রাজনীতির অসুখে বলি দেশের অর্থনীতি

রাজনীতির অসুখে বলি দেশের অর্থনীতি

আমাদের রাজনীতির মূলে আজ অসুখ দানা বেঁধেছে, আর তার শিকার গোটা অর্থনীতি।

২০১২ সালের ডিসেম্বরে প্রাত্যহিক জীবনের অনুসঙ্গে পরিণত হয়েছে ধ্বংসাত্মক সহিংসতার 9_5658হরতাল। দেশের সাধারণ নাগরিকের জীবন প্রায় পরাজিত দশার মাঝে বন্দি হয়ে শিল-পাটাতনের নিষ্পেষণে ওষ্ঠাগত। যদি ভুল না হয়, ধনীদের চেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠী এ পরিস্থিতির প্রধান শিকার, কারণ তাদেরই এ দুরবস্থার মাসুল বেশি গুনতে হয়। আমাদের জাতীয় অর্থনৈতিক ব্যয় মোটও কম নয়। ধর্মঘট এবং পণ্য ও মানুষের আন্দোলনে প্রতিরোধের কারণে আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষি ও অন্যান্য উপ-খাত বাদ দিয়েও কেবল এক দিনের হরতালে ক্ষতির পরিমাণ ২০০ মিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশী টাকায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৫৭ কোটি ৩০ লাখ (৭৮.৬৫ টাকা/ডলার)। এটি শুধু একটি আপেক্ষিক হিসাব— যথাযথ অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রকৃত চিত্র এটি নয়। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সংকোচনের পেছনে যে ধরনের স্বাভাবিক প্রতিকূল পরিবেশ কাজ করে, প্রকৃতপক্ষে সেগুলো দায়ী নয়। এ হিসাবে দেখা যায়, এক অর্থবছরে যদি ১০ দিন হরতাল হয়, তবে একটি সাধারণ হিসাব অনুযায়ী অর্থনীতিতে ক্ষতির পরিমাণ ২ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ, যা এক অর্থবছরের অর্জিত জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ এবং এটা পদ্মা সেতুর জন্য প্রত্যাশিত ঋণের অর্থের চেয়ে সামান্য কম। এটা বলার পরও পাঠকদের মনে রাখা উচিত, বাংলাদেশী শ্রমিক ও উদ্যোক্তারা এ বিপুল ক্ষতির পরিমাণ কমানোর জন্য হরতালকে ঘিরে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব কমাতে সম্ভাব্য অন্য উপায় খোঁজে।

অনেক আগেই বাংলাদেশ তার হতাশাজনক অবস্থান থেকে  বেরিয়ে এসেছে এবং বিশ্বের সভ্য দেশগুলোর মাঝে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে নিজের অবস্থান প্রায় আসন্ন। উন্নয়ন সত্ত্বেও দারিদ্র্য আর নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে যুদ্ধে এখনো বিজয় অর্জিত হয়নি। দিন চলে যায়, সম্ভাবনাময় দরিদ্র দেশ হিসেবে এর পরিচিতি এখনো মিলিয়ে যায়নি। উৎপাদন শিল্পে শক্তিশালী অবস্থার জন্য দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা আজ স্বীকৃত এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে আরো সুযোগ আসছে। গোল্ডম্যান স্যাকস ও জেপি মরগানের মতো শীর্ষ স্থানীয় আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দৃষ্টিতে বিনিয়োগের ক্ষেত্র হিসেবে বিআরআইসিএস (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা) এর পরই ‘ফ্রন্টিয়ার-ফাইভ’ নামক সামনের সারির পাঁচটি দেশ ও ‘নেক্সট-ইলেভেন’ নামক সম্ভাবনাময় অর্থনীতির ১১টি দেশের তালিকায় বিবেচনা করা হয়। এ অর্থনৈতিক সুযোগ হেলায় হারানো কি আমাদের উচিত হবে?

কিন্তু রাজনৈতিক অসারতার জন্য অর্থনৈতিক অগ্রগতি হচ্ছে না। ১৯৯১ সালে বহুদলীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের পর থেকে বিগত দুই দশকের চেয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অগ্রগামিতা প্রমাণ করে যে, গণতন্ত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বাধা নয়। কিন্তু এটা কেবল তখনই সম্ভব যখন একটি সাধারণ লক্ষ্যকে সামনে রেখে গণতন্ত্র জবাবদিহিতা আর দায়িত্বশীলতার হাত ধরাধরি করে হাঁটে। নির্বাচন মৌসুম যতই এগিয়ে আসে, রাজপথে রাজনৈতিক সংঘাত একটি অব্যর্থ নিয়মে পরিণত হয়েছে, অন্তত অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বলা যায়, আত্মঘাতী রাজনীতি নিজের পায়ে কুড়াল মারার শামিল। গণতন্ত্রে বিজয়ী দল হিসেবে যে চর্চা আমরা করি, তার নির্মম মাশুল অর্থনীতিকে দিতে হয়। এমনকি পদ্মা সেতু প্রকল্প রাজনীতির আবর্তে পড়ে ব্যাপারটি সমাধানে সহায়ক না হয়ে উল্টো আরো জটিল আকার ধারণ করে।

