সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় অর্থাৎ শেষ ষান্মাসিক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে।
এতে মূল্যস্ফীতি নামিয়ে আনার এক ধরনের প্রত্যয় লক্ষ করা যায়। গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতার বিবেচনায় একে ব্যতিক্রমধর্মী বলা চলে। মূল্যস্ফীতিকে একটি বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবার। এটিকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার ক্ষেত্রে মুদ্রানীতিকে একটি ঘোষণাপত্র হিসেবেই দেখছেন সবাই। এ পরিবর্তনকে স্বাগত জানাতে হয়। আগে মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতিকে গুরুত্ব দেয়া হলেও এমন সরাসরি স্বীকৃতি ছিল না সেগুলোয়। আগে অনেকটা এমন ভিত্তির ওপর নির্ভর করে মুদ্রানীতি করা হতো, যেন মূল্যস্ফীতির সঙ্গে অভ্যন্তরীণ মুদ্রা সরবরাহের তেমন সম্পর্কই নেই; পণ্যের দাম বাড়ছে শুধু আন্তর্জাতিক কারণে। কেমন যেন একটা অস্পষ্টতা দেখা যেত আগের মুদ্রানীতিতে। সমস্যাকে দৃঢ়ভাবে মোকাবেলা বা যেভাবে উপলব্ধি করা প্রয়োজন, সেটার অভাব ছিল। এ পরিপ্রেক্ষিতে নতুন ঘোষিত মুদ্রানীতিতে এক ধরনের স্পষ্টতা রয়েছে। এও সত্য, এবারের মুদ্রানীতিটা এমন সময়ে ঘোষণা করা হলো, যখন দেশের অর্থনীতি এক প্রকার টানাপড়েনের মধ্যে রয়েছে। সামগ্রিক অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা প্রকট হয়ে উঠছিল বলেই দৃঢ়তার প্রয়োজন ছিল এ ক্ষেত্রে।
অন্যান্য সময়ের চেয়ে এবারের রাজস্বনীতির প্রভাবও থাকবে ভিন্ন। চলতি অর্থবছরে এ ক্ষেত্রে বড় রকমের সমস্যা দেখা দিয়েছে, যা গত বছর ছিল না। এ কারণে মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের ওপর রাজস্বনীতি বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে এবার। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুটি বিষয় সামনে আসে। বাংলাদেশ ব্যাংক যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করল এবং যে দৃঢ়তা দেখালো, সেটা তারা কতখানি বাস্তবায়ন করতে পারবে। প্রথম চ্যালেঞ্জ, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহকে নামিয়ে আনা। এটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক মোটামুটি সফল হচ্ছে বলা যায়। ব্যক্তি বা বেসরকারি খাতে গত কয়েক মাসে ঋণের চাহিদা বেশ কমে এসেছে বিভিন্ন কারণে। এর একটা বড় কারণ, সুদের হার বৃদ্ধি। আরেকটি কারণ, ডলারের দর বৃদ্ধি ও এর স্বল্পতা। অনেক সময় দেখা যাচ্ছে, ঋণপত্র (এলসি) খোলার সময়ে টাকা থাকলেও ডলার স্বল্পতার কারণে তা খরচ করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। এ কারণে বেসরকারি ঋণের চাহিদা সংকুচিত হয়ে আসছে। ডলার না পাওয়ায় উদ্যোক্তারা ব্যয় করতে পারছেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ মোটামুটি লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি রয়েছে।
কিন্তু এবারের মুদ্রানীতির উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ অর্জন করতে গেলে রাজস্বনীতির সঙ্গে মুদ্রানীতির যে ধরনের সমন্বয় প্রয়োজন, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট আভাস মিলছে না। মুদ্রানীতিতে প্রাক্কলনকৃত সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ডিসেম্বরের ৬২ শতাংশ থেকে জুনের মধ্যে ৩১ শতাংশে নামিয়ে আনা, বিশেষত অর্থবছরের অবশিষ্ট সময়ে অবশ্যই কষ্টকর। এরই মধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এ লক্ষ্যমাত্রা। বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারি ঋণগ্রহণের মাত্রা কমিয়ে আনার পরামর্শ দিলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিশ্রুতির কথা আমরা জানতে পারিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া সীমার মধ্যে সরকার ঋণ সীমাবদ্ধ রাখতে সক্ষম হবে বা প্রচেষ্টা নেবে, এমন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। এ লক্ষ্য অর্জন করতে গেলে যে ধরনের প্রচেষ্টা নিতে হবে বা নেয়া হয়েছে, তার যথার্থতা নিয়ে কোনো বিশ্লেষণ সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকও উদ্যোগ নেয়নি। এটি নতুন মুদ্রানীতি বাস্তবায়নে এক ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করছে। রাজস্বনীতি আরও সুস্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন ছিল। এখানে একটা পর্যালোচনা থাকা উচিত ছিল— কীভাবে সরকার ঋণ কমিয়ে আনবে বা মুদ্রানীতি বাস্তবায়নে সহায়তা করবে। এটিকে বলা হয় পলিসি কো-অর্ডিনেশন। বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষণা করল, অথচ সরকারের পক্ষ থেকে এর সমর্থনে কোন কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে না। থাকলে তা ঘোষণার মাধ্যমে দেখানোটাই ছিল কাম্য। এতে বাজার আশ্বস্ত হতো— সরকার কীভাবে নীতি বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে অর্থনীতিবিদরা বিশ্লেষণ করতে পারতেন সরকারের পদক্ষেপগুলো পর্যাপ্ত কি না। এখন এসবের কোনোটিই করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে সরকারি ব্যয় ও ঋণের রাশ টেনে ধরার ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। এটাকে অনেকটা ‘ব্ল্যাক হোলের’ সঙ্গে তুলনা করা যায়। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের মতো চলতে থাকলে সরকারি ঋণ যে কেবল বেসরকারি ঋণকে গ্রাস করতে পারে তা নয়, সামগ্রিক অর্থনীতি ও বেসরকারি খাতে বড় রকমের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে এটি।
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ঋণের সুদের হারের সর্বোচ্চ সীমা তুলে নেয় কিছুদিন আগে। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে এটা জরুরি ছিল। কারণ বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমাতে হলে সুদের হার বাড়ানো ভিন্ন পথ ছিল না। ঋণের ব্যয় বাড়িয়ে চাহিদা কমাতে হবে। বাজারব্যবস্থায় প্রতিটি জিনিসের দাম তার চাহিদা ও সরবরাহ দ্বারাই নির্ধারিত হয়। এ ক্ষেত্রে মূল্যটা হচ্ছে সুদের হার। তবে প্রশ্ন হলো, হঠাৎ করে কেন সুদের হারটাও এত বেড়ে গেল? এর মূল কারণ বেসরকারি খাত নয়, এর জন্য প্রধানত দায়ী সরকার ও তার প্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত ঋণচাহিদা। বাজেট বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকার যে অতিরিক্ত ঋণচাহিদা সৃষ্টি করেছে, তা মেটাতে গিয়েই এমন পরিস্থিতির উদ্ভব। বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সুদের হার সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হলে সরকারকেই সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় আনা জরুরি, যাতে চাহিদা ও জোগানের মাধ্যমে সুদের হার স্বাভাবিকভাবে নির্ধারিত হয়। ঋণের সুদের হার হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার জন্য বাজারব্যবস্থাকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে; অথচ প্রকৃতপক্ষে দায়ী হলো সরকারি খাতের ঋণ। বাজারে যে অতিরিক্ত চাহিদা তৈরি হয়েছে, বর্তমানে তার প্রকৃত উত্স সরকার ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলো। এ চাহিদা মেটাতে গিয়েই সুদের হারের হঠাৎ উল্লম্ফন। এটাকে স্থিতিশীল করতে সুদের হারের ওপর ‘সিলিং’ নির্ধারণ করাটা মোটেই যৌক্তিক পদ্ধতি হতে পারে না। উচিত ছিল সরকারের ব্যবস্থাপনা ও ব্যয় সংকোচনের মাধ্যমে এটিকে সহনীয় করে আনা; যেটি করা হয়নি। এর বদলে আমরা দেখলাম, ঋণের সুদের হারের ওপর সিলিং পুনঃপ্রবর্তন করা হলো। এটি দিয়ে বাজারে বিদ্যমান অর্থের চাহিদা ঘিরে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা কমানো যাবে না। এতে সরকার বরং আরও উত্সাহিত হবে ঋণ গ্রহণে।
