আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রবর্তনের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে বেশকিছু অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ১৯৮০-এর দশকের শুরুর দিকে ব্যাংকিং ব্যবস্থায়
অনেক সংস্কারের কাজ শুরু হয় এবং বর্তমান শতকের প্রথম দশকে সংস্কার প্রক্রিয়াগুলো আরও বেগবান হয়। এ সংস্কারগুলোর ফলে ব্যাংকিং খাতের সূচকগুলোতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়। আর্থিক খাতের গভীরতা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সরবরাহ মুদ্রা (এম-২) এবং জিডিপির অনুপাত একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসেবে বিবেচিত হয়। ১৯৮০ সালে যেখানে এ অনুপাত ছিল মাত্র ১২ শতাংশ, ২০১১-এর নভেম্বরে এসে তা প্রায় ৫৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ওই একই সময়ে জিডিপির শতকরা হিসাবে ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ১৪ থেকে ৬০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে এবং মোট ঋণের মধ্যে বেসরকারি ঋণের পরিমাণ ৩৬ থেকে ৭৭ শতাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। অকার্যকর ঋণের পরিমাণ ১৯৯৯ সালে ৪১ থেকে কমে ২০১১ সালে (জুন) এসে ৭ দশমিক ১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে ব্যাংকিং খাতের গুণগত মান এবং স্থিতিশীলতা নির্দেশ করে। ব্যাসেল-১ অনুসারে অর্থের পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করায় ব্যাংকিং খাতে উন্নতি লক্ষ্য করা গিয়েছিল। যদিও ব্যাসেল-২ অনুসারে এ উন্নতি খানিকটা পিছিয়ে পড়ে। সম্পদ এবং ইকুইটি থেকে কতখানি আয় হয় তার হারের ওপর ভিত্তি করে ব্যাংকের মুনাফা হিসাব করা হয়। এটিও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষত বেসরকারি খাতে।
যদিও বাংলাদেশ একটি ছোট অর্থনীতির দেশ, তবুও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর তুলনায় এখানে ব্যাংকিং খাতের পরিধি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৮০ সালে এদেশে ব্যাংক ছিল মাত্র ১৭টি। ২০১০ এসে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৭টিতে। শুধু তাই নয়, ব্যাংকগুলোর শাখা একই সময়ে ৪০৬৭ থেকে বেড়ে ৭৭০০ হয়েছে। পাকিস্তান ও ভারতে যেখানে প্রতি ১০০০ বর্গ কিলোমিটারে যথাক্রমে ১০টি এবং ২৪টি ব্যাংকের শাখা রয়েছে সেখানে বাংলাদেশে প্রতি ১০০ বর্গ কিলোমিটারে ব্যাংকের শাখার সংখ্যা ৫৩। বাংলাদেশে প্রতি ২০ হাজার মানুষের জন্য একটি ব্যাংকের শাখা রয়েছে, যেখানে ভারত ও পাকিস্তানে এর সংখ্যা যথাক্রমে ১৪ হাজার ৪৮৫ এবং ২০ হাজার ৩৪০। এখন পর্যন্ত যেসব জায়গায় ব্যাংকিং সেবা পৌঁছায়নি সে সব জায়গায় মোবাইল ফোনের মাধ্যমে এ সেবা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
ব্যাংকিং খাতের এ উন্নতির পেছনে তিনটি নিয়ামক মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। এগুলো হলো— অধিকতর প্রতিযোগিতা, নিয়ন্¿ণ এবং উন্নত তদারকি। ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে বেসরকারি খাতের কাছে উন্মুক্তকরণ ব্যাংকিং খাতের এ অগ্রযাত্রায় একটি বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা, সরকারি এবং বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে পুঁজি সংগ্রহের প্রতিযোগিতা এবং নতুন ফিন্যান্সিয়াল প্রোডাক্ট চালু ও সেবাগ্রহীতাদের উন্নত সেবা প্রদান করার মাধ্যমে এ উদ্যোক্তারা ব্যাংকিং খাতের চেহারাটাই বদলে দিয়েছেন। যদিও এখনও আন্তর্জাতিক মানে ব্যাংকগুলো আসতে পারেনি, তবুও রিটেইল ব্যাংকিংয়ে ব্যাংকগুলো বেশ এগিয়ে গেছে। কেবল দ্রুত লেনদেনই নয়, আধুনিক ব্যবস্থা যেমন এটিএম, ই-ব্যাংকিং, ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড, টেলিগ্রাফিক ট্রান্সফার ইত্যাদি প্রভূত সেবা ব্যাংকগুলো তাদের ভোক্তাদের দিয়ে যাচ্ছে।