দৃশ্যপটে ২০১২

দেশীয় অর্থনীতি ও রাজনৈতিক কর্মসূচির উত্থান-পতনের কারণে ২০১২ সালের পর্দা ওঠার পর থেকে জনমানুষের মনে শঙ্কা আর উত্তেজনা কাজ করে। বছরজুড়ে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি কিছুটা চাপের মধ্যে ছিল। ব্যাপক অর্থে, বেসরকারি খাতে অল্প বিস্তার ক্ষতি হলেও দক্ষতার সঙ্গে সামষ্টিক অর্থনীতির চাকা সচল রাখা সম্ভব হয়েছে। এর মাঝে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে ঘটে যায় সবচেয়ে দুঃখজনক অধ্যায়। এ সমস্যার সমাধান হলে একদিকে যেমন দেশীয় বিনিয়োগের অচলাবস্থা নিরসন হতো, পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে একধাপ এগোনো যেত। তৈরি পোশাক শিল্প বিশ্বদরবারে তার সাফল্যের গল্পগাথা অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু ভবিষ্যতের চিন্তায় এ সন্তোষজনক খাত নিয়েও আমাদের দুশ্চিন্তার যথেষ্ট অবকাশ থেকে যায়। ২০১১ সালের অস্থিরতার পর বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে যে অশুভ শক্তির আঘাত আসে, সেখান থেকে উত্তোরণের কোনো ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত এখনো অস্পষ্ট।

আমাদের পলিসিতে বৈশ্বিক উন্নয়নের যেসব বৈশিষ্ট্য নিয়মিত ও জোরালোভাবে থাকা উচিত, বাস্তবে তার খুব কমই চোখে পড়ে। ফলে বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধনশীল আন্তঃসম্পর্কের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের অর্থনীতির পক্ষে এ আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিকে ঠেলে শক্ত অবস্থায় পৌঁছানো বেশ দুরূহ। ইউরোপীয় অঞ্চল এর মধ্যে তাদের সংকট কাটিয়ে উঠেছে। আইএমএফ (ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ড) তাদের রিপোর্টে ২০১৩ সালের বিশ্ব অর্থনীতির নিম্নমুখী চিত্র তুলে ধরেছে। অক্টোবর, ২০১২-এর রিপোর্টে তারা উল্লেখ করে, ২০১৩ সালের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির বড় ধরনের সংকোচন (যদি অর্থনীতির সংকট কাটিয়ে উঠতে না পারে) ‘বিশ্ব অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য প্রধান হুমকিস্বরূপ।’ সেখানে আরো বলা হয়, ওয়াশিংটনের এ দীর্ঘসূত্রী অচলাবস্থা মার্কিন অর্থনীতির পুনরুদ্ধারকেও থামিয়ে দেবে যার ‘ভয়ঙ্কর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পুরো বিশ্বকে ভোগ করতে হবে।’ এদিকে ইউরোপীয় অঞ্চলের কার্যক্রম সাপ্তাহিক অর্থনীতি নিয়ে চলা তোরজোরের অসারতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এমনকি আইএমএফ পরে ঘাটতি ও ঋণের গতিরোধ করার প্রতি নজর দেয়। আর এভাবে গ্রিস, স্পেন ও পর্তুগালের মতো দেশগুলোর অবরুদ্ধ অর্থনীতির জন্য আরো সময় ও উদারতা দেখানো হয়। ইউরোপে বার্ষিক ঋণ কমানোর নীতি (fiscal austerity) যাই হোক, সেটা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সুখকর হয় যখন কিছু দেশের এক-চতুর্থাংশ শ্রমশক্তির সাশ্রয় হয়। আইএমএফ তাদের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক অক্টোবর, ২০১২তে জানায়, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এ উন্নয়ন সামান্য ভূমিকা রাখে। সেখানে দেখানো হয়, ২০১২ সালের ৩.৩ শতাংশ ও ২০১৩ সালের ৩.৬ শতাংশ বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ২০১২ সালের এপ্রিলের তুলনায় কম। এখানে দুটি গুরুত্বপূর্ণ অনুমান বিবেচ্য: ইউরোপীয় অঞ্চলে আর্থিক অবস্থাকে সহজ করতে বেশকিছু পলিসি নেয়া হবে এবং এ পলিসি সামনের বাজার অর্থনীতিকে সহজ করে সেটাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবে। উদ্ভূত বাজার অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি সূচকেও এরই মধ্যে স্থবিরতা পেয়ে বসেছে, এক্ষেত্রে ব্রাজিল, চীন ও ভারতের কথা বলা যায়। বিশ্বব্যাপী দুর্বল অর্থনীতির পারিপার্শ্বিক এ পরিবেশ বাংলাদেশের অর্থনীতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘ফিসক্যাল ক্লিফ’-এর (২০১২ সালের শেষ দিকে ওবামা প্রশাসন প্রণীত কর-সংক্রান্ত পলিসি) সংযুক্তিতে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকা মার্কিন অর্থনীতি যদি বছরের শেষে এসেও সমাধানের পথে না যায়, তবে সেটা মোটেই সুখকর ফল দেবে না। অন্যদিকে ইউরোপীয় অঞ্চলের বাজার অর্থনীতিতে তা উল্টো ফল আনবে। মার্কিন অর্থনীতির উন্নয়ন পুরো বিশ্বকে প্রভাবিত করে। যদিও ওয়াশিংটনের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় কোনো চুক্তি না থাকলেও বিশ্ব অর্থনীতির অংশ হিসেবে বাংলাদেশেও এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে আমাদের রফতানির ক্ষেত্রে তা অনেক বেশি প্রযোজ্য। তাই সুদূর আমেরিকায় যা হয় আমাদের জাতীয় আয় ও কর্মকাণ্ডে তার একটা রেশ থাকে।

