সাম্প্রতিক সময়ে রফতানি বহুমুখীকরণের বিষয়টি বেশ জোরের সঙ্গেই আলোচিত হচ্ছে দেশে। প্রশ্ন হলো, কেন?
বিশ্বমন্দার মধ্যেও রফতানিতে যথেষ্ট সফলতা দেখিয়েছে দেশীয় রফতানিকারীরা। গত দুই দশকে সফলতার সঙ্গে রফতানি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখাটাও কম বড় অর্জন নয়। তবে প্রলম্বিত বিশ্বমন্দার প্রভাব পড়েছে এতে। সাম্প্রতিক অবস্থাদৃষ্টে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে রফতানি প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল ও আরও বাড়ানোর লক্ষ্যে কিছু পদক্ষেপ নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে এখন।
রফতানি আয়ে তৈরি পোশাকশিল্পের অবদান ৭৬-৮০ শতাংশ। বাংলাদেশের রফতানির বড় দুর্বলতা এখানেই। অনেকে হয়তো বলবেন, শিল্পপণ্য রফতানি করছি আমরা, তাহলে দুর্বলতা কোথায়? সত্য যে, কৃষি থেকে শিল্পপণ্য রফতানিতে অগ্রগতি হয়েছে আমাদের। এটি উত্সাহজনক। সমস্যা হলো এক পণ্যনির্ভরতা (এক্সপোর্ট কনসেনট্রেশন)। এটি বাংলাদেশের জন্য নতুন বিষয় নয়। সত্তরের দশকের দিকেও বাংলাদেশের রফতানি আয়ের ৯০ শতাংশ আসত পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে। সেখানেও এক্সপোর্ট কনসেনট্রেশন ছিল বড় সমস্যা। তখনকার আর এখনকার সমস্যার ধরন ও ধারণে পার্থক্য রয়েছে। সত্তরের দশকে দেশের রফতানি খাত ছিল প্রাথমিক পণ্যনির্ভর। সে সময় বাংলাদেশ থেকে কাঁচা পাট রফতানি হতো। বহু বছর আগে রাহুল প্রেবিস ও হান সিঙ্গার দুই অর্থনীতিবিদ বলেছিলেন, অনুন্নত দেশগুলোর রফতানিতে প্রাথমিক পণ্য প্রাধান্য পাচ্ছে। এতে ভবিষ্যতে ‘টার্মস অব ট্রেড’ কমে যাবে দেশগুলোর। এর কারণও ছিল। প্রাথমিক পণ্যের দাম বিশ্ববাজারে তেমন বাড়ে না বরং ম্যানুফ্যাকচারিং পণ্যের দাম তুলনামূলক বেশি বাড়ে। সুতরাং এসব দেশ টার্মস অব ট্রেড কমে যাওয়ার সমস্যায় ভুগবে। এদের করণীয় হবে প্রাথমিক থেকে শিল্পপণ্য তৈরি ও রফতানিতে মনোযোগী হওয়া।
বাংলাদেশকেও একই পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। সরকারও চেষ্টা করল, এ ধরনের কনসেনট্রেশন থেকে বের হয়ে আসা যায় কি না। ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে প্রাথমিক পণ্য রফতানি থেকে বের হয়ে ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে চলে আসে বাংলাদেশ। এটাকেও রফতানি বহুমুখীকরণ বলা হয়। অর্থনীতির ভাষায় যাকে বলে ভারটিক্যাল ডাইভারসিফিকেশন। নব্বইয়ের দশক থেকেই রফতানিতে প্রাধান্য পাচ্ছে শিল্পজাত পণ্য। আবারও এক্সপোর্ট কনসেনট্রেশনের সমস্যা দেখা দিয়েছে একটু ভিন্নভাবে। কাঁচা পাট রফতানি থেকে বের হয়ে তৈরি পোশাকশিল্পের চক্রে আবদ্ধ হচ্ছে বাংলাদেশ। ভালো সাফল্য অর্জন করেছি এ খাতে। সমস্যাটা নতুনভাবে উপস্থিত হয়েছে। টার্মস অব ট্রেডকে ইতিবাচক রাখাতে এর সমাধান জরুরি।