এটা গেল একটা দিক। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হলো, সুদের হার নির্ধারণের দায়িত্ব বা আইনগত অধিকার রয়েছে কার? ঋণ নীতিমালা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের এখতিয়ারভুক্ত। এখানে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী পরিচালিত সংস্থা হস্তক্ষেপ করতে পারে না। যদি করে, তা হবে আইনবর্হিভূত। এটিকে সিন্ডিকেশন হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। বাংলাদেশে কোথাও যদি সিন্ডিকেশন থেকে থাকে, ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনে থাকতে পারে সেটি। কারণ তারা খুবই সংগঠিত। তারা একসঙ্গে কাজ করে এবং একই সঙ্গে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে ফেলে। তাদের কার্যকলাপে এটি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। মনোপলিস্টিক কার্যক্রমের নির্ভুল উদাহরণ হচ্ছে এ ধরনের সংগঠনের সুদসংক্রান্ত কার্যক্রম। তাদের ক্ষমতা আছে এটা বাস্তবায়নের। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর এ সংগঠন নিদের্শনা জারির মাধ্যমেই দেশের প্রায় সব কটি ব্যাংককে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাধ্য করতে পারে। এ ক্ষমতা তারা নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে এবং করছে বলেই ধারণা। নিজের স্বার্থেই এরা স্প্রেড ঘোষণা, আমানতের সুদের হার কমিয়ে এবং ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে ফেলতে পারে। এটি হচ্ছেও।
অর্থনীতিবিদ হিসেবে আমরা চাই না, বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অর্থাৎ উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও টাকার সংকট সত্ত্বেও আমানতের সুদের হার কমে যাক। টাকার মূল্যমান ধরে রাখতে হলেও আমাদের আমানতের সুদের হার বাড়াতে হবে, একে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। তা করতে পারলে মানুষ ডলার ভাঙিয়ে তাদের সম্পদ রাখবেন টাকায়। তারা বিদেশ থেকে ডলার এনে দেশেই রাখবেন। বাংলাদেশ থেকে অর্থ বাইরে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতাও কমে আসবে। সবকিছু মিলিয়ে আমাদের এদিকে দৃষ্টি দিতেই হবে। ভাবতে হবে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে একজন আমানতকারী কী পাচ্ছেন। বর্তমান অবস্থায় আমানতের সুদের হার ১২ বা সাড়ে ১২ শতাংশ ধরলে তাকে আমরা প্রায় শূন্য হারে পুরস্কৃত করছি। কারণ মূল্যস্ফীতিই এখন প্রায় ১২ শতাংশ। একটি পণ্য কিনে রাখলেও ভোক্তা এ রিটার্ন পাবে। কাজেই কোনোভাবেই তাকে পুরস্কৃত করা হচ্ছে না। এ ব্যবস্থা টাকার মূল্য ধরে রাখার ক্ষেত্রে কতটা সহায়ক হবে, সেটা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেবে দেখা দরকার। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমানতের সুদের হার যদি ১৪, ১৫ বা ১৬ শতাংশও হয়ে যায়, তাতে সমস্যা নেই। এতে কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ শতাংশ ইতিবাচক রিটার্ন আমানতকারীরা পাবেন। এটা ডলারের সঙ্গে টাকার মূল্যমান স্থিতিশীল রাখতেও অনেকখানি সহায়ক হতো। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বর্তমান পরিস্থিতিতে সঞ্চয়কারীকে আমরা নো রিটার্ন পরিস্থিতির দিকে নিয়ে গেলাম— সুদের হার নির্ধারণের মাধ্যমে। সিলিং চাপানোর আগে যাও ইতিবাচক রিটার্ন ছিল (২ থেকে ৩ শতাংশের মতো), সেটাও বন্ধ করে দেয়া হলো এবার। এটি অর্থনীতির জন্য মোটেই ভালো ফল দেবে না। অভিজ্ঞতা তা-ই বলে। ভালো নীতির উদাহরণ হতে পারে না এটি। কিছুদিনের জন্য হলেও সুদের হার বাড়তে দেয়া উচিত ছিল। এর পর মূল্যস্ফীতি কমে গেলে এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মান স্থিতিশীল হলে এমনিতেই কমে আসত সুদের হার।
উল্লেখ্য, সুদের হার নির্ধারণসংক্রান্ত নীতি বাস্তবায়ন করতে হলে সেটা সব সময় বাংলাদেশ ব্যাংকেরই করা উচিত। অন্য কোনো সংগঠনকে এভাবে ব্যবহার বা তাদের এ ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করতে দেয়া আইনত সিদ্ধ নয়। এটি মনে রেখে এমন কার্যকলাপ অতিসত্বর বন্ধ করা উচিত। এটি করতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারকেই।
