টেলিফোন সেবা খাতে বিশেষত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়ের অবতারণা হয়েছে সম্প্রতি। কিছু খবর ও প্রতিবেদন মিডিয়ায়ও এসেছে। সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত ঘটনাবলি এ খাতের বিকাশের জন্য ক্ষতিকর বললে বোধহয় ভুল হবে না। এখানে স্মরণে রাখা প্রয়োজন, টেলিফোন খাত হচ্ছে বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের অন্যতম বড় ক্ষেত্র। এ পর্যন্ত দেশে যে পরিমাণ বৈদেশিক বিনিয়োগ হয়েছে, তার একটা বড় অংশই এসেছে এ খাতের সুবাদে। পরিসংখ্যান বলে, সাম্প্রতিক সময়ে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী খাতও এটি। সরকারের রাজস্ব আয়ের যে কয়টি বড় ক্ষেত্র রয়েছে, টেলিফোন শিল্প তার অন্যতম। সর্বোপরি প্রযুক্তির প্রসারে এর ব্যাপক ভূমিকা মানুষের কাছে টেলিফোনকে অপরিহার্য পণ্যে পরিণত করেছে। প্রাত্যহিক জীবন যাপন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও আনুষঙ্গিক কাজে টেলিফোনের ব্যবহার বেড়েছে। বাঙালি জীবনের একটি অংশে পরিণত হয়েছে এটি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে গুরুত্বপূর্ণ এ সেবা খাতকে কেন্দ্র করে যেসব খবর পাওয়া যাচ্ছে, তা এ খাতে নতুন বিনিয়োগ ও সম্প্রসারণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এটা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। অন্যান্য শিল্প, বিশেষত বৈদেশিক বিনিয়োগনির্ভর শিল্প ও সেবা খাতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যান্য খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগ আসবে কি না, তা এ খাতের সাফল্য ও সম্প্রসারণের দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে অনেক বিনিয়োগকারী। এ সময়ে সংঘটিত ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। রাজস্ব ফাঁকি বা লাইসেন্স নবায়ন ফি সব কিছুকেই বৃহত্ প্রেক্ষাপটে চিন্তা করতে হবে। এ সময় বিশেষ করে আমরা যখন প্রযুক্তির দিক দিয়ে আরও অগ্রসর হতে চাইছি— এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া বা কর্মকাণ্ড পরিচালনা উচিত হবে না, যা ভবিষ্যত্ অগ্রগতিকে ব্যাহত করতে পারে।
একটু পেছনের দিকে তাকানো যাক। গত এক বছর ধরেই টেলিকম খাতে বিভিন্ন ধরনের অস্থিরতা বা অস্থিতিশীলতা, যা-ই বলি না কেন সৃষ্টি হয়েছে। এর শুরু লাইসেন্স নবায়ন প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে। প্রযুক্তির বিকাশে সেবার মান ও সম্প্রসারণের দিকেই কর্তৃপক্ষের বেশি মনোযোগ প্রয়োজন। কারণ টেলিফোন প্রযুক্তি একটি ‘পাবলিক গুডস’, যার ব্যবহারে সমগ্র সমাজ ও অর্থব্যবস্থা উপকৃত হচ্ছে এবং হবে। সাম্প্রতিক সময়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি ও বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানিগুলোর মধ্যে যেসব বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রাথমিকভাবে সেবার মান বৃদ্ধির চেয়ে রাজস্ব আয়ের ওপরই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল বলেই মনে হয়। লাইসেন্স নবায়নকে কেন্দ্র করে এ খাতে অস্থিতিশীলতার শুরু। প্রথম অবস্থায় লাইসেন্স নবায়ন ফি নির্ধারণ করা হয়েছিল প্রায় ১৫০ কোটি ডলার। সার্বিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে এই বিপুল অর্থ পরিশোধ এবং সে সঙ্গে নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যবসা সম্প্রসারণ কঠিনই ছিল। অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে। যেসব দেশ (যেমন, জার্মানি ও যুক্তরাজ্য) তৃতীয় প্রজন্মের লাইসেন্সের জন্য উচ্চ লাইসেন্স ফি আরোপ করেছিল, সব দেশের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির সম্প্রসারণ হয়েছে ধীরে। সে সময়ে ইউরোপীয় বৃহত্ মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো পারস্পরিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে উচ্চ শুল্ক পরিশোধ করে লাইসেন্স নেয়। বিপুল অঙ্কের রাজস্ব