এ ধরনের প্রতিযোগিতার ফলে ব্যাংকিং খাতে মোট সম্পদে বেসরকারি ব্যাংকের অংশ ২০০১ থেকে ২০১০ সালে ৪২ থেকে বেড়ে ৬৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। একই সঙ্গে আমানতের ক্ষেত্রে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর আমানতের পরিমাণ ৪৩ থেকে বেড়ে ৬৬ শতাংশ হয়েছে। উন্নত পোর্টফোলিও ব্যবস্থাপনা এবং শেয়ারের মূল্য বৃদ্ধির ফলে অকার্যকর ঋণের ক্ষেত্রে বেশ উন্নতি হয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে বিদেশি ব্যাংকগুলো অকার্যকর ঋণের ক্ষেত্রে বেশি ভালো করছে। শুধু তাই নয়, বিদেশি ব্যাংকগুলো ব্যাসেল-২য়ে যে ঝুঁকিপূর্ণ পুঁজি বিষয়ক নির্দেশিকা রয়েছে সেগুলো ভালোভাবে উতরে গেছে। এর ফলে বিদেশি ব্যাংকগুলো ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে নিরাপদ ব্যাংক রূপে বিবেচিত হচ্ছে।
ব্যাংকের নিয়ন্¿ণ ক্রমেই কঠোর হচ্ছে। ব্যাসেল-২-এর সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন এ ক্ষেত্রে আরও গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্¿ণকারী সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানের সামর্থ্য বৃদ্ধিতেও অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।
তা সত্ত্বেও ব্যাংকিং খাতে কিছু উদ্বেগের বিষয় রয়ে গেছে।
প্রথমত, ব্যাংকগুলোর মধ্যে বিশেষ করে সরকারি এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে কর্মদক্ষতার বেশ পার্থক্য রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বিদেশি ব্যাংকের অকার্যকর ঋণের পরিমাণ ৩.১ শতাংশ এবং দেশীয় বেসরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে এ ঋণের পরিমাণ ৩.৫ শতাংশ। সে তুলনায় সরকারি তফসিলি ব্যাংকের এ ঋণের পরিমাণ ১৪.১ শতাংশ এবং বিশেষায়িত সরকারি উন্নয়ন ব্যাংকগুলোর এ ঋণ ২৪.৮ শতাংশ। সরকারি ব্যাংকগুলোর পোর্টফোলিওতে নন-পারফর্মিং লোনের এরূপ উচ্চ হার, ব্যাংকগুলোর জন্য একটি গুরুতর সমস্যা। সরকার এ ব্যাংকগুলোকে আর্থিকভাবে সহায়তা প্রদান করতে পারে ভেবে অনেক ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতার ঝুঁকিকে উপেক্ষা করতে পারে। প্রকৃত পক্ষে এটি বড় ধরনের আর্থিক ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
দ্বিতীয়ত, ব্যাংকিং খাত সামগ্রিকভাবে মূলধনের পর্যাপ্ততার শর্ত পালন করতে পারছে না ব্যাসেল-২ অনুযায়ী। গত বছরের জুনের তথ্য অনুসারে বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এ শর্তের চেয়ে বেশি অর্থ মজুদ রেখেছে (ব্যাসেল অনুসারে ১০ শতাংশ, এরা রেখেছে ১৭.১ শতাংশ)। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি ভারিত মূলধনী সম্পত্তির অনুপাত গড়ে ১০.৪ শতাংশ বজায় রেখেছে যা ব্যাসেল-২-এর অধীনে প্রয়োজনীয় ১০ শতাংশ হারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি ভারিত মূলধনী সম্পদের অনুপাত ছিল মাত্র ১.৫ শতাংশ আর বিশেষায়িত সরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ঋণাত্মক ৭.১ শতাংশ।
তৃতীয়ত, ঋণের শ্রেণীকরণ এবং ঋণ প্রদানের কার্যক্রম আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন নয়। এর ফলে যে হিসাব প্রকাশ করা হয় তা সত্যিকারের আর্থিক অবস্থাকে আড়াল করে ফেলতে পারে।
চতুর্থত, দুর্বল ব্যাংকগুলোর সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবেলায় কিছু সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিষয় রয়েছে যেগুলো সঠিকভাবে নিয়ন্¿ণ করা প্রয়োজন। একটি ঝুঁকি হলো এসব ব্যাংকের শেয়ারবাজারে অংশগ্রহণ। ভবিষ্যতে শেয়ারবাজারে পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তবুও আগে বিনিয়োগকারী ব্যাংকগুলো এখনও ঝুঁকির মধ্যে আছে। এ বিষয়ে খুব সাবধানে এগোতে হবে। দ্বিতীয় ঝুঁকিটি হচ্ছে, যদিও গৃহায়ন খাতে অতিরিক্ত দাম বৃদ্ধি হয়েছে অন্যান্য দেশের মতো এ দাম কমে আসতে পারে। এর ফলে রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগকারী ব্যাংকগুলো ঝুঁকিতে পড়তে পারে। এটিকেও ভালোভাবে তদারকি এবং ব্যবস্থাপনা করতে হবে। সর্বোপরি, আরও সংকোচনশীল মুদ্রা ব্যবস্থাপনা এবং ক্রমবর্ধমান সুদের হার বৃদ্ধির এ সময়ে ব্যাংকিং খাতের বিকাশের প্রক্রিয়াকে কড়া নজরদারি এবং সঠিক পরীক্ষার ভেতর দিয়ে অগ্রসর হতে হবে।
পঞ্চমত, ব্যাংকগুলোর করপোরেট পরিচালনা বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু রয়েছে। পরিচালনা পর্ষদ এবং ব্যবস্থাপনার জন্য যে নিয়ম করে দেওয়া আছে সে নিয়মাবলি, রাজনৈতিক যোগাযোগ এবং প্রভাবকে পুঁজি করে কিছু বেসরকারি ব্যাংক সহজেই পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে।
ষষ্ঠত, সরকারি ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকির আওতার বাইরে। ফলে নিয়ন্¿ক সংস্থার দূরদর্শী নিয়ন্¿ণ তারা অনেক ক্ষেত্রেই মেনে চলে না যা কি না ব্যাংকিং খাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি ঝুঁকি। এটিকে দ্রুত ঠিক করা উচিত।
সব শেষে, বৃহত্ সংখ্যক ব্যাংকগুলোকে তদারকি করার যথেষ্ট সামর্থ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নেই। ফলে, কিছু সংখ্যক ব্যাংক মাঝে মধ্যে তারল্য অনুপাত, ক্রেডিট-ডিপোজিট অনুপাত, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ, পুঁজির সরবরাহ এবং হিসাবের গুণগত মানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের যথাযথ মান মেনে চলে না।
উপরোক্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে যে বিষয়টি পরিষ্কার হলো তা হচ্ছে— ব্যাংকিং খাতে সংস্কার বৃদ্ধি পেয়েছে এবং গুণগত এবং পরিমাণগত ব্যাংকিং সেবায় এ খাত উন্নতি লাভ করেছে। তথাপি এটি একটি অসমাপ্ত কার্যক্রম। তিনটি বৃহত্ ক্ষেত্রে সংস্কার সাধন প্রয়োজন।
প্রথমত, আন্তর্জাতিক মানের আর্থিক বিবরণ এবং হিসাব প্রকাশের মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতের গুণগত মান এবং দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে এ ক্ষেত্রে তদারকি করতে হবে। সব ব্যাংকের জন্য ব্যাসেল-২ বাস্তবায়ন করার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দায়িত্ব নিতে এবং ব্যাসেল-৩ প্রবর্তনের কাজটি শুরু করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, জনবল এবং প্রণীত আইন বাস্তবায়নে স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতার অভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি এবং নজরদারির ক্ষমতা সীমিত হয়ে আছে। মুদ্রানীতি এবং ব্যাংক তদারকিতে সরকারের হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। সরকার চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনের মাত্রার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে পারে। সাময়িক লাভের আশায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে দুর্বল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চেয়ে উন্নতমানের ব্যবস্থাপনা এবং প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন কর্মীদের নিয়ে একটি স্বায়ত্তশাসিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক, এ প্রতিষ্ঠানকে একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করতে পারে যা দেশের স্বার্থে কাজ করতে পারবে।
তৃতীয়ত, সরকারি ব্যাংকগুলোকে তদারকি করার জন্য সরকারকে কর্মকৌশল ঠিক করতে হবে। সরকারি ব্যাংকগুলোর অপর্যাপ্ত পুঁজি এবং দুর্বল পোর্টফোলিও ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি স্বরূপ। এ সমস্যা উত্তরণের জন্য সরকারি ব্যাংকের দক্ষতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকির আওতায় আনতে হবে এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এ নির্দেশনা মেনে চলার ব্যবস্থা করতে হবে।
লেখক : ভাইস চেয়ারম্যান, পিআরআই