নীতিনির্ধারণ সঠিক হলেও সময় নির্ধারণটা ভালো হয়নি

একটি তুলনামূলক সংকটজনক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ মুদ্রানীতি (মানিটারি পলিসি স্টেটমেন্ট বা এমপিএস) প্রকাশিত হয়েছে।

সংকট কাটাতে ইউরোপে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া এখনো চলমান এবং অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ইউরো অঞ্চলকে সচল করে তুলতে নেয়া এসব পদক্ষেপের প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতিতে পড়বে; যা থেকে উন্নত, উদীয়মান ও উন্নয়নশীল কোনো দেশই বাদ যাবে না। এ বাস্তবতায় বিশ্ব অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। চলতি বছর বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কেমন হবে— এ নিয়ে সংস্থাটি গত মাসে তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যাতে বলা হয়েছে, ২০১২ সালে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হবে ৩ দশমিক ৩ শতাংশের মতো। অথচ ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত সংস্থাটির ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকে ২০১২ সালে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশ হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। বিশ্ব বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে আগেরটিতে যে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল, নতুন প্রতিবেদনে সেটি প্রায় ২ শতাংশ পয়েন্ট কমিয়ে আনা হয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতি ও বাণিজ্যসংক্রান্ত এ ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ইঙ্গিত করে তা হলো, চলতি মুদ্রানীতি নিয়েই আমাদের রফতানি খাতকে বাইরের প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলা করতে হবে। উল্লেখ্য, সম্প্রতি এ দেশের কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আয় প্রবৃদ্ধিতে এ খাতটির অবদানই সবচেয়ে বেশি। গত অর্থবছরে আমরা এ খাতের অসাধারণ পারফরম্যান্স লক্ষ করেছি। এ সময় রফতানি খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৪১, যা গত ছয় মাসে কমে ১৪ দশমিক ৭ শতাংশে দাঁড়ায় (২০১১ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বরে)। শতকরা হিসাবে রফতানি অনেকটা কমেছে মনে হলেও যেকোনো বিচারেই এটি একটি সন্তোষজনক রফতানি প্রবৃদ্ধি।

আগামী ছয় মাসে রফতানি প্রবৃদ্ধি আরও কমতে পারে। এর কারণ দুটো— প্রথমত. ইউরোপে শয্যাশায়ী অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যের পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া চলছে। স্বভাবতই এ চিকিত্সা চলাকালে এখানকার দেশগুলো আমদানির পরিমাণ কমিয়ে দেবে। দ্বিতীয়ত. যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া ভালোভাবে চললেও রোগীর জ্ঞান ফিরে এসেছে মাত্র; দেহ এখনো রক্তশূন্য।

এমন পরিস্থিতে নতুন মুদ্রানীতিকে একটি সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে স্বীকার করতেই হবে। এর নিপুণতার দিকটিও অস্বীকার করা যাবে না। এতে আগামী ছয় মাসে মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিভিন্ন প্রায়োগিক দিকেও বেশ জোর দেয়া হয়েছে। ২০১০ সালের জুলাইয়ে যে মুদ্রানীতিটি ঘোষণা করা হয়, সেটির মূল্যায়ন করতে গিয়ে আমি বলেছিলাম, মূল্যস্ফীতির ভূতকে সামলাতে চাইলে ব্রডমানি (এম২) মুদ্রার সরবরাহ জরুরি ভিত্তিতে কমাতে হবে। যারা প্রকৃত অর্থেই কনজিউমার প্রাইস ইনডেক্সের (সিপিআই) ব্যাপারে নিয়মিত খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন বহু আগেই ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতির যুগ শেষ হয়েছে। ২০০৪ সালের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ২০১০ সালে দাঁড়ায় ৯ শতাংশে। এটি মনস্তাত্ত্বিকভাবে দুই অঙ্কের কোটায় পৌঁছে ২০১১ সালে। কেউ অভিযোগ করতে পারবেন না, এ সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়াকে বাগে আনার চেষ্টা করেনি। এও স্বীকার করতে হবে, প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এ ক্ষেত্রে তাদের সাফল্য ছিল সামান্যই। মূল্যস্ফীতি উপশমে মুদ্রানীতিতে যেসব কৌশল ও লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, সেগুলো ভুল ছিল না। তবে জটিলতা হলো, এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্জনগুলো লক্ষ্যমাত্রার ধারে কাছে যেতে পারেনি। বিষয়টিকে এয়ারগান শুটিংয়ের সাহায্যে বোঝানো যেতে পারে। লক্ষ্যভেদের পরীক্ষায় শুটারদের জন্য টার্গেট থাকে বুলস আই। এটিকে মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরলে বলতে হবে, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক যত গুলি ছুড়েছে, সেগুলো বুলস আইয়ে লাগেনি। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ২০১১ সালের জুলাই-ডিসেম্বর মুদ্রানীতি। এ সময় প্রথমবারের মতো লক্ষ্যভেদ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

