পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ভাইস চেয়ারম্যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্নের পর একই বিভাগে যোগ দেন প্রভাষক হিসেবে। পরবর্তীতে অধিকতর উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস ও বোস্টন ইউনিভার্সিটি থেকে। পেশাগত জীবনে তিনি বিশ্বব্যাংকের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত ছিলেন। মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব এশিয়া, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল এবং বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। একা ও যৌথভাবে বই লিখেছেন বেশ কয়েকটি। অর্থনীতির নানা ইস্যু ধরে এখনো লিখছেন দেশী-বিদেশী পত্রপত্রিকায়। গ্রোথ উইথ ইকুইটি: কনটেম্পোরারি ডেভেলপমেন্ট চ্যালেঞ্জেস অব বাংলাদেশ শীর্ষক তার সদ্য প্রকাশিত বইকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ, রাজস্ব, দারিদ্র্য ও বৈষম্যসহ নানা বিষয় নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেন এ অর্থনীতিবিদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এমএম মুসা
প্রবৃদ্ধি উন্নয়ন সম্পর্কে আপনার বিশ্লেষণ কী?
এখন একটা বিতর্ক চলছে, বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি কী হয়েছে এবং কদ্দূর যাওয়া উচিত। এটা বিবেচনায় নিয়ে পুরো বিষয়টি বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছি আমার সদ্য প্রকাশিত বইয়ে। প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে আগে জানার চেষ্টা করেছি, কী হয়েছে বাংলাদেশে। প্রবৃদ্ধির অভিজ্ঞতালব্ধ অ্যাপ্রোচ হিসেবে আমি নিউক্লাসিক্যাল মডেলটাই ব্যবহার করেছি। সাধারণত এটা সবাই ব্যবহার করে। আমি প্রবৃদ্ধি হিসাব থেকে শুরু করলাম। দেখা গেল, এক্ষেত্রে শ্রমের অবদান আছে, এর মানেরও অবদান আছে। শ্রমের দুটো দিক আছে। এক. শ্রমের ভৌত প্রবৃদ্ধি (ফিজিক্যাল লেবার গ্রোথ) এবং দুই. শ্রমমান বা উৎপাদনশীলতা। বলা যায়, আমাদের প্রবৃদ্ধিতে শ্রমের দুটি দিকেরই অবদান রয়েছে। তবে প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রধানত বিনিয়োগের মাধ্যমে হওয়া ভৌত পুঁজির অবদানই সবচেয়ে বেশি। এখন আমরা নিম্ন আয় থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি। ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলংকা ও মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছে। তাদের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, যখনই কোনো দেশ নিম্ন আয় থেকে মধ্যম আয়ে উন্নীত হয়, তখন ধীরে ধীরে পুঁজির প্রয়োজনীয়তা বাড়ে এবং নিম্নমধ্যম আয় থেকে উচ্চমধ্যম আয়ে উন্নীত হয়, তখন পুঁজির প্রয়োজনীয়তা আরো বেশি বেড়ে যায়। কারণ বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশে পুঁজি ঘাটতি রয়েছে। সেখানে প্রযুক্তি কম, ভৌত উৎপাদনশীলতা কম। বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রযুক্তি, গবেষণা, উন্নয়ন, মানবসম্পদ— সব কয়টা তৈরি করতে হলে পুঁজি প্রয়োজন। সেজন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোয় প্রাথমিক পর্যায়ে পুঁজির প্রয়োজনীয়তা বাড়তে থাকবে। সেদিক থেকে বাংলাদেশেও তা বাড়বে।
বাংলাদেশেও গত ৪৪ বছরে প্রবৃদ্ধির প্রাথমিক চালক হিসেবে পুঁজির সঞ্চয়নই সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে। ১৯৭২ সালে সাড়ে ৩ থেকে প্রবৃদ্ধি এখন সাড়ে ৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এখন সপ্তম পঞ্চবার্ষিকীর পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সাড়ে ৬-৭ থেকে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হারে যেতে হলে অনেক কিছুই লাগবে। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, পুঁজি। এক্ষেত্রে বিনিয়োগ হার বাড়ানোর বিকল্প নেই। বিবিএসের হিসাবে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সরকারি বিনিয়োগ ২৯ শতাংশ ছিল। আমি মনে করি, এটা বড়জোর হবে ২৭ শতাংশ। ন্যূনতম ৭-৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে যেতে হলে আমাদের সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী মেয়াদের মধ্যে অতিরিক্ত ৫-৬ শতাংশ বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এটাই হচ্ছে প্রবৃদ্ধির প্রধান উপাদান।
বিনিয়োগ সম্পর্কে কিছু বলুন…
সরকারি-বেসরকারি উভয় বিনিয়োগই দেশে দরকার। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সরকারি বিনিয়োগের পাশাপাশি ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ ভালোভাবেই এসেছে। তবে সেটি এখন কিছুটা স্থবির হয়ে পড়েছে। চার-পাঁচ বছর ধরে ব্যক্তি বিনিয়োগ ২১-২২ শতাংশের মধ্যে আছে। হয়তো ১-২ শতাংশ বেড়েছে। এর বেশি নয়। এটা একটা প্রধান বাধা। আর সরকারি বিনিয়োগ কিছুটা বেড়েছে। তবে বাড়লেও বড়জোর ৬ শতাংশের কাছাকাছি। ৬ শতাংশ বিনিয়োগ দিয়ে যে ধরনের জ্বালানি, অবকাঠামো ও মানবসম্পদ প্রয়োজন, তা পূরণ করা যাবে না। সেদিক থেকে সরকারি-বেসরকারি উভয় বিনিয়োগই বাড়ানো প্রয়োজন। এজন্য দরকার রিসোর্স মবিলাইজেশন। সরকারি খাতে অন্তত জিডিপির ২-৩ শতাংশ বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এটা অর্জন করতে হলে কর আহরণ জিডিপির ১০ শতাংশ বাড়িয়ে ১৩-১৪ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। অন্যদিকে ব্যক্তিখাতে এফডিআই বাড়াতে হবে।
কেবল বিনিয়োগ দিয়েই কি কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব?
অবশ্য শুধু বিনিয়োগ দিয়েও সম্ভব হবে না কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন। এটি ছাড়াও শ্রমশক্তির দক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন। শ্রমশক্তির ক্ষেত্রে আমি সংখ্যার দিক থেকে সুবিধা দেখছি। এখন আমরা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডে রয়েছি। দেখা যাচ্ছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় শ্রমশক্তির বৃদ্ধি বেশি। তথ্য বলছে, বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২ শতাংশ আর শ্রমশক্তি বৃদ্ধির হার ২ দশমিক ৯ বা প্রায় ৩ শতাংশ। উন্নয়নশীল দেশের জন্য শ্রমশক্তি বৃদ্ধির এ হার নিঃসন্দেহে ভালো। তার মানে নির্ভরতার অনুপাত কমে যাচ্ছে। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী বাড়ছে। আরেকটি মাত্রা হলো, নারীদের অংশগ্রহণের হার খুব কম। এটা এখনো ৩৪ শতাংশ। এটাকে ৬০-৭০ শতাংশে আনা গেলে শ্রমশক্তি আরেকটু চাঙ্গা হবে। প্রবৃদ্ধির ওপর এর প্রভাবও ইতিবাচক হবে। কিন্তু শুধু পরিমাণ দিয়ে হবে না। নিশ্চয়ই এটা ইতিবাচক মাত্রা। এটাকে আরো ইতিবাচক করতে বিনিয়োগ লাগবে। বিনিয়োগ হলে তাদের উৎপাদনশীলতা বাড়বে। অন্যথায় তারা নিম্নআয়ের কাজে চলে যাবে। লোকজন ছোটখাটো ব্যবসায় চলে যাবে। এটা তো এক ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। সময় দিচ্ছে, কিছু আয় হচ্ছে। কিন্তু সার্বিকভাবে উৎপাদনশীলতা খুবই কম। বরং উচ্চ আয়ের কর্মসংস্থানে যেতে হলে তাদের যথাযথ মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এটা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া, তাত্ক্ষণিকভাবে হবে না।
সাধারণত দেখা গেছে, দেশ যত উন্নত হবে জনগণকে তত শিক্ষিত হতে হবে। সাক্ষরতার হার ১০০ শতাংশ হতে হবে। আর শ্রমশক্তির ন্যূনতম স্নাতক পর্যন্ত শিক্ষা লাগবে। তারপর প্রশিক্ষণের কথা আসছে। কিছু ড্রপআউট হবে। তবে মোটামুটি ৯০ শতাংশ শ্রমশক্তি যদি উচ্চ মাধ্যমিক পাস হয়, তবে এটা হবে এক বিরাট অর্জন। এজন্য আমি জোর দিয়েছি শ্রমশক্তির সংখ্যা ও মানের ওপর। প্রথমে সবার জন্য ন্যূনতম শিক্ষা, তার পর বিশেষায়িত শিক্ষা এবং শেষে বাজার-সম্পর্কিত দক্ষতা উন্নয়ন। যেমন— পোশাক খাতের মালিকরা শ্রমিকদের প্রশিক্ষিত করে নিচ্ছে। কিন্তু যারা নতুন যোগ দিচ্ছে, বেশির ভাগই দেখা গেছে নবম ও দশম শ্রেণী পড়া। কৃষি থেকে যারা চলে আসছে, তাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি হলো, ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করে বাইরে চলে আসছে। বিদেশে যারা গেছে, তারা নিম্ন আয়ের কাজ করছে। তাদের রিটার্ন খুবই কম। অথচ ভারত, ফিলিপাইন কিংবা শ্রীলংকা থেকে যারা গেছে, তাদের দক্ষতা অনেক ভালো। এখন দক্ষতা উন্নয়নে আমাদের প্রত্যেকের জন্য ন্যূনতম শিক্ষা দরকার। সেদিক থেকে শতভাগ সাক্ষরতা প্রয়োজন। একই সঙ্গে গুণগত শিক্ষাও দরকার। তার পর প্রশিক্ষণ। এক্ষেত্রে চারটা এজেন্ডা আছে— ১. সম্প্রসারণ ২. মান ৩. অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং ৪. দক্ষতা। বাংলাদেশ এখন কৃষি থেকে উৎপাদন (ম্যানুফ্যাকচারিং) খাতে উন্নীত হচ্ছে। কৃষি থেকে উৎপাদন খাতে যেতে হলে এ শ্রমশক্তি দিয়ে হবে না। কেননা কৃষি শ্রমিক ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে খাপ খাবে না। সেখানে শ্রমিকের চাহিদা থাকবে, অথচ তারা ঢুকতে পারবে না। ফলে অসঙ্গতি তৈরি হবে, অনেক ক্ষেত্রে হচ্ছেও বটে।
দেশে অনানুষ্ঠানিক খাতে শ্রমশক্তি বেশি— এ বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?