টার্মস অব ট্রেড হচ্ছে একটি ইনডেক্স, যেখানে রফতানি ও আমদানি সূচকের তুলনা করা হয়। এক ইউনিট রফতানির পরিবর্তে কত ইউনিট আমদানি করা যায়, সেটাই দেখা হয় এ সূচকে। এ ক্ষেত্রে একটি দেশের বাণিজ্য পরিস্থিতি তখনই ভালো বলা হবে, যখন রফতানি করে বেশি বেশি আমদানি করা যাবে। মন্দ তখনই বলা হয়, যখন রফতানি করে আগের তুলনায় কম পণ্যসামগ্রী আমদানি করা যায়। বাংলাদেশের টার্মস অব ট্রেড গত ২০ বছরে কমেছে। নতুন এক্সপোর্ট কনসেনট্রেশন গড়ে উঠেছে, এখন রফতানি আয়ের ৯০ শতাংশই আসছে শিল্প থেকে। এটি ভালো লক্ষণ। তবে এক পণ্যনির্ভর রফতানির জন্য আমাদের টার্মস অব ট্রেড কমছে। ইদানীং বিশ্ব মূল্য অভিঘাতের কারণে আমাদের আমদানি পণ্য খাদ্য, ভোজ্য ও জ্বালানি তেল— এসবের দাম বাড়ছে। এতে টার্মস অব ট্রেড বেশি নেতিবাচক হয়েছে। টার্মস অব ট্রেডে শক হলে অভ্যন্তরীণ বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে এর ফল আমরা দেখেছি। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায় এতে। এখন বড় কাজ হলো টার্মস অব ট্রেডকে স্থিতিশীল রাখা। এ বিষয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, অনেক ক্রস কান্ট্রি এভিডেন্স ও অভিজ্ঞতা দেখা হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, এক্সপোর্ট কনসেনট্রেশন যেসব দেশে বেশি, তাদের টার্মস অব ট্রেড বেশি কমে যায়। এ থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। বিশ্লেষণে আরও দেখা গেছে, রফতানি বহুমুখীকরণে সক্ষম হয়েছে যেসব অনুন্নত দেশ, তাদের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। পাশাপাশি টার্মস অব ট্রেড হয়েছে স্থিতিশীল। রফতানির সঙ্গে প্রবৃদ্ধির ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে। রফতানি ভালো হলে বিনিয়োগ বাড়ে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। রফতানি বহুমুখীকরণের সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও আর্থসামাজিক অবস্থার ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকার ও বিশেষজ্ঞদের দুটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। টার্মস অব ট্রেড স্থিতিশীল রাখা এবং রফতানি প্রবৃদ্ধি বাড়ানো। এর জন্যও রফতানি বহুমুখীকরণের প্রয়োজন।
গত দুই দশকে দেশের রফতানির তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এক্সপোর্ট কনসেনট্রেশন কমেনি বরং বেড়েছে। এখানে মনে হতে পারে— আমরা শুধু তৈরি পোশাক রফতানি করছি আর কিছু পারছি না, বিষয়টি তা নয়। বিভিন্ন ধরনের পণ্য রফতানি করেছে বাংলাদেশ। গত অর্থবছরে আমরা রফতানি করেছি ৭৫০টি পণ্য। সংখ্যার দিক দিয়ে মনে হতে পারে অনেক কিছু রফতানি হচ্ছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, এক্সপোর্ট কনসেনট্রেশন কেন? তৈরি পোশাক ছাড়া ১ থেকে ৫ মিলিয়ন ডলারের প্রায় ৩০০ আইটেম রফতানি করছি আমরা। দেখা গেছে, ১ মিলিয়ন ডলারে রফতানি আয় দিয়ে শুরু হয়ে ১০০ মিলিয়নে পৌঁছেও বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। এ ধরনের ছোট ছোট রফতানি পণ্যের সংখ্যাই বেশি। যেখানে তৈরি পোশাক ১৯ বিলিয়ন ডলার রফতানি হয়ে থাকে, সেখানে ১ বিলিয়ন ডলার রফতানি হয় এমন পণ্য মাত্র একটি— পাট ও পাটজাত পণ্য। ৫০০ মিলিয়ন ডলার আয় হয় এমন পণ্য তৃতীয়টি নেই। অনেকে হয়তো বলবেন, তৈরি পোশাকেরও অনেক ধরন রয়েছে। এটি সত্য, তৈরি পোশাকশিল্প একটি গ্রুপ। এখানে নিটওয়্যার আছে, রয়েছে ওভেন ও ফ্যাশন গার্মেন্ট। এখানেও দেখা যাচ্ছে শার্ট বা প্যান্টে কনসেনট্রেশন বেশি। তৈরি পোশাকের ক্যাটাগরি বাড়ছে; কিন্তু ছোট ছোট। কনসেনট্রেশন থাকছে বেসিক কতগুলো দিকে।