এত কিছুর মাঝেও প্রথমবারের মতো আমাদের জন্য কিছু ভালো খবর গেল জনপ্রিয় ব্রিটিশ ম্যাগাজিন, দ্য ইকোনমিস্টে। এত দিন যেখানে তাদের চোখে কেবল বাংলাদেশের নেতিবাচক খবরগুলোই চোখে পড়ত, সেখানে এবার তাদের দেয়া রিপোর্টে উঠে এসেছে, গত দুই দশকে মানবকল্যাণ সূচকে বাংলাদেশের অস্বাভাবিক উন্নয়ন হয়েছে। পাশাপাশি আমাদের বেহাল রাজনীতি ও দুর্বল প্রবৃদ্ধির চিত্র সেখানে ফুটে উঠেছে। বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দেয়া তথ্যমতে, বৈশ্বিক অচলাবস্থার মাঝে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক প্রবৃদ্ধি হার ঝিমিয়ে পড়লেও সেটা গড়পরতা দক্ষিণ এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের চেয়ে এগিয়ে। যদিও সামনের দিনগুলোয় আশাবাদী হওয়ার খুব বেশি সুযোগ নেই।

লক্ষ্য থেকে দূরে প্রবৃদ্ধি অর্জন

রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নয়ন ছাড়া ২০১৩ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি অর্জনের সুষ্ঠু পরিকল্পনার বাস্তবায়ন কখনো সম্ভব নয়। ২০১১ সালে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ২০১২ সালে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ অর্জিত প্রবৃদ্ধির ভিত্তিতে ২০১৩ অর্থবছরে সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধি নির্ধারণ করা হয়েছিল ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। বর্তমান অর্থনৈতিক দৃশ্যপটে ঘন ঘন হরতালের ওপর খাতওয়ারি প্রবৃদ্ধি অনেকাংশে নির্ভর করে। হরতাল এখন অন্যতম প্রভাবকের ভূমিকায় এবং হরহামেশা রাজনৈতিক সংঘর্ষের কারণে ২০১৩ সালের নির্ধারিত লক্ষ্য প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশকেও সুদূর পরাহত মনে হয়। ফলে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুসারে নির্ধারিত লক্ষ্য ৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। অথচ গত দুই অর্থবছরেও প্রবৃদ্ধি ছিল ৬-৬.৫ শতাংশ।

উল্লেখ্য, উৎপাদন ক্ষমতার চেয়ে শ্রম ও পুঁজি দ্বারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নির্ধারিত হয়। এ অবস্থায় জিডিপির অংশ হিসেবে দীর্ঘসময় ধরে স্থির থাকায় কেবলমাত্র জিডিআই (মোট দেশীয় বিনিয়োগ) বৃদ্ধির মাধ্যমে জিডিপির ঊর্ধ্বমুখিতা বজায় রাখা সম্ভব। বিনিয়োগের এ অচলাবস্থা কাটাতে অর্থনীতির ঊর্ধ্বমুখী পথযাত্রা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অন্যথায় ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এখানে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে ৩০ শতাংশের ওপর বিনিয়োগ প্রয়োজন। ফলে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী বছরগুলোর মাঝে বিনিয়োগের অনুপাত (ইনক্রিমেন্ট ক্যাপিটাল আউটপুট রেশিও) হতে হবে প্রায় ৩:৮। নব্বই দশকে গড় প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৮ শতাংশের বিপরীতে ১৯৯৫ সালে বিনিয়োগের হার ছিল ১৭ শতাংশ এবং পরবর্তী দশকে গড় প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৮ শতাংশ করতে ২০০০ সালে বিনিয়োগের হার ২৩ শতাংশে উন্নীত করা হয়। গত তিন অর্থবছরে এ হার জিডিপির ২৪ শতাংশের মাঝেই ঘুরপাক খায়। তাত্ত্বিকভাবে ও বাস্তবমতে, প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বিনিয়োগের অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক। অর্থনীতির এ অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠতে না পারলে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা অনুসারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭-৮ শতাংশে নিয়ে যাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আর ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যআয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন স্বপ্নতেই থেকে যাবে।

বিনিয়োগের অচলাবস্থা ভাঙতে পাবলিক বিনিয়োগ নয়, বরং প্রাইভেট বিনিয়োগ দায়ী। কারণ গত তিন অর্থবছরে পাবলিক বিনিয়োগ ছিল যথাক্রমে ৫ শতাংশ, ৫ দশমিক ৬ ও ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। অথচ এ সময়ে প্রাইভেট বিনিয়োগ ১৯ শতাংশের মাঝে ঘুরপাক খায়। বিশেষত এ সময়ে দুর্বল অর্থ ব্যবস্থা ও প্রাইভেট বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধির গড় ২৫ শতাংশে স্থির থাকায় প্রাইভেট বিনিয়োগ শক্তিশালী হতে পারেনি। এখন প্রশ্ন, প্রাইভেট বিনিয়োগ কোথায় গেল? চলতি প্রেক্ষাপটে বলা যায়, প্রাইভেট বিনিয়োগের একটা বড় অংশ চলে যায় শেয়ার বাজারে, যেখানে খুব সহজে আর্থিক লেনদেন করা যায় এবং অন্য আরেকটি খাত হচ্ছে রিয়েল এস্টেট।

