অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত সপ্তাহে জাতীয় সংসদে অর্থবছরের প্রথমার্ধের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন। সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে প্রথম আলোকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর
প্রথম আলো: চলতি অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কত হতে পারে?
আহসান মনসুর: বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় জিডিপির ৬ শতাংশ অর্জনই চ্যালেঞ্জ। এ বছর সংঘাতের দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়েছে, তাই গত বছরের চেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হওয়ার কোনো কারণ দেখছি না। এর সুস্পষ্ট লক্ষণও দেখা যাচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে সংঘাতময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এতে পরিবহন, গৃহায়ণ, পর্যটনসহ কোনো ব্যবসাই স্বাভাবিকভাবে হচ্ছে না। এতে সামগ্রিকভাবে অভ্যন্তরীণ চাহিদার ওপর প্রভাব পড়ছে। বহির্বিশ্বে রপ্তানির চাহিদার প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। এ সংঘাতময় পরিবেশে বিনিয়োগকারীরা বেশ সংযত। নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না।
প্রথম আলো: বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন হার সন্তোষজনক নয়। মূল সমস্যা কী?
আহসান মনসুর: বাস্তবায়ন ও অর্থায়ন—এ দুটি খাতেই অক্ষমতা রয়েছে। রাজস্ব আদায় ভালো না হওয়ায় এ বছর অর্থায়নের অক্ষমতা প্রকট। সরকার এডিপির আকার কমিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জাতীয় উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ যেমন ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন, পদ্মা সেতুর মতো প্রকল্প গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবায়ন করা উচিত। আবার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো প্রকল্প এক বছর পরে করলেও চলবে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রকল্পও বাদ দেওয়া উচিত।
প্রথম আলো: এ বছর রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি কত হতে পারে? আদায় বাড়াতে কি পদক্ষেপ নেওয়া দরকার?
আহসান মনসুর: আমাদের হিসাবে এ বছর ১৫-২০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি হতে পারে। অতীতের মতো এবারও অগ্রিম কর নিয়ে ঘাটতি কমিয়ে দেখানো হতে পারে। বর্তমান কর প্রশাসনকাঠামোর সংস্কার করা না হলে রাজস্ব আদায়ে বড় উল্লম্ফন সম্ভব নয়। মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নতির জন্য এখনই সংস্কার শুরু করা দরকার। ছয় বছরে আগে কর ও জিডিপির অনুপাত ছিল ৯ শতাংশ। এখন তা সাড়ে ১০ শতাংশ হয়েছে।
প্রথম আলো: রপ্তানি, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে অগ্রগতি না হওয়ার পেছনে কারণ কী?
আহসান মনসুর: কারখানার কর্মপরিবেশের বিষয়টি তো রয়েছেই। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশে পোশাক বেশি রপ্তানি হয়। কিন্তু গত তিন-চার মাসে ডলারের বিপরীতে ইউরোর ১৮ শতাংশ দরপতন হয়েছে। এতে পোশাক রপ্তানিকারকদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমেছে। ইউরোপের ক্রেতারা ডলারের মাধ্যমে তৈরি পোশাকের দাম পরিশোধ করেন। এই পোশাক ক্রেতাকে এখন অপেক্ষাকৃত বেশি দামে তৈরি পোশাক কিনতে হচ্ছে। এতে বাংলাদেশি পোশাকের দাম বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের প্রতিযোগী দেশ ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়ায় ডলার শক্তিশালী হয়েছে। এতে ওই দেশের বিক্রেতারা আগের চেয়ে বেশি দাম পাচ্ছেন। এভাবে আমরা ইউরোপের বাজারে ‘মার্কেট শেয়ার’ হারাচ্ছি। এ বিষয়টি সরকারের নজরে আসা উচিত।
প্রথম আলো: আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমছে। অর্থনীতিতে এর প্রভাব কি?