রফতানি বহুমুখীকরণের একটা সংজ্ঞা হচ্ছে পণ্য বহুমুখীকরণ। এটি সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহার হয়। পণ্যের সংখ্যা বাড়ানো অবশ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পাশাপাশি ভৌগোলিক বিস্তৃতি বাড়ানো প্রয়োজন। দেখতে হবে কতটা দেশে আমাদের রফতানি ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানেও আমাদের সমস্যা আছে। দেশের তৈরি পোশাকের বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকেন্দ্রিক। ৮০-৮৫ শতাংশ পণ্য রফতানি হচ্ছে এ দেশগুলোয়। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি, নেদারল্যান্ডসে এক্সপোর্ট কনসেনট্রেশন বেশি। সম্প্রতি এটা কমে এসেছে। ইইউর অনেক দেশে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি হচ্ছে এখন। এ ক্ষেত্রে ভৌগোলিক কনসেনট্রেশন কমেছে। অন্যদিকে কতগুলো সম্ভাবনা রয়ে গেছে। বাড়ন্ত অর্থনীতির দেশ যেমন চীন, ভারত, ব্রাজিল, রাশিয়া এদের সামষ্টিক অর্থনীতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা নর্থ আমেরিকার অর্থনীতির চেয়ে ছোট নয়। সেখানে আমাদের কিছু পণ্য যাওয়া শুরু হয়েছে। চীন ও জাপানে পণ্যের বড় বাজার তৈরি করা সম্ভব। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে কোনো কারণে ধস নামলে আমাদের রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এখন। ভৌগোলিক বহুমুখীকরণের মাধ্যমে এ ঝুঁকি অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব। এতে অন্য বাজারে পণ্য রফতানি করে যুক্তরাষ্ট্রের ধসের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যেত। ব্রাজিল, জাপান ও চীনের অর্থনীতি ভালো এবং যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিলেও সেটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হতো। বিদেশের চাহিদা মাঝে মধ্যে ওঠানামা করে। এটার ওপর আমাদের কোনো হাত নেই। এর কারণও রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে আমদানি ও রফতানি কোনো পণ্যের দামের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না বাংলাদেশ। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানি পণ্যের দাম বাড়লে বাংলাদেশের জন্য ভালো, কমলে ক্ষতি। আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ভৌগোলিক বহুমুখীকরণ হলে সম্প্রতি বিশ্বমন্দায় যে ক্ষতি হচ্ছে বা যে চ্যালেঞ্জের মুখে দেশ পড়েছে, সেটা হতো না। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি অসুবিধায় থাকলে চীন ও ব্রাজিলের অর্থনীতি ভালো করলে বাংলাদেশের অসুবিধা হবে না। রফতানি বহুমুখীকরণের একটি বড় ও ভালো স্ট্যাটিজি হলো ভৌগোলিক বহুমুখীকরণ।
সরকার ও নীতিনির্ধারকরা পণ্য বহুমুখীকরণের ওপর যতটা নজর দেন, ঠিক তেমনি নজর দেয়া উচিত ভৌগোলিক বহুমুখীকরণে। পাশাপাশি আরেকটি বহুমুখীকরণের চ্যালেঞ্জ রয়েছে আমাদের, ডাইভারসিফিকেশন অন ইনটেনসিভ মার্জিন। পণ্যের গুণগত মানের উন্নয়ন ও উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের। দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ সময় বেসিক পণ্যই রফতানি করছেন ব্যবসায়ীরা। এখানে ভ্যালু এডিশনের সুযোগ রয়েছে। ফ্যাশন গার্মেন্টে জোর দেয়া যেতে পারে। এ জন্য প্রযুক্তির সম্প্রসারণ করতে হবে। টেকনিক্যাল ও ম্যানেজেরিয়াল ইম্প্রুভমেন্টের জন্য বিদেশী বিনিয়োগ আনতে হবে। এটাও একধরণের বহুমুখীকরণ। সরকারের