নিঃসন্দেহে বলা যায়, দেশের বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অবস্থা যথেষ্ট সহায়ক নয়। তবুও এক্ষেত্রে ব্যয়বহুল কিছু রেন্টাল বিদ্যুৎ প্লান্ট স্থাপনের জন্য কমিশন ধন্যবাদ পেতেই পারে। কারণ ২০১০ থেকে ২০১২ সালের জুলাই পর্যন্ত মাত্র আড়াই বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৯ সালে যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো ৪ হাজার ২ মেগাওয়াট, সেখানে বর্তমান সময়ে তা দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৩৩০ মেগাওয়াটে। অন্যদিকে গ্যাসের চাহিদা ও জোগানের মধ্যে বিশাল তারতম্য বিরাজ করছে। আবাসিক এলাকা ও ব্যবসা খাতে একই সঙ্গে গ্যাস সংযোগ দেয়া হলেও শিল্প খাতে প্রতি বছর গ্যাসের চাহিদা ১৩ শতাংশ করে বেড়ে চলে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় দুর্বল পরিবহন অবকাঠামো। সব মিলিয়ে বিনিয়োগের প্রতিকূল পরিবেশ বিনিয়োগের ধীরগতিকে জিইয়ে রাখছে।

তার পরও চলতি প্রবৃদ্ধি দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক, যেটাকে অবজ্ঞা করা চলে না। স্বাধীনতার পর থেকে দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের অগ্রগতি অবশ্যই প্রশংসনীয়। বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় তেমন চিত্রই ফুটে ওঠে। গত দশকে যেখানে দারিদ্র্য সীমা ছিল ৪৮ দশমিক ৯ শতাংশ, সেখানে ২০১০ সালে দারিদ্র্যের হার কমে দাঁড়ায় ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। এ হিসাবটি কেবল আংশিক। কারণ ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। যদিও বাংলাদেশের এখনো প্রায় সাড়ে ৪ কোটি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করছে। মাত্র ১ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পেলে প্রায় দেড় কোটি মানুষ দারিদ্র্য সীমা থেকে উঠে আসতে পারবে, যারা হয়ত স্নাতক পাস করতে পারত। কিন্তু হরতালের কারণে সেই পথে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। তাই হরতালের কারণে সৃষ্ট আমাদের মানবিক ও অর্থনৈতিক ব্যয়ের হিসাব করা জরুরি।

সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা প্রতিস্থাপন

দেশীয় ও বৈদেশিক পাবলিক ঋণ এবং আর্থিক অবচয় সতর্ক সীমার মাঝে রেখে রাজস্ব খাত ও ব্যয়ের যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে গত দুই দশকে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সার্বিক অবস্থা সন্তোষজনক ছিল। ২০১১ সালের শেষ দিকে প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে সামষ্টিক অর্থনীতির কয়েকটি সূচকে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়, যার ফলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়ে। যেমন— ১. মুদ্রাস্ফীতির অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, যা দুই অঙ্কের সীমা অতিক্রম করে, ২. বাজেটে ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ প্রকল্পের পেছনে ভর্তুকি বিল দ্রুত বেড়ে যাওয়া ও পাবলিক প্রতিষ্ঠানের পেছনে অবচয়ের মাত্রা বৃদ্ধি, ৩. পুঁজির অন্তর্মুখী প্রবাহ হ্রাস না পেয়ে বাণিজ্য খাতে খরচের পরিমাণ ভারসাম্যহীনতা বৃদ্ধি, ৪. টাকার মূল্য হ্রাস, ৫. শেয়ারবাজারে ধারাবাহিক অস্থিরতা এবং ৬. বৈদেশিক অর্থায়নে স্থবিরতা।

এত কিছুর পরে ভালো খবরটা হলো, ২০১২ সালের শেষ নাগাদ সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা আবার ফিরে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গৃহীত যথাযথ পদক্ষেপের কারণে দেশীয় চাহিদা পূরণ করে মুদ্রাস্ফীতি সংযত রাখা সম্ভব হয়েছে। ২০১২ সালের ১২ অক্টোবরের মাঝে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত লক্ষ্য অনুযায়ী মুদ্রাস্ফীতি একক অঙ্কে নেমে যায়। আর্থিক শৃঙ্খলার পাশাপাশি বেসরকারি খাতে ধীরগতির বিনিয়োগ আমদানি চাহিদা দমিয়ে ব্যয় হিসাবে স্থিতিশীলতা আনয়নের ফলে ২০১২ অর্থবছরে ঘাটতি ৪ শতাংশের মধ্যে থাকে। এর মধ্যে রফতানি খাতে উত্থান ধীরগতিতে হলেও রেমিট্যান্সে আশাতীত প্রবৃদ্ধি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে সন্তোষজনক অবস্থায় নিয়ে যায় এবং নামমাত্র বিনিময় হারও একটা পরিপুষ্ট অবস্থায় চলে আসে।

