সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি।
মুদ্রাস্ফীতির হার বেশি হলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। বিনিময় হারের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। মুদ্রাস্ফীতির ফলে সাধারণ মানুষের হাতে বেশি টাকা চলে আসে। এতে করে মূল্যস্ফীতি ত্বরান্বিত হয়। তাছাড়া টাকার জোগান বেড়ে গেলে আমদানির চাহিদা বাড়ে, বাড়ে ডলারের চাহিদা। এতে বিনিময় হার বেড়ে যায়। প্রতি বছরই দেখা যাচ্ছে আমাদের মুদ্রা সরবরাহের প্রবৃদ্ধি ২০ থেকে ২২ শতাংশ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ প্রবৃদ্ধির হার ১৬ থেকে ১৭ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়। অর্থের প্রবৃদ্ধি বেশি হওয়ায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর।
অর্থ সরবরাহের প্রবৃদ্ধি বেড়ে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ হলো প্রাইভেট এবং পাবলিক সেক্টরে ঋণপ্রবৃদ্ধি অতি মাত্রায় বেড়ে যাওয়া। একদিকে বাড়ছে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি, অন্যদিকে সরকারের ঋণগ্রহণের পরিমাণও বাড়ছে। এ অবস্থায় ঋণের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সুদের হারও অনেকটা বেড়ে গেছে। মূল্যস্ফীতির হার বেশি হওয়ায় ব্যাংকগুলো আমানতের সুদ হার বেশি অফার করতে হচ্ছে। ফলে ঋণের সুদ হারও বেশি আদায় করছে ব্যাংকগুলো। ব্যাংকগুলো সাধারণত আমানতের সুদ ও ঋণের সুদ হারের মধ্যে পার্থক্য (সেপ্রড) ৫ শতাংশের মতো রাখছে। ব্যাংকগুলো সেপ্রড ৫ শতাংশের চেয়ে কিছুটা কমিয়ে আনলে ব্যাংকগুলোর লাভের পরিমাণ কিছুটা কমলেও দেশের শিল্প খাত বেশ উপকৃত হতে পারে। আমাদের মুদ্রা বাজার চলছে বাজার ব্যবস্থার (মার্কেট ইকোনমি) আওতায়। বাংলাদেশ ব্যাংক এ কারণে ঋণের সুদ হার নির্ধারণ করে দিতে পারে না। বাজার ব্যবস্থার ওপর ছেড়ে দিলে দীর্ঘমেয়াদে বাজারে ভারসাম্য আসবে এটাই স্বাভাবিক। এ ধরনের ভারসাম্য অর্থনীতির জন্যও অধিকতর ভালো। বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সুদ হার তুলনামূলকভাবে কমিয়ে নির্ধারণ বা সিলিং করে দেয় তাহলে কস্ট অব ফান্ড কমে যাওয়ায় ঋণপ্রবৃদ্ধি আরও বেড়ে যাবে। এর ফলে একদিকে বাড়বে মূল্যস্ফীতি, অন্যদিকে আমদানির চাহিদা আরও বেড়ে যাবে। ফলে বিনিময় হারের ওপর চাপ আরও বৃদ্ধি পাবে। কমে যাবে টাকার মান। আরও তীব্রতর হয়ে উঠবে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা। দীর্ঘমেয়াদে হলেও অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর ভারসাম্যে পৌঁছানোর জন্য বাজার ব্যবস্থার ওপর ছেড়ে দেওয়ার প্রচলিত নীতিই সঠিক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি এবং সরকারের সমপ্রসারণমূলক ফিসকাল পলিসি সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ছে বলে অনেকেই কথা তুলছেন। সরকার তার লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করতে না পারে তবে বাজেট অর্থায়নের জন্য সরকারকে অভ্যন্তরীণ খাতের ওপর নির্ভর করতে হবে। ব্যাংকিং সেক্টর থেকে সরকার যদি বিশাল পরিমাণে ঋণ করে অর্থনীতি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে যাবে। সেক্ষেত্রে মুদ্রানীতি এবং ফিসকাল পলিসি কিছুটা মুখোমুখি হয়ে পড়বে। সরকার লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করতে সক্ষম হয় তবে এ ধরনের অবস্থার উদ্ভব হবে না।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে আমদানির প্রবৃদ্ধি প্রায় ৪১ শতাংশ। যা বাংলাদেশে কখনও দেখা যায়নি। আমদানি প্রবৃদ্ধি বেড়ে যাওয়ার কারণ হলো, দেশে অর্থের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় মানুষের হাতে অর্থের জোগান বেশি। এ কারণে মানুষের পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। আমাদের বিদেশি বাজারের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে ব্যালান্স অব পেমেন্টের ওপর।