যে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতিতে হাতের অস্ত্র যথাযথ প্রয়োগ করতে পেরেছিল কি না। এর জবাবে বলতে হয়, একই সঙ্গে প্রবৃদ্ধি বাড়ানো ও মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরা মোটেই সহজ নয়। স্পষ্টত এ দুটি বিষয়ের ট্রেড অফ সম্পর্ক রয়েছে; অর্থাৎ একে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত। দেখা গেছে, মূল্যস্ফীতি কমাতে গেলে প্রবৃদ্ধিও কমে যায়। আবার প্রবৃদ্ধির সঙ্গে কিছুটা মূল্যস্ফীতি এমনিতেই বাড়ে। প্রবৃদ্ধিও বাড়বে ও মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে থাকবে— এমন ভারসাম্যপূর্ণ মুদ্রানীতি প্রণয়ন বেশ কঠিন। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অতীত ব্যর্থতা অনেক। গত তিন বছরে ব্রডমানি (এম২) প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রায় রাখতে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। লক্ষ্যমাত্রা ১৬ থেকে ১৮-এর মধ্যে নির্ধারণ করা হলেও এ সময় বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ২৪-২৬ শতাংশ। অনুমান করতে পারি, উল্লিখিত সময়ে নেয়া মুদ্রানীতিটির উদ্দেশ্য ছিল, মূল্যস্ফীতি খানিকটা বাড়ে তো বাড়ুক; বেসরকারি খাতচালিত প্রবৃদ্ধি যেন বজায় থাকে। উদ্দিষ্ট প্রবৃদ্ধি ভালো হারে অর্জিত হলেও তখন অর্থপ্রবাহ সহজ করে দেয়ার বাবল সৃষ্টি হয় শেয়ারবাজারে।

আরব্য রজনী’র কলস দৈত্যের গল্প অনেকেরই জানা। জেলের জালে মাছের বদলে উঠে আসে এক কলস। ঢাকনা খোলার পর সেখান থেকে বের হয় এক দৈত্য। তার প্রতিজ্ঞা ছিল, যে তাকে উদ্ধার করবে দৈত্য তাকে হত্যা করবে। এ অবস্থায় জেলে দেখল, পরিত্রাণের উপায় একটাই। তা হলো, দৈত্যকে আবার কলসস্থ করা। শেষে ভুলিয়ে-ভালিয়ে দৈত্যকে কলসে ঢুকিয়ে বেঁচে যায় জেলেটি। সমস্যা হলো, আমাদের অর্থনীতির কলস থেকে মূল্যস্ফীতির যে দৈত্য বেরিয়েছে, তাকে আবার কলসস্থ করা কঠিন। তবে কাজটি একেবারেই অসম্ভব, তা নয়। সে ক্ষেত্রে প্রকৃত অর্থনীতির কিছুটা ক্ষতি মেনে নিতেই হবে, যা বিভিন্ন কারণে আমাদের পক্ষে এ মুহূর্তে দুরূহ।

দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে কয়েকটি অতিরিক্ত জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি রাজস্ব ব্যয় হয়েছে। এর সঙ্গে এসে জুড়েছে খারাপ ব্যালেন্স অব পেমেন্ট পরিস্থিতি। এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে মূলধনি ও আর্থিক হিসাবে। বেশির ভাগ প্রতিশ্রুত বৈদেশিক সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে না। এ কথায় অনেকে আপত্তি জানাতে পারেন, বৈদেশিক সহায়তা তো আমরা পাচ্ছি। তা সত্য, কিন্তু কথা হলো যেখানে দরকার কয়েক লিটার পানি, সেখানে মাত্র কয়েক ফোঁটা পাচ্ছি আমরা। বিশ্ব অর্থনীতি ও অভ্যন্তরীণ এসব কারণে চলতি মুদ্রানীতি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা খুব একটা সহজ হবে না।