অর্থনৈতিক উন্নয়ন মূল্যায়ন

সাম্প্র্রতিক বছরগুলোয় সামষ্টিক অর্থনীতিতে প্রধান কর রাজস্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ধারাবাহিকভাবে তিন বছর ধরে অর্জিত করের পরিমাণ বাজেটে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যায়। দেশীয় উৎপাদন ও ব্যবহারে আমদানি থেকে প্রাপ্ত কর নির্ভরতায় কৌশলী পরিবর্তন সত্ত্বেও রাজস্ব খাতে এটি একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য। অভ্যন্তরীণ উত্স; বিশেষ করে ভ্যাট ও প্রত্যক্ষ কর থেকে অর্জিত রাজস্ব খাতে এ সম্ভাবনাময় সাফল্য একদিকে যেমন আমদানি করের ওপর নির্ভরতা হ্রাস করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে, অন্যদিকে দেশীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করে।

ভ্যাট ও ইনকাম ট্যাক্সের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা কিছুটা উচ্চাকাঙ্ক্ষী হলেও উভয় খাত থেকেই গত তিন বছরে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়। সম্প্রসারিত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হলেও নিবিড় পর্যবেক্ষণে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়, কর সংগ্রহে গৃহীত সংস্কার ও নতুন পদ্ধতি এ সাফল্যের পেছনে মূল ভূমিকা পালন করে। সিংহভাগ ভ্যাট রাজস্ব আসে দেশীয় উত্স থেকে। এখানে মোট রাজস্বের ৬২ শতাংশ ভ্যাট থেকে আসে। তিন বছর ধরে দেশীয় খাত থেকে গড়পড়তা ভ্যাটের হার ২৫ শতাংশ, যা কিনা দেশীয় ভোগ্যপণ্যের দ্বিগুণ প্রসারণ ইঙ্গিত করে। ফলে করারোপযোগ্য পণ্যের ওপর আয়কর ধার্যের মাত্রা নিশ্চিতভাবেই বেড়েছে। ফলে ২০০৭-২০১২ অর্থবছরে কর সংগ্রহের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক ৬ শতাংশ, যেখানে এ সময়কালে করারোপযোগ্য পণ্যের হার বেড়ে দাঁড়ায় ১২ দশমিক ৭ শতাংশ। আয়কর সংগ্রহ পদ্ধতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এটুকু বলা যায় যে, আয়করের উত্স নির্ণয় গুরুত্বপূর্ণ হলেও ফিরতি আয়কর থেকে প্রাপ্ত রাজস্বের গুরুত্ব আরো বেশি। ২০০৪ সালের আয়করের উত্স ৪৮ দশমিক ২ শতাংশ থাকলেও ২০১০ সালে তা আশঙ্কাজনক হারে কমে দাঁড়ায় ৬১ দশমিক ৫ শতাংশ। ফিরতি কর দেয়ার ক্ষেত্রে উন্নয়নের মধ্য দিয়ে কর প্রদানের হার বাড়লেও বিদ্যমান উত্স হ্রাস অবধারিতভাবেই কর আদায়ে প্রশাসনের দুর্বলতা ইঙ্গিত করে। বাংলাদেশে কর আদায়ে বিদ্যমান কাঠামো অনেক বেশি সেকেলে এবং এটা ব্যবস্থাপনার দেউলিয়াত্ত প্রমাণ করে।

সাম্প্রতিক অর্জন সত্ত্বেও ষষ্ঠ পঞ্চমেয়াদি বার্ষিক পরিকল্পনা অনুসারে কর রাজস্ব অর্জনে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা এখনো হুমকির মুখে। দেশীয় উৎপাদন ও বাণিজ্য কর অর্জনে যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকলেও কর নীতিতে যথাযথ সংস্কার ও কর আদায় ব্যবস্থায় আধুনিকায়ন না হলে সেটা আদৌ সম্ভব নয়।

ব্যয়বহুল রেন্টাল বিদ্যুৎ প্রকল্পেরর পেছনে ভর্তুকি বিল দ্রুত বৃদ্ধির কারণে সামষ্টিক অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়লেও ২০১২ অর্থবছরে সার্বিক অর্থনীতি শক্তিশালী অবস্থায় ছিল। এমনকি বিদেশী অর্থায়ন মোট জিডিপির মাত্র ১ শতাংশেরও নিচে রাখা সম্ভব হয়েছে এবং ৪ শতাংশ দেশীয় অর্থায়নে ঘাটতি ৩ দশমিক ৩ শতাংশের বেশি হয়নি, যেটা ২০১১ সালে ছিল ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। সবচেয়ে দুশ্চিন্তার বিষয়, একদিকে লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি, অন্যদিকে দেশীয় অর্থায়নে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণগ্রহণ। ২০১৩ সালের বাজেটে ঘাটতি ৫ শতাংশে রাখার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা ২০১২ সালের ঘাটতি সীমা অতিক্রম করার আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে। প্রত্যাশিত বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্প ৫৫০ বিলিয়ন টাকা ধরা হয়, যার মধ্যে বৈদেশিক উত্স থেকে আসে ২ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং এ অর্থ দিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নের কোনো সুযোগ নেই। পাশাপাশি দেশীয় খাত থেকে অর্থায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংকঋণের ওপর অধিক নির্ভরতার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংককে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে অর্থ-সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনা কৌশল নির্ধারণে যথেষ্ট বেগ পেতে হতে পারে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য

