কালোটাকা সাদা করার সুযোগ ঠিক হবে না

কালোটাকা সাদা করার সুযোগ ঠিক হবে না

বাজেট গতানুগতিক। আগের চেয়ে ১৮ শতাংশ বেশি। সেটা অর্জন তো হবে না, তবে কিছু নতুনত্ব আছে। প্রতিবছর দেখা যায়, যা অর্জন হয়, তার চেয়ে ২ শতাংশ ব্যয় বাড়ানো হয়। এ চক্র থেকে আমরা বের হতে পারিনি। গত ১০ বছরের বাজেট এভাবেই চলে আসছে। সময়ই বলে দেবে, এ চক্র থেকে আমরা বের হতে পারব কি না।

প্রতিবছর রাজস্ব আদায়ের উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়, এরপর ঘাটতি হয়। এবার ২ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল, তা কমিয়ে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে। আমাদের হিসাবে, রাজস্ব ঘাটতি হবে ৭০ হাজার কোটি টাকা। তার মানে, ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা আদায় হতে পারে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ১ লাখ ৮৭ হাজার কোটি টাকা। তাই রাজস্ব আদায়ই এখন বাজেটের প্রধান চ্যালেঞ্জ। কর প্রশাসনে দীর্ঘদিন ধরে কোনো সংস্কার না করায় এ অবস্থা হয়েছে। প্রতিবছরই পরিকল্পনা হয়, কিন্তু পদ্ধতিগত কোনো সংস্কার হয় না। কর প্রশাসনে হঠাৎ করে সংস্কার আনাও সম্ভব নয়। স্থবির জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) ডায়নামিক করতে হলে ৩-৫ বছরের পরিকল্পনা করতে হবে। সেভাবে এগোতে হবে। তাই প্রচলিত পদ্ধতিতে যতই চেষ্টা করুক, সেটা হবে মরা হাতিকে বেতানো। এনবিআরের চেয়ারম্যান, সদস্য পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু এনবিআরের চরিত্র পাল্টাবে না।

আবার আয় না হলে ব্যয় হবে কীভাবে। যদি টাকা ছাপিয়ে ব্যয় করা হয়, তাহলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। অর্থনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে। তাহলে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নিয়ে সরকার বাজেট বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে। আর তারল্য সংকট না বাড়াতে তফসিলি ব্যাংক থেকে টাকা না নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার করবে সরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সরকারকে দেবে। এর ফলে মুদ্রার বিনিময় হার, মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ পড়বে। এটা অল্প আকারে করা যায়, বেশি হলে সমস্যা। খুব সুচিন্তিতভাবে এটা করতে হবে।

হাইটেক পার্ক ও অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। নৈতিকভাবে এটা একেবারেই ঠিক হবে না। যদি বেআইনিভাবে টাকা আয় হয়, সে টাকা কোনোভাবেই সাদা করতে দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ, প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, ঘুষ দেওয়া ও নেওয়া দুটোই অপরাধ। আবার যদি জমির দামের কারণে টাকা বৈধ করার সুযোগ না হয়, সে টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে।

তরুণদের জন্য যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে, এটা খুবই ভালো। তবে দেখতে হবে, এটার ব্যবহার কীভাবে হয়। কারণ এর আগে উদ্যোক্তা তৈরির টাকা বেহাত হয়ে গেছে। গ্রাহকদেরই খুঁজে পাওয়া যায়নি। আবার নারী উদ্যোক্তাদের টাকাও ব্যবহারও করা যায়নি।

সার্বিকভাবে যেকোনো দেশের চেয়ে মোবাইল ফোন খাতে কর আমাদের দেশে বেশি। আমি সব সময় মোবাইল ফোন ব্যবহারের ওপর কর আরোপের বিরোধী। কারণ, এতে মানুষ কথা বলা কমিয়ে দেবে। ঠিক যেমন আর্থিক লেনদেনেও কর আরোপ করা ঠিক নয়। আবার মোবাইল ফোন কোম্পানির ওপর নির্দয়ভাবে ৪৫ শতাংশ কর আরোপ করা হয়, এতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হয়। এনবিআর সব সময় ঘরে বসে বেশি কর পেতে চায়। এ জন্যই মোবাইল ফোনের ওপরে নতুন করে কর আরোপ করেছে।

বিড়ি, জর্দা, গুল ব্যবহার বন্ধে কর বাড়াতে হবে। আর সিগারেটের ওপর কর বাড়ানো ঠিক আছে।

আর যারা নতুন পোশাক, নতুন দেশে রপ্তানি করবে তাদের প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। তবে যারা পাচ্ছে, তাদের আর সুবিধা দেওয়া ঠিক হবে না। টাকার অবমূল্যায়ন করলে পোশাকসহ কোনো রপ্তানিকারকদের কোনো প্রণোদনা লাগবে না। ভোজ্যতেল, গুঁড়া দুধ, চিনির ওপর কর বাড়ানো ঠিক আছে।

আবার প্রবাসীদের আয় পাঠানোর ওপর যেভাবে প্রণোদনা দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেটা ঠিক হয়নি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের আইনে বলা আছে, একই মুদ্রার একাধিক মান হতে পারে না। যদি টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়, তাহলে আর এই প্রণোদনা প্রয়োজন হবে না।

ব্যাংক খাত নিয়ে কিছু সমস্যার কথা বলা হয়েছে। প্রথমবারের মতো সরকারের পক্ষ থেকে এ সমস্যা স্বীকার করে নেওয়া হলো। ব্যাংক একীভূত, খেলাপি গ্রাহকদের শাস্তি, বন্ড বাজারসহ নানা বিষয় বলা হয়েছে। আমরা দেখতে চাই, আগামী মাস থেকে এ নিয়ে কাজ শুরু হোক। প্রতিটি পদক্ষেপের ব্যাপারে কমিশন বা কমিটির মাধ্যমে পদক্ষেপ নিতে শুরু করতে হবে। যারা খেলাপি গ্রাহক, এমন বড় পাঁচ গ্রাহককে হলেও শাস্তির আওতায় আনতে হবে। বড় আকারে খেলাপি হিসেবে যারা সুপরিচিত, তাদের শাস্তি দিতে হবে। ব্যাংক খাতের সমস্যা একটা গুরুতর সমস্যা। ব্যাংক খাতের এ সমস্যা পুরো অর্থনীতিকে চেপে ধরছে। ব্যাংক খাত ঠিক না করা হলে অর্থনীতিতে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা তৈরি হবে। আমরা দেখার অপেক্ষায়, কবে সরকার এ নিয়ে কাজ শুরু করবে। দুর্বল ব্যাংককে একীভূত করে বা অন্য উপায়ে বাজার থেকে সরিয়ে দিতে হবে। দেশে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ব্যাংক গড়ে তুলতে পরিকল্পনা নিতে হবে।

সুদের হার সরকার যেভাবে ঠিক করে দিচ্ছে, তা বাস্তবায়ন হয় না। শেয়ারবাজার যেমন ঘোষণা দিয়ে বাড়ানো বা কমানো যায় না, ঠিক তেমনি সুদহারও ঠিক করে দেওয়া যায় না। সরকার যদি রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, ব্যাংক খাত ঠিক করবে। তাহলেই ঠিক হয়ে যাবে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা দিয়ে ক্ষমতায়ন করে কাজ শুরু করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ক্ষমতায়ন করলে দায়ী করতে হবে।

সরকারে সুদ ব৵য় অনেক বেড়ে যাচ্ছে। এ জন্য সচেতন হতে হবে। সরকারের পেনশন ব্যয় দ্রুত বাড়ছে, সামনে আরও বাড়বে। কারণ, স্বাধীনতার পর যারা চাকরিতে প্রবেশ করেছে, তারা এখন অবসরে যাচ্ছে। আমাদের অবশ্যই পেনশন ফান্ড করতে হবে। তাহলে ১৫-২০ বছর পর এ সুবিধা মিলবে। আবার যেভাবে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে, তাতে খুব ভালো ফল আসছে। কৃষি খাতে ভর্তুকি থাকতে পারে। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে, এর পুরোটাই পানিতে ঢেলে দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। এটা অতিমূল্যায়িত ও ছোট কেন্দ্রের কারণে। এ থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারছি না। এখন পর্যন্ত আমরা একটা বড় আকারের কেন্দ্র করতে পারিনি। এখানে সবাই পয়সা বানাচ্ছে, ক্ষতিতে পড়ছে দেশ। এখন তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসে (এলএনজি) সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। এটা কোনো টেকসই মডেল হতে পারে না। যেভাবে গণহারে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে, তাতে বাজেটের মান খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ভর্তুকি অপচয় বন্ধ করতে হবে।

নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট

https://www.prothomalo.com/economy/article/1599037/%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%8B%E0%A6%9F%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A6%BE-%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A6%BE-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A7%81%E0%A6%AF%E0%A7%8B%E0%A6%97-%E0%A6%A0%E0%A6%BF%E0%A6%95-%E0%A6%B9%E0%A6%AC%E0%A7%87-%E0%A6%A8%E0%A6%BE

Dr. Ahsan H. Mansur

Dr. Ahsan H. Mansur

Dr. Mansur started his career as a Lecturer, Department of Economics, Dhaka University in 1976. He left for Canada for higher studies in economics in the same year. As a graduate student and research assistant, he was also offering regular economics courses at the undergraduate level at the University of ...

gog