বাংলাদেশের ব্যাংকব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বেসরকারি ও বিদেশী ব্যাংকের কার্যক্রম শুরুর আগে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের অধিকারেই ছিল দেশের পুরো ব্যাংকি ব্যবসা। বেসরকারি ব্যাংকের গোড়াপত্তনের পর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের ব্যবসা ক্রমেই সংকুচিত হতে থাকে। এর মূলে কাজ করেছে সেবার মান। বেসরকারি ব্যাংকে উন্নত সেবার মান ও পরিবেশ গ্রাহককে সহজেই আকর্ষণে সমর্থ হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারি ব্যাংকের সংখ্যা ও শাখার বিস্তারে সংকুচিত হতে থাকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ব্যবসা। ১০০ শতাংশ থেকে আমানত পর্যায়ক্রমে নেমে আসে ৩০-৩৫ শতাংশে। সার্বিক আর্থিক খাত বিবেচনায় এটি একটি কাঠামোগত পরিবর্তন। তা সত্ত্বেও স্বীকার করতেই হবে, আমাদের অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকিং খাত এখনো একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের স্থিতিশীল কার্যক্রম আমাদের আর্থিক খাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো সঠিকভাবে পরিচালনা করতে না পারলে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা রক্ষা এবং অধিক প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে না।
নব্বইয়ের দশকে আমাদের দেশে আর্থিক খাতের সংস্কারের একটি বড় উদ্যোগ নেয়া হয়। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় এ উদ্যোগের ফলে আর্থিক খাত মোটামুটি একটি ভালো ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর সুফল আমরা এখনো ভোগ করছি। পরবর্তী কালে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংক— উভয় খাতেই আমানত ও ঋণের গুণগত মান বৃদ্ধি পায়। ব্যাংকিং খাতের সম্পদ ও বিনিয়োগের ওপর আয় (রিটার্ন অন অ্যাসেট অ্যান্ড ইকুইটি) আরও ভালো অবস্থায় উপনীত হয়। এতে দেশের ব্যাংকিং খাত লাভজনক হিসেবে পরিচিতি লাভ করে এবং বলা চলে মোটামুটি শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছে। ২০০৭-০৮ সালে বিশ্বমন্দায় অনেক দেশের ব্যাংকিং খাতে টালমাটাল অবস্থা বিরাজ করলেও আমাদের এখানে তার প্রভাব পড়েনি। অবশ্য এ ক্ষমতা এক দিনে অর্জিত হয়নি। এটি অর্জন করতে আমাদের দুই দশকেরও বেশি সময় লেগেছে। এ ক্ষেত্রে অনেকখানি এগিয়ে গেলেও অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের ব্যাংকিং খাতের শক্তি ও সামর্থ্য এখনো সীমিতই। আগের চেয়ে সবল হলেও অনেক ক্ষেত্রে যে আমাদের দুর্বলতা রয়ে গেছে, মাঝে মধ্যেই তা বিভিন্নভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। এ অর্জন ধরে রাখতে এবং সামনের দিকে এগিয়ে যেতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ক্ষেত্রে সংস্কারও আনতে হবে।
গত দু-তিন বছরে দেশের আর্থিক খাতে বেশকিছু ঘটনা ঘটেছে, যেগুলো নিয়ে অনেকের মতো আমরাও শঙ্কিত। উদাহরণস্বরূপ, শেয়ারবাজারে অস্বাভাবিক উত্থান-পতনের কারণে ব্যাংকিং খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া রিয়েল এস্টেটে মাত্রাতিরিক্ত বিনিয়োগের কারণেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ খাত। পাশাপাশি রিয়েল এস্টেট খাত তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেই। এ খাতে স্পেকুলেটিভ বিনিয়োগের পরিমাণ যে হারে বেড়েছে, তা শঙ্কা জাগায় বৈকি। এর বাইরেও একটি বড় শঙ্কার কারণ রয়েছে; তা হলো, আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কার্যক্রম। অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ব্যাংকিং খাত যে ক্ষতির শিকার হয়েছে এবং হতে যাচ্ছে, তা অবশ্যই বড় উদ্বেগের বিষয়।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটি আসে সরকার পরিবর্তনের সময়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পরিচালনায় দলীয় বিবেচনায় পরিচালনা পর্ষদ গঠন থেকে শুরু করে কর্মকর্তা নিয়োগ ও প্রমোশন দেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন গঠিত ব্যাংকিং বিভাগ সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মতান্ত্রিক কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। অতীতে সঙ্গত কারণেই ব্যাংকিং বিভাগ বিলুপ্ত করা হয়েছিল। সেটাকে নতুন করে পুনরুজ্জীবিত করায় অনেক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অবলম্বন করা হয়েছে পশ্চাদমুখী নীতি। এর মাধ্যমে বেশকিছু ক্ষমতা ব্যাংকিং ডিভিশনের আওতায় আনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে তৈরি হয়েছে দ্বন্দ্ব। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে এক ধরনের দ্বিতীয় শ্রেণীর ব্যবস্থা। দেশে বিদ্যমান সব ব্যাংকের তদারকির ভার ও যোগ্যতা উভয়ই রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। অন্যদিকে ব্যাংকিং ডিভিশনের ওই ধরনের যোগ্যতা নেই। জানা যায়, তদন্ত দূরে থাক, ব্যাংকব্যবস্থা ঠিকমতো জানা বোঝা ব্যক্তিরও সংকট রয়েছে এ বিভাগে। স্পষ্টত এ কাজে সক্ষম লোকবলও নেই তাদের। দ্বৈত শাসনের কারণেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে অনেক অনিয়মের ঘটনা ঘটছে, যা ব্যাংকিং খাতের জন্য সুখকর নয়। সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একাধিক ব্যাংকের বিভিন্ন দেশী ও বিদেশী শাখা থেকে ঋণ জালিয়াতি ও অনিয়মের যে খবরগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে, তাতে শঙ্কা জাগে বৈকি। এটি ঘটছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগের মধ্যে সামঞ্জস্যহীনতার কারণে— কে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক তদারক ও দেখভাল করবে?
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো কখনই দক্ষ ছিল না। এ কারণে তাদের একটা সংযত সীমার মধ্যে রাখা হতো আগে। আমানত সংগ্রহ করতে পারলেও তারা ইচ্ছামাফিক ঋণ দিতে পারত না। ইন্টারব্যাংক সিস্টেমে অন্য প্রাইভেট ব্যাংকের মাধ্যমে তাদের সংগৃহীত আমানত ঋণে পরিণত হতো এবং সেখান থেকে আয় করত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক। অতীতেও দেখা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক যখন ঋণ দেয়, সেটি অনেক ক্ষেত্রেই তারা ফেরত পায় না বা ফেরত আনতে পারে না। এ খাতে মন্দ ঋণের পরিমাণ বেসরকারি খাতের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। এর অন্যতম কারণ, বিভিন্ন পাবলিক লোকসানি প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ঋণ জোগানো এবং এদের মাধ্যমে সরকারের নীতি বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কুঋণ বা ভালো পারফর্ম না করার পেছনে এটিও একটি বড় কারণ। তবে অতীতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ব্যক্তি খাতের ঋণের প্রবাহ কমিয়ে ঝুঁকির পরিমাণ কিছুটা হলেও সহনীয় পর্যায়ে রাখা হতো।
সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রদানের নীতি শিথিল করায় ঘটে গেল হলমার্কের মতো ঘটনা— যেখানে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী প্রভাব খাটিয়ে অসদুপায়ে ব্যাংকের কর্মচারীদের সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ব্যাংককে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। রাষ্ট্রীয় ব্যাংকেই এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটে। শুধু ব্যাংকিং খাতই নয়, আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত অন্যান্য খাতেও এক ধরনের বিশৃঙ্খলা ও নৈতিক অবক্ষয় ঘটেছে মাত্রাতিরিক্তভাবে। এখানে লোকসান হওয়াটাই স্বাভাবিক। এমন পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণদান কার্যক্রম বড় আকারে শুরু করাটা কতখানি যৌক্তিক হয়েছে, তাও এক বড় প্রশ্ন। কেন করা হলো? এ প্রসঙ্গে সে প্রশ্নটিও আসবে। কারণ তাদের কর্মকর্তাদের গুণগত মানের উন্নতি হয়নি। মানের পরিবর্তন যদি হয়েই থাকে, সেটি হয়েছে নিম্নগামী। এটি আংশিকভাবে হয়েছে দলীয় রাজনৈতিক বিবেচনায় বোর্ড ও পরিচালনা পর্ষদ গঠনের মাধ্যমে। এসব বোর্ডের বেশির ভাগ সদস্যেরই ব্যাংকিং সম্পর্কে অভিজ্ঞতা নেই। সে ক্ষেত্রে এ ধরনের ব্যক্তি দ্বারা ব্যাংক চালানো হলে কার্যক্রমের মান অবশ্যই নিম্নগামী হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে হয়েছেও তাই। প্রশ্ন হলো, এখন কী করা উচিত? সরকারের উচিত এ অবক্ষয় ঠেকানো, যাতে হলমার্কের মতো কেলেঙ্কারি ভবিষ্যতে আর না হয়। দেখা যাচ্ছে মিথ্যা তথ্য দিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে যারা ঋণ নিয়েছে, বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা। অথচ ফৌজদারি আইনে তাদের গ্রেফতার করাটাই ছিল কাম্য।