টানা দেড় বছর উচ্চ মূল্যস্ফীতি বজায় থাকার পর ২০১২ সালের অর্ধেক সময় পার হওয়ার পর অবস্থার উন্নতি হয়। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর নাগাদ মূল্যস্ফীতি গিয়ে পৌঁছে ১২ শতাংশে এবং ২০১২ সাল পর্যন্ত পরপর দুই বছর ধারাবাহিকভাবে গড় মূল্যস্ফীতি বাজেটে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রাকে অতিক্রম করে। কিন্তু ২০১২ সালের প্রথম থেকেই মূল্যস্ফীতির চাপ কিছুটা কমতে থাকে এবং মূল্যস্ফীতির এ নিম্নগামিতায় সহায়ক ভূমিকা রাখে সস্তা মূল্যের খাদ্যদ্রব্য ও খাদ্যদ্রব্য ছাড়া অন্যান্য পণ্য। বছরের মাঝামাঝি সময়ে এসে মূল্যস্ফীতি একক অঙ্কের ঘরে নামে (৯ শতাংশের নিচে)। এর পেছনে কাজ করে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যের স্থিতিশীলতা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের আঁটসাঁট অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা। বছরের শেষ দিকে মূল্যস্ফীতির সবগুলো চলক নিয়ন্ত্রণে এসে যায়। ২০১২ সালের অক্টোবরে মূল্যস্ফীতির হার ৭ দশমিক ২ শতাংশে এলে কিছুটা স্বস্তি আসে। (In April 2013 point to point inflation was 7.92, food 8.57, non-food 6.81.) এ সময় খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৬ শতাংশে, যা কিনা প্রায় বছরজুড়ে ১২ শতাংশের ওপর ছিল। মূলত দুই বছর ধরে ফসলের বাম্পার ফলন ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য মূল্যের স্থিতিশীলতার কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে। খাদ্যদ্রব্যের এ উল্লেখযোগ্য মূল্যহ্রাস নিঃসন্দেহে ইতিবাচক উন্নয়নের ইঙ্গিত দেয়। বর্তমান মূল্যস্ফীতি নিম্নআয়ের মানুষের জন্য ২০১১ সাল অপেক্ষাকৃত অধিক সহনশীল। অখাদ্য দ্রব্যের মূল্যস্ফীতি ২০১১ সালের দ্বিতীয় অংশ থেকে বাড়তির দিকে এবং বর্তমানে এর অবস্থান ১০ শতাংশের ওপর। ২০১০ ও ২০১১ সালে খাদ্যদ্রব্যের উচ্চ মূল্যের প্রভাব হ্রাস করতে এ অবস্থা আংশিক সহায়ক হলেও এর পেছনে প্রধানত কাজ করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মূল্যের ঊর্ধ্বমুখী সমন্বয়। ফলে অখাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বগামীই থেকে যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গৃহীত পদক্ষেপের কারণে মূল্যস্ফীতি দেশীয় চাহিদার সীমা অতিক্রম করে না। ২০১১ ও ২০১২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরি পলিসি স্টেটমেন্টে পরোক্ষভাবে অর্থ সরবরাহ হ্রাসের প্রয়োজনীয়তার কথা উঠে এলেও ২০১১ সালের বিবৃত পলিসির সঙ্গে এর সাযুজ্যতা ছিল না। কার্যত ২০১১ সালের শেষাংশ (২০১২ অর্থবছর) থেকে প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধির ওপর চাপ বেড়ে যায়, কিন্তু প্রাথমিকভাবে অর্থ-সংক্রান্ত যথাযথ কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ের অভাবে অর্থ সরবরাহ ততটা কমেনি। ২০১১ সালের শেষ দিকে অর্থ-সংক্রান্ত কৌশল অনুসারে অর্থ সরবরাহ কমতে থাকে। এর ফলে একই সঙ্গে মূল্য ও বিনিময় হার উভয় ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা আসে।

সামনের মাসগুলোয় মূল্যস্ফীতি আরো অনুকূলে আসবে বলে আশা করা যায়। অর্থ সরবরাহ বৃদ্ধির হার স্বাভাবিকভাবেই মূল্যস্ফীতির হারকে প্রভাবিত করে। গত এক বছরের পরিমিত অর্থব্যবস্থা চলতি মূল্যস্ফীতিকে সামনের এক-দেড় বছর পর্যন্ত ধরে রাখতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। বাজারে অর্থ সরবরাহ বৃদ্ধির হার যুক্তিসঙ্গত স্তরে রাখার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক যথেষ্ট মনোযোগী। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে রিজার্ভ মানি প্রবৃদ্ধির হার ১০ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল, যা মোটেও সন্তোষজনক নয়। এ পরিস্থিতি আগামী কয়েক মাস অর্থ সরবরাহ বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে। তেলসহ আন্তর্জাতিক খাদ্যদ্রব্য ও পণ্যের মূল্য গত এক বছর ধরে স্থিতিশীল আছে। আইএমএফের (ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ড) স্থির প্রবৃদ্ধি পর্যবেক্ষণে ওইসিডি (অরগানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) ও ইএমই (এমারকো গ্রুপ ইনকরপোরেশন) নামক সংগঠনভুক্ত দেশগুলোর জন্য পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে পরামর্শ দেয়া হয়। অখাদ্য পণ্যের মূল্য অনেকাংশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ওপর নির্ভর করে। ক্ষুদ্র ও রেন্টাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের ওপর আমাদের নির্ভরতার কারণে বিদ্যুতের মূল্য স্থির রাখা বেশ দুঃসাধ্য কাজ।