আহসান মনসুর: তেলের দাম কমায় এ অর্থবছরে ২০০ কোটি ডলার সমপরিমাণ লাভবান হবে সরকার। বর্তমানে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) পুঞ্জীভূত দায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। সাশ্রয়ী অর্থ দিয়ে এ দায় কিছুটা কমানো যাবে। সাশ্রয়ী অর্থ ‘পাস অন’ কিংবা তেলের দাম না কমানোয় সরকার সাধুবাদ পেতে পারে। পেট্রোলিয়াম বাজারজাতকরণে বেসরকারি খাতকে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া উচিত। ভারতে সম্প্রতি এটা চালু করেছে।
প্রথম আলো: নতুন মূসক আইন নিয়ে ব্যবসায়ীদের মাঝে তীব্র আপত্তি দেখা দিয়েছে। তাঁদের আপত্তি নিয়ে আপনার মত কী?
আহসান মনসুর: প্যাকেজ মূসক তুলে দেওয়া হোক। প্যাকেজ মূসক থেকে বছরে মাত্র ১০ কোটি টাকা আদায় হয়। বাংলাদেশে ১০ লাখ দোকান মালিক রয়েছেন। তাঁদের কাছ থেকে বছরে গড়ে মাত্র ১০০ টাকা আদায় করা হয়। এ অল্প টাকার জন্য সময় নষ্ট করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কিন্তু এ প্যাকেজ মূসক নিয়ে ‘সভা-সমিতি’ করে রাজনীতি করা হচ্ছে। এতে ধূম্রজাল তৈরি হচ্ছে। বড় বিক্রেতা হলে এমনিতেই মূসকের আওতায় আসবে। এ বিষয়ে বিতর্ক না হওয়াই উচিত। এসব ‘সভা-সমিতি’ করে দৃষ্টিকে অন্যদিকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
১৫ শতাংশ অভিন্ন মূসক হার নিয়ে আপত্তির কোনো কারণ নেই। মূসক প্রথা রয়েছে—এমন ৭০ শতাংশ দেশেই কর হার ১৫ শতাংশ বা এর বেশি। উন্নত দেশে এ হার ২২-২৭ শতাংশ। এ কর (মূসক) দেন ভোক্তারা, ব্যবসায়ীরা নন। এনবিআরের পক্ষে ভোক্তার কাছ থেকে মূসকের অর্থ আদায় করেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীকে তো পয়সা দিতে হচ্ছে না। ভোক্তারাও কোনো আপত্তি করছেন না। তাহলে ব্যবসায়ীদের এত আপত্তি কেন? এটা সরকারের খুঁজে বের করা উচিত।
প্রথম আলো: বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে আপনার মত কী?
আহসান মনসুর: বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার সুযোগ হারিয়ে ফেলছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, স্যামসাংয়ের বিনিয়োগ বাংলাদেশ থেকে ভিয়েতনামে চলে গেছে। সেখানে সাব-কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে স্থানীয় উৎস থেকে এলইডি টিভি, মুঠোফোনের যন্ত্রাংশ তৈরি করছে স্যামসাং। এতে একদিকে ভিয়েতনামে প্রযুক্তি হস্তান্তর হচ্ছে, আবার কর্মসংস্থানও হচ্ছে। আমরা ইলেকট্রনিক খাতে বিপ্লব ঘটানোর সুযোগ হারিয়েছি। গত সাত বছরে আমরা বড় বিদেশি বিনিয়োগ আনতে পারেনি। দেশে শিল্পাঞ্চল গঠনের সুযোগ জাপানকে দেওয়া উচিত। দেশে মধ্যবর্তী পণ্য তৈরির জন্য এখন বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা দরকার। এশিয়ার ‘ভ্যালু চেইনে’র ৭০ শতাংশ মধ্যবর্তী পণ্যের জোগান দেয় চীন, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলো। অথচ সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান শূন্য। মধ্যবর্তী পণ্য উৎপাদনে বিদেশি বিনিয়োগ এলে প্রযুক্তি হস্তান্তরের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থানও হবে।