পরিশোধের পরে তৃতীয় প্রজন্মের সেবাই তারা চালু করতে পারেনি অনেক দিন পর্যন্ত। রাজস্ব পরিশোধেই তাদের সব অর্থ ব্যয় হয়ে যায়। নতুন প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও প্রচলনে ব্যয় সংকুলানের পর্যাপ্ত অর্থ তাদের ছিল না। মূলত এ কারণেই তৃতীয় প্রজন্ম প্রযুক্তির সম্প্রসারণে এশিয়া ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর চেয়ে পশ্চিম ইউরোপ পিছিয়ে পড়েছে। সে সময়ে রাজস্ব আহরণ এবং এ খাতের সম্প্রসারণের দ্বন্দ্বই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত রাজস্বেরই জিত হয়েছিল বলে টেলিকমিউনিকেশনে পিছিয়ে পড়ে জার্মানি ও যুক্তরাজ্য। প্রযুক্তির সম্প্রসারণমূলক নীতিমালা এবং শুল্ক বা নবায়ন ফি উভয়ের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা প্রয়োজন। মোবাইল ফোন প্রযুক্তির সম্প্রসারণে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশের পথ অনুসরণ করেছিল পূর্ব এশিয়া। তারা রাজস্বের চেয়ে প্রযুক্তির দ্রুত সম্প্রসারণের দিকেই বেশি দৃষ্টি দিয়েছে। মূলত এ কারণেই অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে এরা তথ্য প্রযুক্তির সম্প্রসারণে এগিয়েছে বেশি। তারা এখন চিন্তা করছে তৃতীয় প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে যাওয়ার।
মোবাইল ফোনের দ্রুত বিকাশে পূর্ব এশিয়ার অঞ্চলগুলো বেশি জোর দিয়েছে, বিনিয়োগ করেছে অধিক। যত দ্রুত সম্ভব গ্রাহককে স্বল্প ব্যয়ে টেলিফোন ও ইন্টারনেট সার্ভিস জোগানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছে এখানকার কোম্পানিগুলো। ফলে দেখা গেল কোরিয়া ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো জার্মানি থেকে তথ্যপ্রযুক্তি সেবার ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে গেছে। এই বিশাল পরিবর্তন অনেকে চিন্তায়ও আনতে পারেনি। জার্মানিকে ওই পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছিল সেখানকার টেলিকম রেগুলেটরদের ভুলের কারণে। বাংলাদেশে এ ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আগেই সরকার বিষয়টি বিবেচনায় নেয়ায় কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার হয়েছে। টেলিযোগাযোগ ও অর্থ মন্ত্রণালয় লাইসেন্স ফির প্রাথমিক প্রস্তাব সংশোধনপূর্বক লাইসেন্স দেয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করায় সংকট কিছুটা হলেও প্রশমিত হয়েছে। খবর রয়েছে, এরই মধ্যে চারটি মোবাইল ফোন কোম্পানি লাইসেন্স নবায়নের আবেদন করেছে। সরকারের এ সিদ্ধান্ত টেলিফোন সেবা খাতের সম্প্রসারণে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলেই আশা করি। তবে এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ও জড়িত।
সমস্যা এ খাতের পিছু ছাড়েনি। লাইসেন্স সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের পরপরই নতুন জটিলতা দেখা দিয়েছে গ্রামীণফোনের রাজস্ব পরিশোধ নিয়ে। প্রতিষ্ঠানটির রাজস্ব ফাঁকি দেয়া নিয়ে বিটিআরসি যে অভিযোগ করছে, সেটি এ খাতের সর্ববৃহত্ কোম্পানির সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। যে বিষয় নিয়ে বিটিআরসি কথা বলছে, অনেক দেশেই এমন ঘটনা ঘটার নজির রয়েছে। দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে এটার সমাধান হওয়া উচিত। এখানে রাজস্বের বিষয় যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে গ্রামীণফোনের সুনামের বিষয়। এ সংক্রান্ত আলোচনায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে যুক্ত করাই ছিল কাম্য। বিষয়টি সমাধানের আগে জনগণের সামনে না আনাও ছিল যুক্তিযুক্ত। এখানে অভিযোগ প্রমাণ করতে হবে বিটিআরসিকে; আর গ্রামীণফোনকে প্রমাণ দিতে হবে যে, তারা রাজস্ব ফাঁকি দেয়নি। বাংলাদেশের আইনে যা বলা আছে বা চুক্তির সময় যেভাবে উল্লেখ ছিল, সেভাবেই এটার সমাধান হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় নিতে হবে আন্তর্জাতিক মানের