নীতির মধ্যে এগুলো এখনো আসেনি। এগুলো নজরে রাখতে হবে। প্রশ্ন হলো, কীভাবে বহুমুখীকরণ করা যায়? এ ক্ষেত্রে প্রথমেই নজর দিতে হবে বাণিজ্যনীতিতে। বিদ্যমান বাণিজ্যনীতিটি সাধারণভাবে সামগ্রিকভাবে রফতানিসহায়ক নয়, যদিও তৈরি পোশাক রফতানির জন্য সহায়ক। দুটো দিক থেকে একে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। অভ্যন্তরীণ বাজারের জন্য কতটা সহায়ক বাণিজ্যনীতি আর রফতানিতে কতটা, সেটা বিবেচনায় নিতে হবে। কিছু পণ্য তৈরি হচ্ছে রফতানির জন্য কিছু তৈরি হচ্ছে অভ্যন্তরীণ ভোগের জন্য, এখান থেকে কিছু অংশ আবার রফতানি হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে ইম্পোর্ট সাবসটিউট শিল্প। এর মাপকাঠি একটা, মুনাফা কোথায় বেশি। অধিকাংশ সময় দেখা যায়, অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্য বিক্রি করলে রফতানির চেয়ে মুনাফা বেশি হয়। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন দাঁড়ায়, তাহলে আমি রফতানি করব কেন? দুই মাস আগে এফবিসিসিআইয়ের সভায় উপস্থিত এক বড় উদ্যোক্তা জানান, তার কারখানায় উত্পাদিত পণ্যের ৮০ শতাংশ রফতানি ও ২০ শতাংশ অভ্যন্তরীণ বাজারে বিক্রি হয়। তিনি বলেন, আমাদের প্রফিট মার্জিন অভ্যন্তরীণ বাজারে অনেক বেশি। অভ্যন্তরীণ বাজারের চেয়ে রফতানি করা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের। রফতানি বাজারে সংরক্ষণ ব্যবস্থা কোনো ব্যবস্থা নেই, যেটা অভ্যন্তরীণ বাজারে আছে। তুলনামূলক সুবিধাও বেশি এখানে। কিন্তু দেশীয় বাজারের চেয়ে আন্তর্জাতিক বাজারের আকার অনেক বড়। এ ক্ষেত্রে রফতানি বাজার বড় হলে কর্মসংস্থান ও শিল্পের প্রসার হয়। এটি তৈরি পোশাকশিল্পে দেখছি আমরা। তৈরি পোশাকশিল্প শ্রমনির্ভর হওয়ায় যে পরিমাণ কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে, তা অন্য কোনো খাতে সম্ভব হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির আকার ১৫ ট্রিলিয়ন ও ইউরো অঞ্চলের ১৩-১৪ ট্রিলিয়ন ডলার। বাড়ন্ত অর্থনীতির দেশ চীন, ভারত রাশিয়া, ব্রাজিল ও জাপান এসব দেশের অর্থনীতির আকার ১৫ ট্রিলিয়ন ডলার হবে। বাংলাদেশের বাজার যতই বড় হোক না কেন, এখন ১১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি নয়। যুক্তরাষ্ট্র, জাপানের সঙ্গে তুলনা করলে আমাদের অর্থনীতি কিছুই নয়।
প্রতি বছর ১৮ লাখ মানুষ দেশের শ্রমশক্তির সঙ্গে যোগ হচ্ছে। এদের চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে। তার ওপর রয়েছে প্রছন্ন বেকারত্ব, সেখানেও পরিবর্তন আনতে হবে। প্রতি বছর ৪-৫ লাখ লোক বিদেশে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি অস্থিতির হয়ে ওঠায় সেখানেও চ্যালেঞ্জ বিরাজ করছে। এটা বন্ধ হয়ে গেলে সমস্যা আরও বাড়বে। মোট কথা, প্রতি বছর কমপক্ষে ২০ লাখ লোকের চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে। এটা সহজ কথা নয়। আমাদের বাণিজ্য ও শিল্পনীতি রফতানিমুখী না হলে এ ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করতে পারব না আমরা।