অনেকে বুঝে না বুঝে প্রশ্ন তোলেন, এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক করছেটা কী? তাদের কাজই তো মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন! তাত্ত্বিকভাবে মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন করা যত সহজ, বাস্তবে বিষয়টি মোটেই তেমন নয়। তার পরও প্রথমবারের মতো গত ষাণ্মাসিক মুদ্রানীতিতে ব্রডমানি (এম২) প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটি সম্ভব হয়েছে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে, রিজার্ভ মুদ্রার প্রবৃদ্ধি নির্দিষ্ট সীমায় রেখে এবং কিছু ক্ষেত্রে বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ কমিয়ে; যাতে চলতি ও মূলধনী হিসেবে সম্প্রতি সৃষ্ট নিম্নগামী প্রবণতা রোধ করা যায়। আমাদের দেশে মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধক হলো সরকারি ঋণ। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে মুদ্রানীতি বাস্তবায়নেও বড় সমস্যা ছিল সরকারি ঋণ ব্যবস্থাপনা। এ সময় লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ৪০ শতাংশ বেশি ঋণ নেয় সরকার। আরেকটি সমস্যা ছিল, বিদ্যুৎ খাতে বিরাট ভর্তুকি। এর প্রধান কারণ ছিল, বেশি খরচের রেন্টাল ও ছোট বিদ্যুৎ উত্পাদন কেন্দ্রগুলো। এ কেন্দ্রগুলো পরিচালনায় এ সময় বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ পেট্রোলিয়ামও আমদানি করা হয়।

নিকট অতীতের এ পারফরম্যান্স থেকে আভাস মেলে— চলতি ছয় মাসের মুদ্রানীতি বাস্তবায়নে আমাদের কেমন প্রত্যাশা থাকা উচিত। নতুন মুদ্রানীতিতে যেসব লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে, সেগুলো দেশে বিদ্যমান মুদ্রা ব্যবস্থাপনার চূড়ান্ত লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আবারও বলছি এ অবস্থায় মূল চ্যালেঞ্জ হলো, দৈত্যকে কলসস্থ করা; মূল্যস্ফীতিকে আবার এক অঙ্কের কোটায় নামিয়ে আনা। ২০১১-১২ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতিকে রেফারেন্স ধরা হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকৃত লক্ষ্যমাত্রা বাজেটে উল্লেখ ছিল না। মনে হয়, এমন স্থির ও যথাযথ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে না পারাটা বাংলাদেশ ব্যাংকের ছোটখাটো ব্যর্থতার অন্যতম। সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ সামলানো এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি। প্রধানত এটি না করতে পারায়ই গত তিন বছর প্রাক্কলিত মুদ্রা প্রবৃদ্ধিতে লক্ষ্য ভেদ করা যায়নি। ফলে মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের গোড়া থেকেই সতর্ক থাকতে হবে। মূল্যস্ফীতিকে বশে আনতে চাইলে প্রয়োজনে তিক্ত পদক্ষেপ নিতেও কসুর করা যাবে না। ভাববেন না, এই বলে আমি বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ আরও সংকোচনের পরামর্শ দিচ্ছি। অবশ্য এরই মধ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ অব্যাহত রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথেষ্ট সুযোগ রেখেছে। এদিকে সমন্বয়মূলক কর্মসূচির অধীন বেসরকারি খাত, বিশেষ করে ব্যাংক খাতে চাহিদা ব্যবস্থাপনায় নেয়া হয়েছে সংকোচনমূলক নীতি। খেয়াল রাখা দরকার, যাতে এটি ব্যাংক খাতের ওপর বোঝা হয়ে চেপে না বসে। গত দুই অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ২৪-২৬ শতাংশ। চলতি মুদ্রানীতিতে পরিকল্পনা রয়েছে প্রাথমিকভাবে এটিকে ১৬ শতাংশে সীমাবদ্ধ রাখার। এতে ব্যাংকব্যবস্থার তারল্য বেরিয়ে আসবে ও কার্ব ঋণে সুদের হার বাড়বে। এর সুফল মিলবে আমদানি চাহিদা ও বিনিময় হারে চাপ কমার মধ্য দিয়ে। এভাবে ২০১১ সালের ডিসেম্বরের বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার এবং রিজার্ভের কাছাকাছি পৌঁছানো সম্ভব হবে।