মোট কথা, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য স্থিতিশীলতা ও দেশীয় অর্থব্যবস্থায় অস্বাভাবিক কিছু না হলে ২০১৩ সালের শেষে মূল্যস্ফীতির হার শতাংশে নেমে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আর সেটা হতে পারে বাংলাদেশের ইতিহাসে মুদ্রাস্ফীতিতে একটি মাইলফলক।

রফতানি চিত্র: থমকে দাঁড়ানো অগ্রগতি

২০১০ সালে জিডিপিতে বাণিজ্যের হার ছিল ৩৭ শতাংশ। ২০১১ সালে আমদানি ও রফতানি হার বেড়ে যথাক্রমে ৪২ শতাংশ ও ৩৯ শতাংশ হওয়ায় বাণিজ্যের হার এক লাফে বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭ শতাংশে। এটা স্পষ্টভাবে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের ভদ্রোচিত উপস্থিতি ও দেশের অর্থনীতিতে বাণিজ্যের শক্ত অবস্থান জানান দেয়। ২০১২ সালে আমদানি-রফতানি উভয় ক্ষেত্রে ৫-৬ শতাংশ বৃদ্ধি সত্ত্বেও অগ্রগতি থমকে দাঁড়ায়। আমদানি যদি রফতানি চিত্রের পূর্বাভাস বাহক হয়, তবে ২০১৩ সালের প্রথম অংশে আমদানির প্রকৃত অবস্থা (৪ শতাংশ হ্রাস) ও এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খোলার পরিসংখ্যান (৬ শতাংশ হ্রাস) মোটেও সন্তোষজনক নয়। রেডিমেড গার্মেন্ট ও নন-রেডিমেড গার্মেন্ট উভয় ধরনের পণ্য রফতানিতে মন্থরগতির প্রতিফলন আমদানিতেও দৃশ্যমান হয়।

রফতানির হতাশ অবস্থা সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ে এবং এর পেছনের কারণটি অবশ্য যৌক্তিক। ইউরোপীয় অঞ্চলে  সংকটের প্রভাব স্বভাবতই বাংলাদেশে পড়বে। কারণ আমাদের রফতানির ৫১ শতাংশ পণ্য কিনে ইউরোপীয় অঞ্চলের দেশগুলো। আর ইউরোপীয় অঞ্চলের সংকট খুব দ্রুত সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

মোটকথা, এ পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তবুও বিশ্ব অর্থনীতির উত্থান-পতন সত্ত্বেও বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের খাপ খাইয়ে নেয়াটা ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলজনক। বিস্তৃত বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রবেশ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশী পণ্যের বাজার আরো প্রসারিত করে। ফলে বাংলাদেশের জন্য একদিকে যেমন চাকরির বাজার উন্মুক্ত হয়, তেমনি দেশীয় অর্থনীতি সম্প্রসারণের সুযোগ সৃষ্টি হয়। বলে রাখা ভালো, প্রতি বছর আমাদের শ্রমবাজারে যুক্ত হয় ২০ লাখ মানুষ এবং বেকারত্ব সমস্যা এখনো আমাদের জন্য বিষফোঁড়া। তাই অতিরিক্ত শ্রমশক্তি কাজে লাগাতে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল প্রণয়নের মাধ্যমে আমাদের রফতানিনির্ভরতা ও রফতানি প্রতিযোগিতায় যোগ্যতা নিশ্চিত করার চেষ্টা অব্যাহত রাখা উচিত।

উপযুক্ত আলোচনা সাপেক্ষে বলা যায়, ২০১৩ সালে রফতানি চিত্র ঊর্ধ্বমুখী করতে একমাত্র উপায় হলো দুটি বৈশ্বিক সংকটের ইতিবাচক সমাধান নিশ্চিত করা। সংকট দুটি হলো— ১. আমেরিকার করহার বৃদ্ধি ও সরকারি ব্যয় হ্রাস (ফিসক্যাল ক্লিফ); এবং ২. ইউরোপীয় অঞ্চলেও ঋণসংকট। ২০১১ সালে আমরা দেখেছি, ওইসিডিভুক্ত দেশগুলোর কিছুটা আগ্রহের কারণে রফতানি খাতে আমাদের ব্যাপক লভ্যাংশ আসে। উদীয়মান বাজার অর্থনীতিতে আমাদের প্রধান রফতানি গ্রাহকরা যুক্ত হলেও তারা এখানো ওই সংগঠনভুক্ত নয়।

রেমিট্যান্স অর্জনে সাফল্য: বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে আশার আলো

সাম্প্রতিক মাসগুলোয় রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধিতে সঞ্চয়ের সাফল্য দৃশ্যমান হয়। বিশ্বের অনেক দেশে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমশক্তি রফতানিতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম সারিতে রয়েছে। ২০১২ সালে বিদেশী মুদ্রা অন্তঃপ্রবাহে ভারত (৬৬ বিলিয়ন ডলার) ও পাকিস্তানের (১৩.২ বিলিয়িন ডলার) পরই বাংলাদেশের (১২.৮ বিলিয়ন ডলার) অবস্থান। অর্থনীতির এ পরিবর্তনশীল অবস্থা সত্ত্বেও জিডিপিতে এর অবদান অর্থনীতিতে নিঃসন্দেহে অর্থবহ। সেই অর্থে নেপালের কথা বলা যায়, বাংলাদেশের যেখানে রেমিট্যান্সের অবদান মোট জিডিপির ১২ দশমিক ৬ শতাংশ, সেখানে নেপালের ক্ষেত্রে এ হার ২০ শতাংশ।