এখনো অনানুষ্ঠানিক খাতে আমাদের অনেক শ্রমশক্তি আছে। এদের আনুষ্ঠানিক খাতে আনার দায়িত্ব আমাদের সরকার ও ব্যক্তিখাতের। তবে এক্ষেত্রে যা দরকার তা হলো, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন। এজন্য আমি এর ওপর জোর দিয়েছি। সব যে সরকার করবে তা নয়, কিছু ক্ষেত্রে চাকরিদাতাদেরও উদ্যোগ নিতে হবে। এটা দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ এবং দেশের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হবে।
দেশের প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে হলে প্রাযুক্তিক অগ্রগতিও প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
বিশ্লেষণ করে দেখেছি, আমাদের প্রাযুক্তিক অগ্রগতি খুবই দুর্বল। আমাদের উৎপাদনশীলতায় প্রযুক্তির অবদান খুবই কম। কারণ আমাদের প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগের কার্যকারিতা তেমন নেই বললেই চলে। উপরন্তু এজন্য নেই প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান। তবে একটি ভালো উদ্যোগ হলো, ডিজিটাল বাংলাদেশ। এ উদ্যোগকে যদি ভালোভাবে এগিয়ে নেয়া যায়, তাহলে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সম্ভব হবে। সম্প্রতি কিছু ভালো কাজ হয়েছে, তবে আরো দ্রুত এগোতে হবে। প্রযুক্তি উন্নয়নের আরেকটি ভালো উপায় হচ্ছে, এফডিআইয়ের ওপর জোর দেয়া। এফডিআই বিদেশী মূলধন ছাড়াও প্রযুক্তি নিয়ে আসে। একটি ভালো উদাহরণ হলো, কোরিয়ার উঅঊডঙঙ ফার্ম বাংলাদেশে নতুন আরএমজি প্রযুক্তি নিয়ে এসেছিল। এর প্রভাবে বাংলাদেশে পোশাক খাত অনেক উন্নতি করেছে।
বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা নিয়ে কিছু বলুন…
প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন একটি দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ। আমরা রাজনৈতিক বলি, অর্থনৈতিক বলি, বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানকে জোরদার করা দরকার। সুতরাং এখানে একটা বেশ লম্বা গ্যাপ আছে। এ নিয়েও বিতর্ক আছে যে, প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন বাড়ায় নাকি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের উত্থান ঘটায়। আমি মনে করি, এটা এনডোজেনাস ভেরিঅ্যাবল। প্রতিষ্ঠান সব সরকার করবে তা হয় না, এর চাহিদাও আসতে হয়। এটা ব্যক্তিখাত থেকেও আসবে। এটি বিবর্তনমূলক প্রক্রিয়া। উন্নয়নের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান বদলাতে হয়। প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের লক্ষ্যে আমরা আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার ওপরও নজর দিতে পারি। অনেক উন্নত দেশে বেশকিছু উন্নত উপায়ে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে উঠেছে, আমরা সেখান থেকে শিখতে পারি। মূলকথা হলো, আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনাগুলো এমনভাবে করতে হবে যেন নাগরিকদের কল্যাণ সুরক্ষিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, আইনের শাসন, সমান সুযোগ-সুবিধা ও জানমাল রক্ষা ইত্যাদি।
প্রবৃদ্ধির বড় চালক হিসেবে কাজ করেছে পুঁজি। সেক্ষেত্রে আমাদের পুঁজি ব্যবহারের কার্যকারিতা নিয়ে আপনার মত কী?