সত্তরের দশক থেকেই তৈরি পোশাকশিল্পকে ফ্রি ট্রেড চ্যানেল দেয়া হয়েছে। তাদের বন্ডেড ওয়্যারহাউস প্রথায় ডিউটি ফ্রি আমদানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাংলাদেশ হাই ডিউটি রেজিম। সে ক্ষেত্রে কাঁচামালের ওপর উচ্চ শুল্ক দিয়ে রফতানি বাজারে প্রতিযোগিতা করা কঠিন। প্রধানত এ জন্য কোরিয়ানরা বাংলাদেশকে পরামর্শ দিয়েছিল, ডিউটি ফ্রি আমদানি ও ব্যাক টু ব্যাক এলসিব্যবস্থা প্রবর্তনের। এ দুটি কারণে দেশের তৈরি পোশাকশিল্প খাত আজ এত উন্নতি করতে পেরেছে। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন দাঁড়ায়, অন্য খাতগুলো পারছে না কেন? এর কারণ অন্য শিল্পগুলো তৈরি পোশাকশিল্পের মতো সুবিধা পাচ্ছে না। জুতা রফতানিতে বাংলাদেশ গত কয়েক বছরে বেশি উন্নতি করেছে। ১৯৯০ সালের প্রথম দিকে বাংলাদেশের হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানি জুতা রফতানি শুরু করে। অথচ প্রথমে তাদের তৈরি পোশাকশিল্পের মতো ডিউটি ফ্রি কাঁচামাল ও কেমিক্যাল আমদানির সুবিধা দেয়া হচ্ছিল না। অনেক চেষ্টার পর সরকার তার নীতি পরিবর্তন করে। এর সুফল এখন আমরা পাচ্ছি। এপেক্স ফুটওয়্যার জুতা রফতানি করছে বলে তাদের বন্ডেড ওয়্যারহাউসের সুবিধা দেয়া হচ্ছে। অন্যরা পাচ্ছে না। বর্তমানে কোনো দেশ এককভাবে সব পণ্য তৈরি করতে পারে না। সব ক্ষেত্রেই প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে। একেক দেশ পণ্যের একেক অংশ তৈরিতে দক্ষতাসম্পন্ন। তাই রফতানি করতে হলে আমদানি করতে হবে। পাটের ওপর নির্ভরশীল রফতানির দিন চলে গেছে। পাটজাত পণ্য তৈরিতেও কেমিক্যাল আমদানি করতে হয়। অনেক কিছুই রফতানি করতে পারে বাংলাদেশ। রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বড় সুবিধা সস্তা শ্রম। একে কাজে লাগাতে হবে। রফতানিতে আইনের পাশাপাশি দুর্বলতা রয়েছে ব্যবস্থাপনায়। সেখানে দুর্নীতি আছে, রয়েছে অদক্ষতা। আমদানিতে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের শুল্ক। ডিউটি ড্র ব্যাক প্রতিষ্ঠান আছে। সেখানে অনেক বিড়ম্বনা মোকাবেলা করতে হয় ব্যবসায়ীদের। দেখা গেছে, টাকা ফেরত পেতে ছয় মাসের বেশি সময় ব্যয় হচ্ছে। আর সেটা পেলেও পুরোটা পায় বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের জন্য এ ব্যবস্থা কাজ করবে না— এটাই স্বাভাবিক। রফতানিতে আরও সফলতা অর্জন করতে হলে রফতানিকারক শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে ডিউটি ফ্রি কাঁচামাল আমদানির সুবিধা দেয়া একান্ত প্রয়োজন।
মধ্যবর্তী পণ্য রফতানিরও সুযোগ রয়েছে আমাদের। বিশ্বে রয়েছে এর ব্যাপক চাহিদা। অটো পার্টস, হালকা প্রকৌশল শিল্পসহ যেসব সম্ভাবনা রয়েছে আমাদের, সেটাকে কাজে লাগাতে হবে। বর্তমানে প্রচলিত বাণিজ্য ও শিল্পনীতিতে চূড়ান্ত পণ্যের দিকে বেশি মনোযোগ দেয়া হয়। মধ্যবর্তী পণ্যও যে রফতানিতে বড় অবদান রাখতে পারে, সেদিকে দৃষ্টি কম। আমরা মুখে বলি হালকা প্রকৌশলশিল্পকে সাপোর্ট দেয়া দরকার। কিন্তু নীতি মূল্যায়ন করলে দেখা যাবে, হালকা প্রকৌশলশিল্পের অবস্থা খারাপ। তারা সরকারের সহায়তা পায় না। বাণিজ্যনীতিও তাদের বিপক্ষে কাজ করে। এ ক্ষেত্রেও বহুমুখীকরণের বিরাট সুযোগ রয়েছে। ইস্ট এশিয়ার দেশগুলোর ৭৫ শতাংশ বাণিজ্য মধ্যবর্তী পণ্যনির্ভর। চীনের সঙ্গে তাদের বাণিজ্য সম্পর্ক রয়েছে। দেখা গেছে, চীন ইস্ট এশিয়ার অনেক ধরনের তৈরি পার্টস অ্যাসম্বল করে পণ্য তৈরি করে। বাংলাদেশেরও এ সম্ভাবনা রয়েছে।
রফতানির ক্ষেত্রে আমাদের নীতিতে অ্যান্টি এক্সপোর্ট বায়াস বিশেষভাবে বিদ্যমান। অভ্যন্তরীণ বাজারে মুনাফার হার বাড়িয়ে রাখাটা একটি চক্র হয়ে গেছে। এতে স্বল্প মেয়াদে সুফল মিললেও দীর্ঘ মেয়াদে অসুবিধা হবে। এটি দেশের শিল্পায়নে সহায়ক নয়। এতে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা অর্জন করবে না। আমদানির ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপপূর্বক সাময়িকভাবে দেশীয় শিল্প রক্ষা করা যায় বটে; তবে এতে আমাদের শিল্পগুলো প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। রফতানিকারকদের বহু কষ্ট করতে হয় বিশেষত যেখানে রফতানিতে শূন্য প্রটেকশন। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ বাজারে পাচ্ছেন নানা সুবিধা। এতে অ্যান্টি এক্সপোর্ট বায়াসনেস তৈরি হবে। রফতানি বহুমুখীকরণে এটিও একটি বড় সমস্যা। পাশাপাশি বিদ্যুত্-গ্যাস-অবকাঠামোর অপ্রতুলতা তো রয়েছেই। বন্দর, সড়ক ও রেলসেবার মান বাড়াতে হবে। কাস্টমস হচ্ছে আরেকটি স্থান, যেখানে রফতানি বাধাগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশের রাজস্ব আয়ের একটি বড় উত্স এখনো আমদানি শুল্ক। উন্নত দেশে কাস্টমস রাজস্ব সংগ্রাহক নয়, তারা দেখে নিষিদ্ধ বা অবৈধ পণ্য আসছে কি না। রাজস্ব আয়ের বড় উত্স অভ্যন্তরীণ কর যেমন ভ্যাট ও আয়কর। বাংলাদেশে শুল্ক প্রশাসনের রাজস্ব ফোকাসটা বেশি, যা বাণিজ্যসহায়ক নয়। এ কারণে নতুন আইন ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনা জরুরি। রফতানি বহুমুখীকরণে প্রশাসন একটি বড় বাধা। এ থেকে বের হয়ে আসতে হবে আমাদের।
জাতীয় প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে আমাদের অবশ্যই রফতানি বহুমুখীকরণ ও অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে। সর্বাগ্রে নীতিতে আনতে হবে পরিবর্তন। একই সঙ্গে রফতানিতে অ্যান্টি ডাইভারসিফিকেশন বায়াস দূর করতে হবে। তৈরি পোশাকশিল্প যে সুবিধাগুলো ভোগ করছে, সেগুলো অন্যান্য সম্ভাব্য রফতানি শিল্পের ক্ষেত্রেও দেয়া প্রয়োজন। ৩০০-এর ওপর পণ্য রয়েছে, সেগুলো ১ মিলিয়ন ডলারের বেশি রফতানি হচ্ছে। আইটেমগুলো কী, কেন তাদের বাজার বড় হচ্ছে না? সরকার প্রায় ১৫টি সেক্টরকে ‘থ্রাস্ট’ সেক্টর হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। সেগুলো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে থাকে। এ নীতিরও সমস্যা আছে। তৈরি পোশাকশিল্প বাংলাদেশে কোনো দিন থ্রাস্ট সেক্টর ছিল না। সেটা আজ বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। থ্রাস্ট সেক্টর না হওয়ার পরও জাহাজ নির্মাণশিল্প হঠাত্ অনেক অগ্রগতি সাধন করেছে। এটা সবার ধারণার বাইরে। থ্রাস্ট সেক্টরের আইডিয়া ঠিক নয়। আমরা জানি না, কোন খাতে আমাদের সফলতা আসবে। এ ক্ষেত্রে নীতি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নীতি এমনভাবে প্রণয়ন করা উচিত, যাতে রফতানি আরও বেশি মুনাফানির্ভর হয় এবং উদ্যোক্তাদের আগ্রহ বাড়ে। রফতানিতে চ্যালেঞ্জ রয়েছে, আছে কষ্ট। কিন্তু একবার সফল হলে এর পরিমাণ বাড়াতেই চান উদ্যোক্তারা। এটি দেশের জন্যই ভালো। এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ অনেক বাড়ে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ
চেয়ারম্যান, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)