যারা বৈদেশিক বিনিময়ের নেট ও মোট আয়ের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণে ব্যতিব্যস্ত, তারা জেনে খুশি হবেন যে, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স থেকে অর্জিত আয় পুরোপুরি রফতানিনির্ভর প্রস্তুতকৃত পোশাক শিল্পকে ছাড়িয়ে গেছে। দারিদ্র্য বিমোচনে রেমিট্যান্সের ভূমিকা নিয়ে বিশ্বব্যাংকের দেয়া রিপোর্ট অনুসারে, রেডিমেড গার্মেন্ট ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান করলেও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ২ কোটি ৫০ লাখ প্রবাসী রেমিট্যান্স সমৃদ্ধ করে চলছে, যা দারিদ্র্য বিমোচনে যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা রাখছে। এত কিছুর পরও আশ্চর্যজনকভাবে বিনিয়োগে রেমিট্যান্সের অন্তর্মুখী প্রবাহ পথে সৃষ্ট বাধা আমাদের নীতিনির্ধারণে যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছে না। অথচ গত ছয় মাসে রেমিট্যান্সের কারণে বৈদেশিক বিনিময়হার শক্তিশালী হয়ে ১২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়।

সাময়িক বাধার মুখে পড়লেও তৈরি পোশাক শিল্পের সম্ভাবনা প্রচুর

বিশ্ব অর্থনীতিতে সাম্প্রতিক মন্দা দেশের প্রধান রফতানি খাত পোশাক শিল্পের পাশাপাশি অন্যান্য খাতকে প্রভাবিত করেছে। সাধারণভাবে বলা যায়, বাণিজ্যনির্ভর অর্থনীতির জন্য সময়টি মোটেও ভালো নয়, বিশেষ করে রফতানি খাতের জন্য এখন দুঃসময়। যদিও একেবারে আশাহত হওয়ারও খুব একটা সুযোগ নেই। বিশ্ব অর্থনীতিতে উত্থান-পতন আসবে, তাই বলে বিশ্ববাজারে আমাদের অগ্রযাত্রা থেমে থাকবে না। আমাদের ভৌগোলিক ও পণ্যের বৈচিত্র্যগুণে রফতানিতে সাময়িক পারিপার্শ্বিক বাধাবিপত্তি কেটে যাবে বলে আশা করা যায়।

ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় আমাদের রেডিমেড গার্মেন্ট শিল্পের প্রসার ও অপার সম্ভাবনা আমরা দেখেছি। এ খাতে রফতানিতে বর্তমানে চীনের পরই আমাদের অবস্থান। বাংলাদেশের প্রতি অন্য দেশগুলোর আগ্রহের প্রতি লক্ষ্য রেখে ব্যবসায়িক পরামর্শক সংস্থা ম্যাককিনসে অ্যান্ড কোং ২০১১ সালে তাদের দেয়া রিপোর্টে উল্লেখ করেছে, ‘আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে তৈরি পোশাক রফতানি খাতে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের আগ্রহের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু।’ জাপান, চীন, ভারত ব্রাজিল, রাশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা একত্রে হয়ত অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের কাঙ্ক্ষিত বাজার হতে পারে। এক্ষেত্রে জাপানের সম্ভাবনাকে অগ্রাহ্য করার উপায় নেই। ২০০১ সালে জাপান কারখানাজাত পণ্য রফতানিতে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর তালিকা থেকে মুক্ত হয়ে তারা কোটামুক্ত ও শুল্কমুক্ত সুবিধার প্রস্তাব করছে। অনুৎপাদন খাত ছাড়া টেক্সটাইল ও পোশাক খাতেও তারা এ সুবিধা চালু রেখেছে। চামড়াজাত আট প্রকার পণ্য, ১২৩ ধরনের টেক্সটাইল পণ্য, চার ধরনের সিল্ক পণ্য, দুই শ্রেণীর মুক্তা, মূল্যবান পাথর, ধাতব মুদ্রা, একপ্রকার অপটিক্যাল, ছবি, টেকনিক্যাল যন্ত্রপাতিসহ ৯৯ ভাগ প্রকল্পের জন্য তারা শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত রফতানি সুবিধা দিচ্ছে।

বিক্রয় পরিমাণের দিক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর জাপান বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক বাজার এবং দেশটি বর্তমান সময়ের তৃতীয় বৃহত্তম নিটওয়্যার আমদানিকারক। সাম্প্রতিক ‘চীন প্লাস ওয়ান’ পলিসি অনুসারে, জাপানের তৈরি পোশাক শিল্পের ক্রেতারা তাদের অর্ডারের ৩০ শতাংশ চীন থেকে অন্

Dr. Zaidi Sattar

Dr. Zaidi Sattar

Dr. Sattar is the Chairman and Chief Executive of Policy Research Institute of Bangladesh (PRI) since its founding in 2009. PRI is a leading think tank in Bangladesh. Dr. Sattar began his career in 1969 as member of the elite Civil Service of Pakistan (CSP), and later worked in the ...

gog