প্রতিষ্ঠান নির্মাতা

অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় ১৯৭০ সালে। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের স্নাতক শ্রেণীর ছাত্র। তিনি আমাদের উন্নয়ন অর্থনীতি পড়াতেন।

অধ্যাপক রেহমান সোবহান লেকচারের মাধ্যমে দুই জাতির (অর্থাত্ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান) অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তার কথা জানাতেন। তিনি কুশলসহকারে ব্যাখ্যা করে জানাতেন, কীভাবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য গড়ে উঠছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানি মিলিটারি-আমলা নেতৃত্বাধীন সরকারের সময় কীভাবে তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি আরো ব্যাখ্যা করে জানিয়েছিলেন, কেন বেশির ভাগ অর্থনৈতিক বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান প্রত্যেকের প্রয়োজন পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন, যা থাকবে একটি শিথিল ফেডারেশনের অধীনে। তাঁর মতে, দুই পাকিস্তান এক থেকে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে হলে এটিই একমাত্র পথ। রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য উত্থাপিত ছয় দফা দাবির একটি প্রধান দায়ী ছিল অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং পর্যায়ক্রমে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।

পরেরবার অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সঙ্গে আমার সাক্ষাত্ ঘটে  ১৯৭৫ সালে। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের লেকচারার এবং তিনি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট ফর ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক। আমি অর্থনীতি বিভাগের অফিস থেকে জানতে পারি, তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। আমি বিআইডিএসে তাঁর অফিসে যাই। তিনি আমাকে আমার ভবিষ্যত্ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চান। আমি তাকে জানাই বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচিং ফেলোশিপের মাধ্যমে আগামী সেপ্টেম্বরে পিএইচডির জন্য কানাডার ওয়েস্টার্ন অন্টারিও বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছি। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, যদি আমি এর বদলে তোমাকে ফুল ফেলোশিপের সঙ্গে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসে (এলএসই) পাঠাই? আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। এলএসই ছিল আমার স্বপ্ন। আমি হতভম্বতা কাটিয়ে  বলি, অবশ্যই আমি ওয়েস্টার্ন অন্টারিও বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে এলএসইকে পছন্দ করব।

আমি পরের সপ্তাহে বিআইডিএসে স্টাফ অর্থনীতিবিদ হিসেবে যোগ দিই। তিনি তাঁর কথা রাখলেন। অধ্যাপক রেহমান সোবহান তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু অধ্যাপক অমর্ত্য সেনকে আমন্ত্রণ জানান এলএসইতে ভর্তির জন্য আমার এবং আরো কিছু সহকর্মীর সাক্ষাত্কার নিতে। অধ্যাপক সেন তখন গ্র্যাজুয়েট স্কুলের পরিচালক ছিলেন। ১৯৭৫ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে অমর্ত্য সেন আমার সাক্ষাত্কার নেন এবং আগস্টের শেষ দিকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করার জন্য ফোর্ড ফাউন্ডেশনের ফুল স্কলারশিপ নিয়ে লন্ডনের এলএসইতে যাই। অধ্যাপক অমর্ত্য সেন ছিলেন আমার গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট অ্যাডভাইজার এবং তখন থেকে আমরা বন্ধু।

এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সঙ্গে ১৯৭৫ সালের সাক্ষাত্ আমার জীবন ও ক্যারিয়ার বদলে দেয়। আমি এলএসইতে সত্যিকারভাবে অর্থনীতি শিখি এবং এটি আমাকে পরবর্তীতে বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় ও ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকে পেশাগত উত্কর্ষ অর্জনে দারুণভাবে সাহায্য করে। তিনি একজন শক্তিশালী নেতা ও প্রতিষ্ঠান নির্মাতা। আমার উদাহরণ এটার বড় প্রমাণ। আমরা বিআইডিএসে চার মাস একসঙ্গে কাজ করেছি। এ সময় তাঁর উপস্থাপনার দক্ষতা, ন্যায়বিচার, সততা ও যত্নশীল আচরণ তাঁর প্রতি আমার সম্মানবোধ আরো বাড়িয়েছে। বাংলাদেশ ও সাধারণ মানুষের জন্য তাঁর পরম আত্মোত্সর্গ উপলদ্ধি করতে পেরেছিলাম।

এর পর বিভিন্ন সময় আমরা বিভিন্ন ইস্যুতে বাদানুবাদ করেছি। তবে আমাদের দুজনার মধ্যে একটি বিষয় কমন ছিল, আর তা হলো বাংলাদেশের উন্নতি ও দারিদ্র্য হ্রাস। ১৯৮১ সালে আমি বিশ্বব্যাংক, ওয়াশিংটনে যোগ দিই একজন ইয়াং প্রোফেশনাল ইকোনমিস্ট হিসেবে। অধ্যাপক রেহমান সোবহান যখনই ওয়াশিংটনে এসেছেন, তখনই আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। অন্যদিকে আমি যখনই ঢাকায় এসেছি, তখনই তাঁর সঙ্গে দেখা করেছি।

অধ্যাপক রেহমান সোবহান প্রখরভাবে সাধারণ মানুষের দুঃখ -দুর্দশার প্রতি সহানুভূতিশীল। তিনি নিজ কর্মক্ষমতার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। সম্পদের পুনর্বণ্টন, আরো অধিক মাত্রায় মানসম্পন্ন শিক্ষা সুবিধাপ্রাপ্তি এবং আর্থিক খাতে আরো বেশি সুযোগ দেয়ার মাধ্যমে দরিদ্রদের ক্ষমতায়ন সম্ভব বলে তিনি বিশ্বাস করেন। উন্নয়নের ন্যায়বিচার ও দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য তাঁর নির্দেশিত অনেক পদ্ধতি নিয়ে আমার দ্বিমত রয়েছে, তবে তিনি যে চূড়ান্ত ফলাফলের সন্ধান করেন, সেটিকে সবসময় শ্রদ্ধা করি।

একজন প্রতিষ্ঠান নির্মাতা হিসেবে তার সমকক্ষ বাংলাদেশে খুব কমই আছে। নিজের শক্তিশালী নেতৃত্ব, ব্যক্তিত্ব ও কর্মী উন্নয়ন চিন্তার মধ্য দিয়ে তিনি বিআইডিএসকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে পরিচালনা করেছিলেন। বিআইডিএস থেকে তাঁর চলে যাওয়ায় সেখানে শূন্যতা সৃষ্টি হয়, যা আজো বিদ্যমান। তিনি এককভাবে সিপিডিকে শূন্য থেকে একটি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলেছেন। সিপিডিতে বিকল্প নেতৃত্বের উত্থানকে সমর্থন দিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠান নির্মাতা হিসেবে পরিপক্বতা দেখিয়েছেন।

একজন ভালো মানুষ হিসেবে তাঁর মতো লোক বাংলাদেশে খুব কমই রয়েছে। যতই আমি তাঁর সঙ্গে মিশেছি, ততই তাঁর মানবিক গুণের দেখা পেয়েছি; বেড়েছে তাঁর প্রতি আমার সম্মান। যত্নশীল ও সহযোগিতাপূর্ণ আচরণের জন্য তাঁর কাজ করা প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাঁকে ভালোবাসেন, সম্মান করেন।

তিনি কারো সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছেন বলে কখনো শুনিনি। নিজের মতের চরম বিরোধিতার মুখেও কখনো তাঁকে মেজাজ হারাতে দেখিনি।

অধ্যাপক রেহমান সোবহানের প্রতি রইল আমার সালাম।

Dr. Sadiq Ahmed

Dr. Sadiq Ahmed

Dr. Sadiq Ahmed began his career as a Lecturer in Economics at the Dhaka University in 1974 and later worked at the Bangladesh Institute of Development Studies as a Research Fellow. Dr. Ahmed did his MSc from London School of Economics and PhD from Boston University. He joined the Young ...

gog