এখানে কয়েকটি বিষয় আছে। একটি হচ্ছে, সরকারি খাত ও ব্যক্তিখাত। পুঁজি সঞ্চয়ন এখন বেশির ভাগই ব্যক্তিখাতে। সে হিসাবে ব্যক্তিখাতই আমাদের প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগের প্রাথমিক চালক। আর সরকারি খাত কেবল সহযোগী ভূমিকা পালন করছে। প্রথমে ব্যক্তিখাতে আসা যাক। ব্যক্তিখাত হলেই যে সব দক্ষ, কার্যকর হবে, তা ঠিক নয়। এর কার্যকারিতা বাড়াতে হলে সরকারকে উন্নয়নমূলক সিগন্যাল দিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, একটি সিগন্যাল হলো, বাণিজ্য সুরক্ষা (ট্রেড প্রটেকশন) কমাতে হবে এবং প্রতিযোগিতা থাকতে হবে। প্রতিযোগিতা না থাকলে বাণিজ্য সুরক্ষার অধীনে যে বিনিয়োগ হবে, তার উৎপাদনশীলতা হবে কম। কারণ প্রতিযোগিতা না থাকলে মনোপলি তৈরি হবে। ফলে যে খরচেই পণ্য তৈরি করুক না কেন, আমাদের তা কিনতে হবে। সেজন্য সুষ্ঠু বাণিজ্যনীতির দরকার। তার পর অবকাঠামো প্রাপ্যতার ইস্যু আছে। ব্যক্তিখাতের উদ্যোক্তা হিসেবে আমি ফ্যাক্টরি করে বসে থাকলাম। বিদ্যুত্ সংযোগ পেলাম না। একটা প্রজেক্ট শুরু করলাম, মাঝখানে গ্যাস পেলাম না। যাওয়ার রাস্তা নেই। পানি পেলাম না। স্বাভাবিকভাবে আমার কার্যকারিতা কমে যাবে। সুতরাং ব্যক্তিখাতের কার্যকারিতা অনেকটা নির্ভর করে সরকারি নীতির ওপর। একইভাবে আমি মনে করি, বাণিজ্য নীতি সংশোধন, রাজস্ব নীতি সংস্কার ও অবকাঠামো উন্নয়ন করে ব্যক্তিখাতের কার্যকারিতা আরো বাড়ানো যেতে পারে।
আর সরকারি খাতে তো স্পষ্টত অনেক ইস্যু আছে। যেমন— বৃহত্ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে দেরি হচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রায় ১১ বছর হয়ে গেছে। ব্যয় তো আছেই, কিন্তু সময়ের যে ব্যবধান হলো, তার কী হবে। এখানে আমাদের ট্রান্সফরমেশনাল প্রজেক্টগুলোর ওপর জোর দিতে হবে। কারণ সরকারের বাস্তবায়ন ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা আছে। বিদ্যুত্, সমুদ্রবন্দর, ব্রিজ ও জাতীয় হাইওয়ের মতো বড় বড় ৮-১০টি ট্রান্সফরমেশনাল প্রজেক্টের ওপর সরকারকে জোর দিতে হবে। এসব প্রজেক্ট সময়সীমা বেঁধে দিয়ে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। যাদের সঙ্গে চুক্তি হবে তাদের সময়সীমা নির্ধারণ করে দিতে হবে এবং ওই সময়সীমার ব্যত্যয় ঘটলে জরিমানার ব্যবস্থা করতে হবে। এ মানসিকতা নিয়ে না এগোলে, সময়কে গুরুত্ব না দিলে আমাদের অগ্রগতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বইয়ে আপনি শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হলে প্রকৃত মজুরির দিকে নজর দিতে হবে বলেছিলেন…
আমি যেটা বলেছি তা হলো, উৎপাদনশীলতা বাড়লে প্রকৃত মজুরি এমনিতেই বাড়বে। এ কারণে বলেছি, শ্রমবাজার কীভাবে কাজ করে সেটা দেখেছি। প্রকৃত মজুরির বিষয়টি মোটামুটিভাবে উৎপাদনশীলতায় নিবদ্ধ। উৎপাদনশীলতা বাড়লে প্রকৃত মজুরি বাড়বে— সেটা কৃষি, আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক খাত হোক। সামষ্টিক দরকষাকষি (কালেক্টিভ বার্গেইনিং), ন্যূনতম মজুরি সবসময় যে দরকার হবে তা নয়। কিছু ক্ষেত্রে হয়তো লাগবে। কিন্তু প্রাথমিক চালক যেটাকে আমি বলছি, সেটা হলো উৎপাদনশীলতা।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কিন্তু শিল্পে দক্ষ জনশক্তি জোগান দিতে সক্ষম হচ্ছে না….