বাজারব্যবস্থায় কোনো কিছুকে বেঁধে দেয়ার পরিণাম ভালো হয় বলে জানা নেই। বাজারে যদি অতিরিক্ত চাহিদা থাকে এবং সেই সঙ্গে সীমা বেঁধে দেয়া হয়, তা লাফ দেবেই। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে পানির বাঁধকে তুলনা করতে পারি। উভয় পাশে সামঞ্জস্য না রেখে এক পাশে পানির উচ্চতা বাড়তে থাকলে হঠাৎ বাঁধ ভেঙে গেলে বা তা খুলে দিলে সবকিছু তলিয়ে যাবে— ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি হবে। এ ক্ষেত্রে অর্থনীতিটাও অনেকটাই এমন। সুদের হার নির্ধারণ করে সংকট বাড়িয়ে এবং পরে বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে অর্থনীতিকে তা বিপর্যস্ত করতে বাধ্য। বাজার ব্যবস্থাপনায় সবকিছুই ওঠানামা করে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। কৃত্রিম হস্তক্ষেপ শুধু সমস্যাই তৈরি করে এ ক্ষেত্রে।
মুদ্রানীতির একটা কৌশল (ওহংঃত্ঁসবহঃ) হচ্ছে সুদের হার। এর মাধ্যমে অর্থের প্রবাহকে বাড়ানো বা কমানো হয়। অর্থনীতিতে যে পরিমাণ অর্থ রাখা প্রয়োজন, সে পরিমাণ অর্থই সরবরাহ করা উচিত। এটার একটা উপাদান হচ্ছে ঋণের পরিমাণ সীমিত রাখা। গেল বছর ব্যক্তি খাতে মোট ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ছিল ২৬-২৭ শতাংশ। গত কয়েক বছর গড়ে এমন হারে ঋণের প্রবৃদ্ধি বজায় ছিল। এর পরও যদি বেসরকারি খাত অভিযোগ করে, তারা যথাযথভাবে ঋণ পাননি তা দুঃখজনক। এ ক্ষেত্রে যত ঋণই দেয়া হোক না কেন, তারা আরও চাইবেন। এ অবস্থা অর্থনীতির জন্য ভালো নয়। ঋণের প্রবৃদ্ধি আমাদের দেশের অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে ১৭-১৮ শতাংশের বেশি হওয়ার যৌক্তিক কারণ নেই। জিডিপি প্রবৃদ্ধি যদি ৭ শতাংশও হয় এবং মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা বজায় রাখতে হয়, তাহলে ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৬-১৭ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়। মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে ঋণের প্রবৃদ্ধি আরও কমাতে হবে। এ ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকরা চিন্তাভাবনা করবেন, এটিকে কীভাবে নামিয়ে আনা সম্ভব। তাদের লক্ষ্য ঋণের প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা— সুদের হার নয়। সুদের হার যদি ২০ শতাংশও হয়ে যায় এবং ঋণের প্রবৃদ্ধি ২৫ শতাংশের বেশি হয়, তাহলে বুঝতে হবে বাজারে অর্থের অতিরিক্ত চাহিদা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে সুদের হার আরও বাড়তে দেয়াটাই কাঙ্ক্ষিত। এর চেয়েও যদি বেশি ঋণের প্রয়োজন হয়, তবে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে প্রমাণ করতে হবে— কেন ও কোথায় এত ঋণের প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্দেশ্য হলো ঋণের প্রবৃদ্ধিকে অর্থনীতির জন্য সহনীয় পর্যায়ে রাখা। তাদের সুদের হারের দিকে দৃষ্টি দেয়ার প্রয়োজন নেই। এখানে উল্লেখ করতে হবে, তাদের যদি মুনাফাই না থাকে, তাহলে কেন ব্যবসায়ীরা ঋণ নেবেন। মুনাফার হার সুদের হারের চেয়ে এখনো অনেক বেশি বলেই তারা উচ্চ সুদের হার সত্ত্বেও ঋণ গ্রহণ করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে, যে পরিমাণ ঋণের প্রবৃদ্ধি অর্থনীতির জন্য ভালো সেটা অর্জনের প্রচেষ্টা নেয়া। এটি করতে গিয়ে সুদের হার যেখানে যাওয়ার প্রয়োজন, সেখানেই যেতে দিতে হবে। বাজার স্বাভাবিক হলে সুদের হারও স্বাভাবিক হয়ে যাবে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ঋণের প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি ও অর্থের জোগানকে সহনীয় পর্যায়ে রাখা। যেটা টার্গেট করেছেন, সেটা রক্ষা করাই হবে তাদের দায়িত্ব। এ পরিপ্রেক্ষিতে সুদের হারের ওপর সিলিং দেয়াটা মোটেই সঠিক নীতি হতে পারে না।
লেখক: অর্থনীতিবিদ নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট