গ্রামীণ অর্থনীতির সুষ্ঠু বিকাশে খাদ্যনীতি পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন

গ্রামীণ অর্থনীতির সুষ্ঠু বিকাশে খাদ্যনীতি পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন

ড. আহসান মনসুর

চালের দাম স্থিতিশীল বা কম রাখা বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্যতম স্লোগান ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

নির্বাচনে জয়লাভের জন্যও এটিকে ধরা হয় গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক তথা শর্ত হিসেবে। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে চালের দাম সস্তা এবং এটাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার কতটা সঙ্গত, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। দেশে খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টি এখন বেশ জোরের সঙ্গে আলোচিত হচ্ছে; তাও অনেকাংশে চালের মূল্যের সঙ্গে যুক্ত। লক্ষণীয়, খাদ্যনিরাপত্তা বলতে আমরা সাধারণত চালে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনকেই বুঝছি। কিন্তু খাদ্যনিরাপত্তাকে এত ক্ষুদ্রভাবে দেখার অবকাশ নেই। অনেকে বলছেন, আমরা চালে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং দেশে দুর্ভিক্ষ নেই। কিন্তু সাধারণভাবে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। কৃষিপণ্যের দামের সঙ্গেও গ্রামীণ অর্থনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ পরিপ্রেক্ষিতে খাদ্যনীতির পুনর্মূল্যায়ন দরকার।
আমাদের অর্থনীতি গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আগে গ্রামীণ অর্থনীতি বলতে— চাল উত্পাদন, এর ন্যায্য দাম এবং তা শহরে পাঠানোর বিষয়গুলোই পেত প্রাধান্য। এ ধরনের একটি সাধারণ সম্পর্ক ছিল সব ক্ষেত্রে। গ্রামীণ অর্থনীতিকে বর্তমানে এত সহজভাবে ব্যাখ্যা করাটা যৌক্তিক হবে না। গ্রামীণ অর্থনীতিতে দুই ধরনের বিষয় রয়েছে। খাদ্য সরবরাহ ছাড়াও বাজারে পণ্য বিক্রি করে কৃষক যে অর্থ পান, সেটি সামগ্রিক অর্থনীতিতে চাহিদা সৃষ্টির বড় উত্সও বটে। এ কারণেই গ্রামগঞ্জে ওয়ালটন, অটবি, বাটা ও এপেক্সের শোরুম দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন নামিদামি ব্র্যান্ডের আইসক্রিমের খুচরা দোকান তৈরি হচ্ছে। এমনকি খেয়াঘাটে গেলেও দেখা যাবে মামের বোতলজাত পানি, প্রাণের কোমল পানীয় ও রুচির চানাচুর রয়েছে সেখানে। এগুলো কিন্তু আগে ছিল না। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের যেকোনো গ্রামে এখন কমলা বা আপেল পাওয়া যায়। অর্থাৎ এসব পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে গ্রামগঞ্জে। দেশের অর্থনীতিতে এটি রাখছে বড় ভূমিকা। এর মূলে কয়েকটি বিষয় কাজ করে।
প্রথমত. গ্রামীণ অর্থনীতিতে উত্পাদনশীলতা ও আয় বেড়েছে। ইরি-বোরোসহ উচ্চফলনশীল ধানের আবাদ ও উত্পাদন বেড়েছে। চালের দাম বাড়ায় ২০০৮ সাল থেকে গ্রামীণ অর্থনীতি উজ্জীবিত হয়েছে। চালের দাম কেজিপ্রতি ২০-২২ থেকে ৪০ টাকা হওয়ায় গ্রামের মানুষ তথা কৃষকের প্রকৃত উত্পাদন ২০১০ সালের মধ্যেই দ্বিগুণ হয়ে যায়। এতে নতুন চাহিদাও সৃষ্টি হয়।
দ্বিতীয়ত. প্রান্তিক বা ভূমিহীন কৃষক, যারা শ্রমিক হিসেবে প্রধানত ক্ষেতে কাজ করেন, তাদের মজুরিও বেশ বেড়ে যায় কৃষকের আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। এর সঙ্গে জনশক্তি রফতানি ও রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়ায় বড় অবদান রেখেছে। গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষই অদক্ষ কর্মী হিসেবে বিদেশে যাচ্ছেন বিপুলভাবে। এটিও আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রেখেছে। গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল করতে এ দুই ক্ষেত্রেই নীতিগত পরিবর্তন আনতে হবে। সনাতন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখা সম্ভব হবে না। মনে রাখতে হবে, একে সচল রাখতে না পারলে ৬০ শতাংশ মানুষের চাহিদাকে আমরা উজ্জীবিত করতে পারব না। এটি করতে না পারলে উজ্জীবিত হবে না আমাদের অর্থনীতিও।
শিল্প প্রবৃদ্ধির জন্য অভ্যন্তরীণ চাহিদার যে রকম সহায়তা দরকার, শুধু শহরকেন্দ্রিক চাহিদা দিয়ে তা মিটবে না। দুই বছর ধরে দেশে চালের প্রকৃত মূল্য price in real terms) কমপক্ষে ২০-৩০ শতাংশ কমে গেছে। অথচ প্রতি বছর গড়ে ১০ শতাংশের মতো মূল্যস্ফীতি হয়েছে। ফলে ধান-চাল উত্পাদন থেকে কৃষকের সমপরিমাণ প্রকৃত আয় কমে গেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পাটের দরপতন। বিশ্বমন্দার ফলে দেড়-দুই বছর ধরে আমাদের পাটের দাম কমেছে। আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতিতে এরও বড় প্রভাব পড়েছে। এসব বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে পুনর্মূল্যায়ন করা দরকার— বিদ্যমান খাদ্যনীতি ঠিক আছে কি না।
কিছুটা হলেও সত্য, প্রতি বছর যে পরিমাণ চাল উত্পাদন দেখানো হচ্ছে, তা আমাদের অনুমিত চাহিদার চেয়ে বেশি। ব্যক্তি ও সরকারি খাতে মজুদ বাড়ায় ২০১০ ও ২০১১ সালে সরবরাহ বেশি হওয়া সত্ত্বেও চালের বাজারমূল্য কমেনি। পর পর বাম্পার ফলন হওয়ায় কৃষককে বাধ্য হয়ে মজুদ চাল বাজারে ছাড়তে হয়। এতে দাম কিছুটা কমে আসে। তখন তারা ধরে নিয়েছিলেন দাম আর বাড়বে না। এভাবে মজুদ পণ্য একসময় চলে আসে বাজারে। এ কারণে আমরা দেখেছি, মঙ্গার সময়ও বাজারে চালের সরবরাহ ছিল পর্যাপ্ত এবং দাম বাড়েনি। বরং অনেক সময় দেখা গেছে দাম নিম্নগামী। মজুদদাররা যখন দেখেছেন দাম বাড়ছে না, তখন লোকসানে হলেও তারা চাল ছেড়ে দিয়েছেন বাজারে। ভবিষ্যতে বাম্পার ফলনের পর মজুদ বাড়ানো সম্ভব না-ও হতে পারে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা করতে হবে কৃষকের আয় আর কমতে না দেয়ার। আমাদের উত্পাদিত চাল দেশের বাইরে যেতে দেব না, বাইরে থেকে এনে বাজারে ছাড়ব— এ মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
তৃতীয়ত. চালভিত্তিক খাদ্যনিরাপত্তা আমাদের পুষ্টিহীনতা কমাতে সাহায্য করেনি। দেশে শিশুদের পুষ্টিহীনতার মাত্রা এখনো বেশি। এক্ষেত্রে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পিছিয়ে পড়ছি আমরা। চালে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি ঠিকই, কিন্তু পুষ্টিহীনতা থেকে যাচ্ছে। অতিরিক্ত চাল খেয়ে কিন্তু পুষ্টির চাহিদা পূরণ করা যাবে না। সেক্ষেত্রে দরকার চালের পরিভোগ কমিয়ে অন্যান্য— শাকসবজি, ফলমূল ও আমিষজাতীয় খাদ্যের পরিভোগ বাড়ানো। এক্ষেত্রে শিক্ষা ও সামাজিক জাগরণের প্রয়োজন রয়েছে। আলুসহ অন্যান্য খাদ্য উত্পাদন ও পরিভোগে ভারসাম্য আনতে হবে। শুধু চাল খেয়ে পুষ্টি সমস্যার সমাধান করা যাবে না। এ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেও চালের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে সরকারি নীতিগুলোতে আরও ভারসাম্যপূর্ণ পুষ্টিসম্পন্ন খাদ্যব্যবস্থার দিকে নজর দিতে হবে। অর্থাৎ যেসব খাদ্য আমাদের খাদ্যতালিকায় থাকা উচিত, সেগুলোকে চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে উত্পাদন করতে হবে; যাতে সবাই ভারসাম্যপূর্ণ খাদ্য পরিভোগ করে। আমাদের খাদ্যনীতিও সাজাতে হবে এ আলোকে।
চতুর্থত. কৃষকের উপার্জন কমে যাওয়ায় বিরূপ প্রভাব পড়ছে অভ্যন্তরীণ বাজারেও। গ্রামাঞ্চলে সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের চাহিদা কমে যাচ্ছে। এটি কিন্তু প্রবৃদ্ধির হার বাড়াতে সাহায্য করবে না। চিন্তা করতে হবে, কীভাবে গ্রামের মানুষের প্রকৃত আয় অক্ষুণ্ন এবং সময়ের সঙ্গে তা বাড়ানো যায়। শুধু সস্তায় চাল খাওয়ালে এটি সম্ভব হবে না। বাংলাদেশের চালের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ অবস্থায় আনতে হবে; যাতে কৃষকরা যৌক্তিক দাম পান। ২০০৮-০৯ সালে বেড়েছিল ধান-চালের দাম। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি অনেকাংশে সচল হয়ে ওঠে পরবর্তী সময়ে। তবে সাধারণত বাংলাদেশে চালের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে কম থাকে যেমনটি রয়েছে এখন। আমাদের কৃষকের জন্য এটি মোটেও ভালো খবর নয়। আমাদের চালের দাম বিশ্ববাজার থেকে কম হলে ধাপে ধাপে তা রফতানির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রেও তদারকি বাড়াতে হবে। আগামী বোরো মৌসুমে যদি বাম্পার ফলন হয়, তবে সরকারিভাবে চাল কিনে উদ্ভুত সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। এ ব্যাপারে সরকারকে এখনই চিন্তা করতে হবে।
এখন কৃষকরা চালকেও অর্থকরী ফসল হিসেবে দেখছেন। মৌলিক চাহিদা হিসেবে একে তারা আর বিবেচনা করছেন না। উত্পাদন খরচ বেড়েছে প্রচুর। সার, পানি, বীজ প্রভৃতির জন্য খরচ করতে হয়। এছাড়া রয়েছে শ্রমিকের খরচ। সব ব্যয় নির্বাহ করার পর মুনাফা করতে হয় তাকে। আগে অবস্থা এমন ছিল না। কৃষক নিজেই কাজ করতেন তার পরিবারের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য। উত্পাদন হলে ভালো, না হলেও এটি চালিয়ে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। তেমন মানসিক অবস্থা কিন্তু এখন আর নেই। তাই চালের উত্পাদন ধরে রাখতে কৃষককে এর যথাযথ দাম দিতে হবে। নইলে গ্রামে এখন যেটি দেখা যাচ্ছে— কৃষকরা ধানের জমিতে গাছ লাগাবেন স্থায়ীভাবে এবং অন্যভাবে (কৃষিকাজের বাইরে) জীবিকা নির্বাহ করবেন।
আমাদের নীতিনির্ধারকদের একই সঙ্গে চিন্তা করতে হবে— কীভাবে কৃষি উত্পাদনকে বহুমুখী করা যায়। বর্তমানে কৃষি খাতের সরকারি ব্যয় বা অনুদান প্রধানত চাল উত্পাদনেই ব্যবহার হয়। সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা এবং অনুদান অন্যান্য শস্য ও শাকসবজি উত্পাদনে অধিকতর ব্যবহার করতে হবে। এটি খাদ্যশস্য বহুমুখীকরণেরও একটি অংশ। এটাকে অন্যভাবে দেখার সুযোগ নেই। আমাদের শাকসবজি, মাছ-মাংস ও আম-জাম-লিচু— সব কিছুরই দরকার আছে। এক্ষেত্রে সরকারের সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। এ পরিবর্তন খাদ্যনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক, এটা মনে করাও ঠিক হবে না। এটা খাদ্য পরিভোগকে ভারসাম্যপূর্ণ করতে সহায়তা করবে। কারণ ক্রমে আমরা ফল ও শাকসবজি বেশি পরিভোগ করব। এর পুষ্টিগত কারণ রয়েছে। সরকার যদি উন্নত মানের সবজি, শস্য ও ফল উত্পাদন ও বহুমুখীকরণে সহায়তা দিতে পারে, তা আমাদের ফুড বাস্কেটে প্রয়োজনীয় ভারসাম্য রক্ষায় সহায়তা জোগাবে। স্বাস্থ্যগত দিক থেকেও সেটি হবে আমাদের জন্য ভালো এক পদক্ষেপ। সেক্ষেত্রে কৃষিনীতিতে বড় রকমের পরিবর্তন আনতে হবে।

অনেক সময় বলা হয়, পর্যাপ্ত চাল না থাকলে আমরা খাব কী? এটা এক ধরনের প্যারানয়েড মানসিকতা। যেন ধরেই নেয়া হয়, পর্যাপ্ত চাল উত্পাদন না করলে আমাদের না খেয়ে থাকতে হবে! বিশ্বে অনেক দেশ রয়েছে যারা চাল উত্পাদন করে না কিন্তু এটি পরিভোগ করে। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেই চাল বা গম উত্পাদন করে না; তাদের কি খাদ্যনিরাপত্তা নেই? তাদের খাদ্যনিরাপত্তা কোত্থেকে আসছে এবং কেন তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে না? কারণ তাদের ক্রয়ক্ষমতা রয়েছে। দাম যা-ই হোক, এটি তারা কিনতে পারে। আমেরিকা, কানাডা, ভারত, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া— এসব দেশে প্রচুর চাল-গম উদ্বৃত্ত থাকে। এখান থেকে চাল কেনে তারা। বাংলাদেশকেও সব সময়ই চালে স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকতেই হবে, এটি ধ্রুব সত্য নয়। এক্ষেত্রে যদি কয়েক লাখ টন চাল আমদানি করতে হয়, যা আমরা সব সময়ই করছি— তা বড় সমস্যা তৈরি করতে পারে না। এ ক্রয়ক্ষমতা আমাদের রয়েছে। আমরা যদি অন্যান্য পণ্য আমদানি করতে পারি, তাহলে কিছুটা চাল কেন আমদানি করতে পারব না? বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী থাকলে চাল কিনতে বেগ পাওয়ার কথা নয়। অন্যান্য দেশ কিনতে পারলে, বাংলাদেশও পারবে। শুধু চাল কিনে গুদামজাত করতে হবে— এমন কোনো কথা নেই। কারণ এটি পচনশীল পণ্য। এটি নষ্ট হয় বেশি দিন ধরে রাখলে এবং ঠিকমতো মজুদ করতে না পারলে। এক্ষেত্রে ভারতের খাদ্য মজুদ কার্যক্রম অন্যতম খারাপ উদাহরণ হিসেবে দেখানো যেতে পারে। দেশটি প্রায় ৫০-৬০ মিলিয়ন টন চাল ও গম মজুদ করছে অনেক বছর থেকে। এগুলো বেশ কিছুটা ইঁদুরকে খাওয়ানো বা পচানো হচ্ছে। এটা ভালো নীতির উদাহরণ হতে পারে না। ভারত সরকার ওয়ালমার্টের মতো কোম্পানিকে সম্প্রতি দেশে নিয়ে আসার পরিকল্পনা নিয়েছে। এর অন্যতম লক্ষ্য, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের উন্নয়ন ঘটানো। কৃষক যেন তার উত্পাদিত সবজি তাড়াতাড়ি মাঠ থেকে বাজারে আনতে পারেন, চাইলে যেন এটি সংরক্ষণ করতে পারেন, তার উদ্যোগ নিচ্ছে। ভারতে ৩০-৪০ শতাংশের মতো সবজি নষ্ট হয়। আমাদের দেশের অবস্থাও সম্ভবত অনুরূপ। এর মূল কারণ, প্রক্রিয়াকরণ কীভাবে করতে হয়, তা আমরা জানি না। বাজারজাতকরণ বা সংশ্লিষ্ট চেইন কীভাবে ডেভেলপ করতে হয়, তাও আমাদের অজানা। সনাতনী পদ্ধতিতে কিন্তু এগুলো হবে না। এর আধুনিকায়ন করতে হবে। তা করতে গেলে আমাদের ভারতের মতো বিদেশী টেকনোলজি বা বাজারজাতকরণ পদ্ধতি রপ্ত করার চেষ্টা করতে হবে। রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও মনমোহন সিংয়ের সরকার এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশের কিছু কোম্পানি অবশ্য এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে শুরু করেছে। এর মাধ্যমে মাছ-মাংস, ফল ও সবজি যে প্রচুর পরিমাণে অপচয় হয়, তা কমানো যাবে। এটি কমানো গেলে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তায় বড় রকমের উন্নতি আশা করা যায়।
আমরা প্রচুর চাল অপচয় করি। এ ধরনের অপচয় ঠেকাতে খাদ্য পরিবেশনের অভ্যাসেও পরিবর্তন আনতে হবে। পরিমাণ না জেনেই আমরা একজনের প্লেটে খাবার উঠিয়ে দিই, যা পরে নষ্ট হয়। মধ্যপ্রাচ্যে এ প্রবণতা বেশি দেখা যায়। বিয়েসহ এ ধরনের অনুষ্ঠানে আমাদের দেশেও এ প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এতে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ চাল অপচয় হয়। এক্ষেত্রেও আমাদের সচেতনতা তৈরি করতে হবে। গড়ে তুলতে হবে প্রয়োজন অনুযায়ী উঠিয়ে নিয়ে পরিভোগের অভ্যাস। প্রতি বছর আমরা যে পরিমাণ চাল উত্পাদন করি, তা সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও ব্যবহার করা গেলে চাল উত্পাদনে আর প্রবৃদ্ধির দরকার নেই। ব্যক্তি খাতের আয় বেড়ে চালের চাহিদা কমে আসবে সময়ের সঙ্গে। একসময় জাপানে একজন মানুুষ গড়ে বর্তমানের চেয়ে তিন গুণ চাল খেত। আমাদের খাদ্যাভ্যাসেও এ প্রবণতা লক্ষণীয়। জনপ্রতি বার্ষিক চাল পরিভোগের পরিমাণ ২০০৫ সালের ১৭০ থেকে ২০১০-এ ১৫৯ কেজিতে নেমে এসেছে। HEIS (Household Expenditure and Income Survey এর তথ্য এটি। কাজেই অভ্যন্তরীণ খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য আমাদের চাল উত্পাদন খুব একটা
বাড়ানোর প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তবে রফতানির জন্য হলে ঠিক আছে। সেক্ষেত্রে তো পুরনো বিষয়টিই আবার চলে আসে সামনে— অভ্যন্তরীণ বাজারকে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করতে হবে। সে অবস্থায় কৃষকরাই সিদ্ধান্ত নেবেন, তারা কী উত্পাদন করবেন। এ ইস্যুগুলো বিবেচনায় রেখেই আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা এবং কৃষকের আয় দেখতে হবে। বিষয় দুটিকে আলাদাভাবে দেখার সুযোগ নেই। গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে খাদ্য ও পুষ্টিগত নিরাপত্তা জড়িত। সনাতনী প্রথার খাদ্যনিরাপত্তার কথা বলে আমরা গ্রামীণ অর্থনীতি ও জনস্বাস্থ্যকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারি না। কোটি কোটি কৃষকের উপার্জনের বিষয়টি এবং জনস্বাস্থ্যকে উপেক্ষা করে আমরা জাতিগত ও সামগ্রিক অর্থনীতির উন্নতি করতে পারব না। বিষয়টি অবশ্যই ভেবে দেখার দাবি রাখে।

Dr. Ahsan H. Mansur

Dr. Ahsan H. Mansur

Dr. Mansur started his career as a Lecturer, Department of Economics, Dhaka University in 1976. He left for Canada for higher studies in economics in the same year. As a graduate student and research assistant, he was also offering regular economics courses at the undergraduate level at the University of ...

gog