বারবার নেয়া সরকারি ঋণ নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নিতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই। তাদের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের ঘাটতির কথা একসময় শোনা যেত। এরই মধ্যে সেটির উন্নতি ঘটেছে বলে জানা যায়। সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণে সুসম্পর্কটিকে কাজে লাগাতে হবে। চলতি অর্থবছরে আমাদের ভর্তুকির পরিমাণ জিডিপির ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। এটিসহ রাজস্ব ঘাটতি ৫ দশমিক ৫ থেকে বেড়ে ৬ শতাংশে দাঁড়াতে পারে। এমন অবস্থায় কী উপায়ে এসব খাতে অর্থায়ন করা হবে, সেটি নিয়ে রাজস্ব ও মুদ্রানীতিসংশ্লিষ্টদের মাথাব্যথা থাকার কথা। একটি পথ হতে পারে অভ্যন্তরীণ উত্সগুলো। বিদেশী অর্থায়ন কমার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দুঃসময়ের বন্ধু এখন এটিই। তবু বিদ্যমান বাস্তবতায় এভাবে অর্থ জোগানো সহজ হবে না। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ২০১১-এর জুলাই-ডিসেম্বরে গৃহীত মোট ঋণের ৬২ শতাংশ সরকারি খাতের ঋণকে ২০১২ সালের জানুয়ারি-জুনে ৩১ শতাংশে নামানো সহজ নয়। রাজস্ব ঘাটতির অর্থায়ন রোধে গৃহীত পদক্ষেপে কম রিটার্নযুক্ত ট্রেজারি বন্ডের ভারে প্রাইমারি ডিলার ব্যাংক নুয়ে পড়ছে দেখলেও আশ্চর্য হবেন না, এতে ব্যাহত হবে বেসরকারি বিনিয়োগে অর্থ সরবরাহ। এমন পদক্ষেপ ব্যাংকব্যবস্থা থেকে নিরাপত্তার চাদর খুলে নেয়ার মতো। বিদ্যুৎ ঘাটতি ও ভর্তুকির বিষয় তো রইলই। এ অবস্থায় চলতি মুদ্রানীতির সহায়তায় মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ও প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে সামষ্টিক অর্থনীতির সুব্যবস্থাপনা একটি চ্যালেঞ্জই বটে।

গত কয়েক বছরে মোটামুটি সহজ মুদ্রানীতিই দেখেছি আমরা। পণ্য ও সেবা উত্পাদনের (নমিনাল জিডিপি) তুলনায় এতে ব্রডমানির প্রবৃদ্ধিই বেড়েছে। চলতি মুদ্রানীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক মূলত বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ তথা মুদ্রা সরবরাহ প্রবৃদ্ধিতে স্পষ্টতই গতিরোধক বসাতে চাইছে। এমন পদক্ষেপের সমালোচনা না করেও বলা যায়, চাহিদা সংবরণমূলক (ডিমান্ড রিস্ট্রেইন্ট) চলতি মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের জন্য ভুল সময়কে বেছে নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের বড় দুই রফতানি বাজার ইউরোপ ও আমেরিকা সম্প্রতি চাহিদা সংবরণ করে ঋণের বোঝা লাঘবের চেষ্টা চালাচ্ছে। এদিকে বেকারত্ব বাড়ছে অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টভুক্ত (ওআইসিডি) কয়েকটি দেশে। দ্রুত আরোগ্য লাভে রাজস্বনীতিতে মিতব্যয় ও মুদ্রানীতিতে চাহিদার সংবরণকে ওষুধ হিসেবে প্রেসক্রাইব করা হয়েছে সমস্যাগ্রস্ত ইউরোপীয় দেশগুলোয়। যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির শতভাগই এখন সরকারি ঋণ। দেশটিতে ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিক উভয় দলের সম্মতিতে সরকারি ব্যয় সংকোচনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এরই মধ্যে। ভালো হতো আমাদের অর্থনীতিকে এসব তিক্ত ওষুধ আগেই খাওয়ানো গেলে। এখন সুস্থ দেহে এসব খাওয়ালে অসুস্থ হয়ে পড়ার ভয় রয়েছে। শঙ্কা জাগে, এ ক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগ ও ব্যাংকব্যবস্থা প্রথম ক্ষতির শিকার হবে কি না। এতে প্রবৃদ্ধিও কমে যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকও বলছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি আগের প্রাক্কলিত ৭ শতাংশ থেকে কমে এ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ হতে পারে। তবে মূল্যস্ফীতির দৈত্যকে ফের কলসস্থ করতে দরকার কয়েক বছর ধারাবাহিকভাবে শক্ত হাতে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ। এমন অভিপ্রায় সরকারের রয়েছে কি না, জানা নেই। নীতিনির্ধারকদের মাথায় রাখতে হবে, দীর্ঘ মেয়াদে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বজায় রাখা হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ। বেসরকারি খাতের গতিশীলতা ও বিকাশের ক্ষেত্রে এ ধরনের নীতি বাস্তবায়নে তাই সাবধানতা অবলম্বন অপরিহার্য।

লেখক: অর্থনীতিবিদ ও চেয়ারম্যান, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট

Dr. Zaidi Sattar

Dr. Zaidi Sattar

Dr. Sattar is the Chairman and Chief Executive of Policy Research Institute of Bangladesh (PRI) since its founding in 2009. PRI is a leading think tank in Bangladesh. Dr. Sattar began his career in 1969 as member of the elite Civil Service of Pakistan (CSP), and later worked in the ...

gog