হলমার্ক কেলেঙ্কারিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে করা যৌক্তিক হবে না। শুধু একটিই নয়, ছোটবড় এমন আরও অনেক ঘটনা এখনো রয়েছে আমাদের চোখের আড়ালে। আইসবার্গের (রপবনবত্ম) মতো আমরা শুধু ওপরেরটুকু দেখছি, নিচেরটুকু দেখছি না। সরকার দেখতে চাচ্ছেও না। কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা থাকলে এগুলো উদ্ঘাটন করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকারের উচিত, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় কম্প্রিহেনসিভ অডিট করানো এবং খতিয়ে দেখা, আসলে তাদের ঋণ কার্যক্রমের কোয়ালিটি কী রকম, আইন বা বিধি বহির্ভূতভাবে কী পরিমাণ ঋণ দেয়া হয়েছে, সার্বিকভাবে তাদের ঋণের পোর্টফোলিও এবং তার কোয়ালিটি কী? কী পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হতে চলেছে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো? এটি পর্যালোচনা সাপেক্ষে সরকার যদি শ্বেতপত্র তৈরি এবং তা পার্লামেন্ট বা জনসম্মুখে প্রকাশ করে, তাহলে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে। ভবিষ্যতে এ ধরনের কৌশল গ্রহণ করে কেউ যাতে অর্থ হাতিয়ে নিতে না পারে, সে পদক্ষেপও নিতে হবে। আশা করি সরকার সেটি করবে। এই আলোকে বলতে হবে, এ ক্ষেত্রে পদ্ধতিগতভাবে এগোনো উচিত। এটি সবার জন্যই ভালো। সরকার তার দোষ স্বীকার করে নিতে পারত। কিন্তু তা করেনি। ভুল তো হতেই পারে। তবে বিবেচনার বিষয় হলো— এর পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে, তা প্রতিরোধ করা।
সরকারের উচিত দ্রুত একটি রিভিউ কমিটি গঠন করে এ-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া। সরকার সে পথে না গিয়ে তড়িঘড়ি করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বোর্ডের চেয়ারম্যানদের মেয়াদ বাড়িয়ে দিয়েছে। যদিও বোর্ড এখনো পুনর্গঠিত হয়নি। আইনগতভাবে তা কতখানি সিদ্ধ, সে বিষয়ে মন্তব্য করব না। যদিও এটি নিয়েও এরই মধ্যে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলছেন, চেয়ারম্যানদের নিয়োগ দেয়ার ক্ষমতাসরকারের নেই; রয়েছে বোর্ডের। বোর্ড যেহেতু গঠন করা হয়নি সেহেতু চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া হবে কীভাবে? আমার কাছে মনে হচ্ছে, এটি একটি প্রক্রিয়াগত (ঢ়ত্ড়পবফঁত্ধষ) তুলনামূলকভাবে তুচ্ছ ব্যাপার। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যেসব বোর্ড বা চেয়ারম্যান তিন বছর ধরে কার্যক্রম চালিয়ে আসছে, দক্ষতার সুচিন্তিত পর্যালোচনা না করে সরকার তাদের মেয়াদ কেন বাড়াল? যুক্তি দেখানো হতে পারে, হাতে সময় কম ছিল। সে ক্ষেত্রে দুই মাসের জন্য তাদের মেয়াদ বাড়ানো যেত। এ সময়ে তাদের কার্যক্রমের পূর্ণ মূল্যায়নের পর সিদ্ধান্ত নেয়া গেলে ভালো হতো। এ সময়ের মধ্যে পর্যালোচনা সম্পন্ন করে তার আলোকে বোর্ডগুলোকেও পুনর্গঠন করা যেত। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এখনো এটি করা যায় অবশ্য। ওই ঘটনা অশনিসংকেত দিচ্ছে আমাদের। দলীয় বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা কর্মকর্তারা যা-ই করুক, তারা কি পার পেয়ে যাবে? আইন বা বিধিনিষেধ তাদের জন্য প্রযোজ্য নয় কি? আসলেই সরকার কি জনগণকে এ ধরনের বার্তা দিতে চায়? এটা কি দেয়া উচিত? তাহলে সংকট থেকে উত্তরণ কীভাবে হবে? কবে হবে? সরকারের কাছ থেকে জনগণ অবশ্যই আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় সুচিন্তিত এবং কঠোর কার্যক্রমই প্রত্যাশা করে।
লেখক: অর্থনীতিবিদনির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)
http://www.bonikbarta.com/index.php?archiev=yes&arch_date=04-10-2012&view=details&pub_no=105&cat_id=2&menu_id=20&index=0