও বেশি অর্থ ওই সব অনুত্পাদশীল খাতে চলে যাবে এবং আরও বড় অ্যাসেট বাবল তৈরি হবে। এতে আরও বড় রকমের ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে।
এ ক্ষেত্রে আরও উল্লেখ করতে হবে ব্যাংকবহির্ভুত আর্থিক প্রতিষ্ঠান তথা এনবিএফআইয়ের কথা। এ প্রতিষ্ঠানগুলো কিছুটা আমানত নিজেরা সংগ্রহ ও ঋণ গ্রহণ করে, যার বড় অংশই আসে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে। ব্যাংক থেকে নির্দিষ্ট সুদে ঋণ নিয়ে স্বল্প মার্জিন রেখে উদ্যোক্তাদের বা বিনিয়োগকারীদের তা সরবরাহ করা হয়। লিজিং অথবা হাউজিং কোম্পানিগুলোও এ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। এখানে প্রধান সমস্যা সোর্স অব ফান্ডিং বা অর্থের উত্স নিয়ে, যার মূলে রয়েছে আমাদের বন্ড মার্কেটের সীমিত পরিধি ও কার্যক্রম। অর্থায়নের স্বল্পতায় তারা বড় কোনো অবকাঠামো নির্মাণে সরাসরি বিনিয়োগও করতে পারছে না। অবকাঠামো নির্মাণের মতো কোনো ক্যাপাসিটিও তাদের ডেভেলপ করেনি। এ কারণে বাংলাদেশের বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণে অর্থায়নকারী পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ একটু সতর্ক হলে মধ্যমেয়াদি কার্যক্রম ও নন-ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব অনেকাংশে।
অধিক প্রবৃদ্ধি চাইলে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক, নন-ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন ও বীমা কোম্পানি উন্নয়নের দিকে সরকারকে দ্রুত নজর দিতে হবে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকব্যবস্থা উন্নত হয়েছে। কিছু দুর্বলতা তো থাকবেই। তবে তা নিয়ে বড় অভিযোগ নেই। সময়ের সঙ্গে কারিগরি সক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে সেটি কেটে যাবে বলেই প্রত্যাশা। বড় সমস্যা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের ক্ষেত্রে এবং তাদের ওপর ক্রমবর্ধমান দলীয় প্রভাব নিয়ে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো অনেকাংশে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকির বাইরে। এগুলো রেগুলেট করার দায়িত্ব অর্থ মন্ত্রণালয়ের থাকলেও তারা কার্যকরভাবে তা করতে পারছে, তা বলা যাবে না। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ব্যাংকিং বিভাগের কোনো ধরনের লোকবল ও কারিগরি দক্ষতা নেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে তদারকি করার মতো। এর প্রমাণ সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর শত শত কোটি টাকার অনিয়মের অভিযোগ। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় যে ধরনের পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তাদের ব্যাংকিং বিষয়ে অভিজ্ঞতা এবং আমানতকারীদের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা নিয়েও অনেক প্রশ্ন রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সাধারণ বাণিজ্যিক ব্যাংকের মতো প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পরিচালিত হবে। সরকার কেন তাদের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করবে এবং পরে ত্রাণকর্তা হিসেবে কাজ করবে? এতে অনিয়ম ও দলীয়করণ প্রশ্রয় পায়। মনে রাখা চাই— ব্যাংক, বীমা কোম্পানি ও এনবিএফআই পরিচালিত হয় জামানতকারীদের অর্থে। স্বার্থ চিন্তাভাবনায় রেখে দ্রুত সংস্কার আনতে হবে সমগ্র আর্থিক খাতে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ; নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)
http://www.bonikbarta.com/?view=details&menu_id=20&pub_no=77&news_id=8587