সেজন্য আমি বলছি, এক্ষেত্রে প্রথম প্রাধিকার হওয়া উচিত সবার জন্য উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা নিশ্চিত করা। এটা নিয়ে কোনো আপস হওয়া উচিত নয়। তার পর ১২ বছর পর কে বিজ্ঞানী হবে, কে প্রকৌশলী হবে, কে চিকিত্সক বা অর্থনীতিবিদ হবে— সেটা নির্ভর করে তার অন্তনির্হিত সামর্থ্যের ওপর। সবাই সব ক্ষেত্রে যেতে পারবে না। তবে সামগ্রিকভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে জোর দিতে হবে। আর গবেষণা ও উন্নয়নে জোর দিতে হবে। এদিকে সরকারের সক্রিয়তা দরকার।
আপনার বইয়ে আয়বৈষম্য নিয়ে একটা অধ্যায় আছে। এখানে কী বলতে চেয়েছেন?
এখানে আমি পর্যালোচনা করেছি, বাংলাদেশে গত ৪৪ বছরে কী ধরনের উন্নয়ন হয়েছে। প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, দারিদ্র্যও কমেছে। মানবসম্পদের উন্নয়ন হয়েছে। মানুষের জীবন প্রত্যাশা বেড়েছে। শিক্ষাহার বাড়ছে। নারীর ক্ষমতায়ন ঘটেছে। এগুলো ইতিবাচক দিক। এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। কিন্তু আপেক্ষিকতা বিবেচনা করলে দেখা যাবে, আয়বৈষম্য বেড়েছে। সরকারি তথ্যেই তা দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশে আয়বৈষম্য বেড়েছে। কোনো দেশে অতিদারিদ্র্য অত্যধিক মাত্রায় থাকলে তখন মনোযোগটা থাকে তা কমাতে। বাংলাদেশেও তা-ই হয়েছে। ফলে এখন ধীরে ধীরে অতিদারিদ্র্য কমে যাচ্ছে, এখন বাড়ছে আপেক্ষিক দারিদ্র্য (রিলেটিভ পভার্টি)। মানুষের শুধু পেটভরে ভাত খেলে হবে না, জীবনমানের উন্নয়নও নিশ্চিত করতে হবে। সুতরাং নিছকই শুধু ক্ষুধা নিবারণ একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের নির্দেশক নয়। দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে একদিকে বস্তি, অন্যদিকে উঁচু দালান। এ ধরনের গ্যাপ বাড়লে সেটি সামাজিক অস্থিরতার কারণ হতে পারে। এজন্য আয়বৈষম্য কমানোর চেষ্টা করতে হবে। অন্তত চেষ্টা করতে হবে আয়বৈষম্য যাতে আর না বাড়ে।
কীভাবে কমানো সম্ভব?
এক্ষেত্রে যেটা প্রয়োজন তা হলো, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক কল্যাণের ওপর জোর দিতে হবে। সুইডেন, নরওয়েসহ ইউরোপের অনেক দেশই এটা করেছে। আর রাজস্ব নীতি পরিবর্তন করেছে। এক্ষেত্রে তা পুনর্বণ্টনমূলক রাজস্ব নীতি প্রণয়ন করেছে। তারা ধনীদের ওপর করারোপ করেছে এবং দরিদ্রের ওপর ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে। সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতের মাধ্যমে আয় ট্রান্সফার করেছে। বাংলাদেশও এ পথ অনুসরণ করতে পারে। এক্ষেত্রে সামাজিক সুরক্ষা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে রাষ্ট্রের যথাযথ ব্যয় করতে হবে। এটা নিশ্চিত করলে অরক্ষণীয় জনগোষ্ঠীর সামাজিক সুরক্ষা থাকবে, আয়বৈষম্য কমবে। আবার মানবসম্পদ উন্নয়নের ওপর জোর দিতে হবে। এতে গরিবদের আয় বাড়বে। ফলে সার্বিকভাবে আয়বৈষম্য কমবে।