হিসাবরক্ষণ পদ্ধতির। টেলিকম খাতে বিনিয়োগকারী প্রতিটি বেসরকারি কোম্পানি বহুজাতিক। এ ধরনের কোম্পানির রাজস্ব প্রদান ও হিসাবরক্ষণ পদ্ধতিতে কিছু ভিন্নতা ও অনেক জটিলতা রয়েছে। রাজস্ব আহরণে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হিসাবরক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহারে জোর দিতে হবে। আন্তর্জাতিক বা বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যে পদ্ধতিতে হিসাব-নিকাশ করে, তার সঙ্গে বাংলাদেশের প্রচলিত পদ্ধতির পুরোপুরি সাদৃশ্য নাও থাকতে পারে। রাজস্ব ও ট্রান্সফার প্রাইসিং সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে আমাদের রাজস্ব কর্মকর্তাদের। অনেক সময় দেখা যায় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো রাজস্ব থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের পলিসি নেয়, যেগুলো আইনগতভাবে বৈধ ও বিভিন্ন খড়ড়ঢ়যড়ষব-এর কারণে সৃষ্ট। এদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনে কর আইন ও সংশ্লিষ্ট নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে যে বিষয়গুলো মিডিয়ায় এসেছে, তা বেশ স্পর্শকাতর। টেলিফোন সেবা খাতের সম্প্রসারণ, বিনিয়োগ ও গুণগত মানের ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বিটিআরসি গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রতিষ্ঠান। এ দুই সংস্থার কার্যক্রমের ওপর দেশে এ শিল্পের বিকাশ অনেকটাই নির্ভরশীল। বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে। এ অগ্রগতিতে প্রতিনিয়তই যুক্ত হচ্ছে নিত্যনতুন প্রযুক্তি। আধুনিকায়ন হচ্ছে হিসাব-নিকাশ পদ্ধতির। দেশের রাজস্ব কর্মকর্তাদের নতুন পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হবে। যত দিন যাবে, বহুজাতিক কোম্পানির বিনিয়োগ বাড়বে বাংলাদেশে। সে ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে কাজ করতে হবে নতুন পদ্ধতিতেই। রাজস্ব বোর্ডকে আরও দক্ষতা অর্জন করতে হবে যাতে রাজস্ব ফাঁকি রোধ করা যায়। যেসব জায়গায় রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার সুযোগ রয়েছে, সেসব স্থানে নজরদারি বাড়াতে হবে এবং প্রয়োজনে আইনকে আরও শক্ত করতে হবে। গ্রামীণফোন রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে কী দেয়নি, সেটা যথাযথ তদন্ত, যুক্তি-তর্কের পরে নির্ণয় করা সম্ভব হবে। সরকারকে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে বিবেচনায় রাখতে হবে, বাংলাদেশের জন্য এ খাত অতি গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে। স্বভাবতই সরকারের সুদৃষ্টি থাকবে এ খাতে এবং পরিকল্পনাও প্রণীত হবে টেলিফোন শিল্পকেন্দ্রিক। আশা করি, এমন কিছু করা হবে না, যাতে বিদ্যমান বিদেশী কোম্পানিগুলো এ খাতে নতুন বিনিয়োগ করতে ভয় পায় বা নতুন বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে অনুত্সাহী হয়। অন্যদিকে গ্রামীণফোনকে প্রমাণ দিতে হবে, তারা রাজস্ব ফাঁকি দেয়নি। প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই শ্রেয়— এ কথা মনে রাখলে সাম্প্রতিক সময়ে যে সমস্যাগুলো দেখা যাচ্ছে তা অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব।
সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতকেই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে উন্নয়নের স্বার্থে। সাম্প্রতিক সময়ে যে অভিযোগগুলো আসছে সেগুলো সমাধানে গ্রামীণফোন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও টেলিকম রেগুলেটরকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। সবাইকে এমন পথে এগোতে হবে যেন ভবিষ্যতে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আর না ঘটে। এটা সম্ভব পারস্পরিক যোগাযোগ, আস্থা ও আলোচনার মাধ্যমে। এ পথে এগোলেই অর্থিক লাভের পাশাপাশি সামাজিক সুবিধাও বাড়ানো সম্ভব।
লেখক: অর্থনীতিবিদ
নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট