সাম্প্রতিক সময়ে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের বিভিন্ন দিক ও নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়ে
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ভাইস চেয়ারম্যান ড. সাদিক আহমেদ ইত্তেফাককে এক সাক্ষাত্কার দিয়েছেন। তিনি বলেন, আধুনিক অর্থনীতিতে ব্যাংক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বর্তমান যুগে অর্থনীতির বেশিরভাগ কাজই চলে ঋণের ওপর ভিত্তি করে। ঋণের একটি বড় মাধ্যম হলো ব্যাংক। তাই উন্নত কিংবা উন্নয়নশীল সব ধরনের দেশেই ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। ব্যাংকের তিনটি বিষয় অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ— ব্যাংকের দক্ষতা, ব্যাংকিং সেবার সহজপ্রাপ্যতা এবং ব্যাংকিং সেবার খরচ।
স্বাধীনতার পর ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত আমাদের দেশের অর্থনীতিতে ব্যাংকিং খাতের অবদান ছিল তুলনামূলকভাবে কম। ২০০০ সালের পর থেকে আমাদের অর্থনীতিতে ব্যাংকের অবদান অনেক বেড়েছে। ১৯৮০ সালে জিডিপিতে ব্রড মানির অংশ ছিল মাত্র ১২ শতাংশ, যা ২০১০ সালে এসে ৫৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। জিডিপিতে ব্রড মানির অংশের আধিক্য আর্থিক খাতের গভীরতা নির্দেশ করে। একই সময়ে জিডিপিতে ব্যাংক ঋণের অবদানও বাড়ছে। ১৯৮০ সালে জিডিপিতে ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ১৪ শতাংশ, যা ২০১০ সালে এসে ৪৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অর্থাত্ ধীরে ধীরে আমাদের অর্থনীতিতে আর্থিক খাতের গভীরতা এবং ব্যাংকের অবদান বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি অবশ্যই ইতিবাচক। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর দক্ষতাও আগের তুলনায় অনেক বেশি। এজন্যই বর্তমানে নন-পারফর্মিং লোনের হার কমে আসছে। ১৯৯৯ সালে মোট ঋণের ৪১ শতাংশ ছিল নন-পারফর্মিং লোন, যা ২০১০ সালে এসে মাত্র ৮ দশমিক ৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
অর্থনীতিতে ব্যাংকিং খাতের অবদান ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে ব্যাংকের অবদান বেশি দেখা যাচ্ছে শহরাঞ্চলে। শহরাঞ্চলে মানুষের সঞ্চয় ও ঋণগ্রহণ প্রবণতা বেশি হওয়ায় শহরাঞ্চলে ব্যাংকের মুনাফার সম্ভাবনা (Profitability) বেশি। তাই ব্যাংকগুলো তাদের শাখার বেশিরভাগই খুলছে শহরাঞ্চলে। গ্রামাঞ্চলে সঞ্চয় ও ঋণগ্রহণ প্রবণতা তুলনামূলক কম হওয়ায় সেখানে ব্যাংকের শাখা কম খোলা হচ্ছে। ফলে গ্রামাঞ্চলে ব্যাংকের অবদান সীমিত। ব্যাংকিং সেবার স্বল্পতা থাকায় সেখানে ক্ষুদ্রঋণের প্রচলন হয়েছে অনেক বেশি।
বর্তমান সময়ে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে বেশ আধুনিকায়ন হয়েছে। ব্যাংকগুলোতে শুরু হয়েছে ই-ব্যাংকিং। এখন টাকা তুলতে হলে ব্যাংকে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না। এটিএম বুথ থেকে সহজেই টাকা তুলতে পারছেন গ্রাহকরা। ব্যাংকের কাজেও এসেছে বেশ স্বচ্ছতা এবং গতিশীলতা। গ্রাহকদের হয়রানি কমেছে অনেকাংশে। সার্বিকভাবে ব্যাংকিং খাতে দ”শ্যমান উন্নতি সাধিত হয়েছে। তবে বেসরকারি ব্যাংকগুলোরও কিছু সমস্যাও রয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ ব্যাসেল টুর (Basel-II) আওতায় যে ধরনের মূলধন পর্যাপ্ততা (capital adequacy) থাকা দরকার বেশিরভাগ বেসরকারি ব্যাংক সেটি অর্জন করতে পারেনি।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি সরকারি ব্যাংকগুলোতে উন্নতির কিছুটা ছোঁয়া লেগেছে বটে কিন্তু বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মতো ততটা উন্নতি পরিলক্ষিত হয়নি। তাছাড়া সরকারি ব্যাংকগুলো ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে (Loan recovery) খুব একটা দক্ষতা দেখাতে পারছে না। ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে অনেক সময়ই রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পায় বলে সরকারি ব্যাংকগুলোতে অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে নতুন ব্যাংকের প্রস্তাব গ্রহণ করার আগে অর্থনীতিতে সামগ্রিকভাবে এর কী প্রভাব পড়তে পারে তা নির্ধারণ করা অত্যন্ত জরুরি। অন্য ব্যবসায়িক কর্মকা থেকে ব্যাংকিং ব্যবসা অনেক ভিন্ন। যেহেতু ব্যাংক সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আমানত নিয়ে ব্যবসা করে তাই ব্যাংকের দক্ষতা ও যোগ্যতা অনেক বেশি স্বচ্ছ এবং প্রশ্নাতীত থাকা প্রয়োজন। আমাদের দেশে আমানতকারীদের আমানতের ঝুঁকির ওপর কোনো বীমা করা থাকে না, তাই বিষয়টিতে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার।
যখন সরকার একটি ব্যাংককে জনগণের টাকা দিয়ে ব্যবসা করার লাইসেন্স দেয় তখন সরকারের ওপর অনেক বেশি দায়-দায়িত্ব চলে আসে। কারণ লাইসেন্স দেওয়ার মাধ্যমে সরকার এ নিশ্চয়তা দেয় যে, ব্যাংকটি জনগণের জমাকৃত আমানতের নিরাপত্তা ও ব্যবহারে দক্ষতার পরিচয় দেবে। একজন আমানতকারীকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, একটি ব্যাংক যদি আপনাকে ২০ শতাংশ সুদ দেয় কিন্তু আমানতের ১০০ ভাগ নিরাপত্তা সন্দেহজনক, আরেকটি ব্যাংক ১০ শতাংশ সুদ ও আমানতের ১০০ ভাগ নিরাপত্তা দেয় তাহলে আপনি কোন ব্যাংকে আমানত রাখবেন? তবে দেখা যাবে সচেতন ওই লোকটি অবশ্যই দ্বিতীয় ব্যাংকেই তার আমানতের টাকা রাখবেন। অর্থাত্ আমানতকারীদের কাছে আমানতের নিরাপত্তা অনেক বড় বিষয়। সরকারকে মনে রাখতে হবে লাইসেন্স দেওয়ার মাধ্যমে সরকার প্রকৃতপক্ষে ব্যাংকের এ নিরাপত্তা দেওয়ার বিষয়টির নিশ্চয়তা দিচ্ছে। তাই এখানে অন্তত রাজনৈতিক বিবেচনায় কোনো সিদ্ধান্তে আসা উচিত নয়।
নতুন ব্যাংক কী ধরনের সুবিধা দিতে পারে এটা আগে জানা প্রয়োজন। এ মুহূর্তে দেশে যে পরিমাণ ব্যাংক রয়েছে, তাতে বোঝা যায়, এখন নতুন ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তা সন্দেহজনক। ১৯৮০ সালেও আমাদের দেশে মাত্র ১৭টি ব্যাংক ছিল সেখান থেকে ২০১০ সালের মধ্যে ব্যাংকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৭টি। একই সময়ে ব্যাংক শাখার পরিমাণ ৪ হাজার ৬৭টি থেকে বেড়ে ৭ হাজার ৭শ’টিতে দাঁড়িয়েছে। আমাদের প্রতি ১ হাজার বর্গকিলোমিটারে ৫৩টি ব্যাংক শাখা রয়েছে। অথচ ভারতে প্রতি ১ হাজার বর্গকিলোমিটারে ব্যাংক শাখা রয়েছে ২৪টি আর পাকিস্তানে মাত্র ১০টি। বাংলাদেশে প্রতি ২০ হাজার মানুষের জন্য একটি ব্যাংক শাখা রয়েছে। যেখানে পাকিস্তানে প্রতি ২০ হাজার ৩৪০ জনের জন্য একটি ব্যাংক শাখা আর ভারতে প্রতি ১৪ হাজার ৪৮৫ জনের জন্য একটি ব্যাংক শাখা রয়েছে।
এসব দিক বিবেচনা করে দেখা যায় আমাদের দেশে আরও নতুন ব্যাংক দেওয়া হলে ব্যাংকিং সেক্টরে অতিরিক্ত প্রতিযোগিতা তৈরি হবে। এতে করে ব্যাংকগুলোর মুনাফা কমে যেতে পারে। ফলে কিছু ব্যাংক পড়ে যেতে পারে তীব্র ঝুঁকির মধ্যে। এমনিতেই বর্তমানে বেশ কিছু ব্যাংক রয়েছে যাদের আর্থিক অবস্থা খুব একটা সন্তোষজনক নয়। নতুন ব্যাংক দেওয়া হলে দুর্বল ব্যাংকের ওপর চাপ আরও বেড়ে যাবে। তাই দুর্বল ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী না করে নতুন ব্যাংক অনুমোদন দেওয়া ঠিক হবে না। বলা হচ্ছে, নতুন ব্যাংক দেওয়া হলে ব্যাংকের সেবা সহজলভ্য হবে। অথচ বর্তমানে যে পরিমাণ ব্যাংক আছে সেগুলোই শহরাঞ্চলের সেবা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
গ্রামাঞ্চলে ব্যাংকিং সেবার কিছুটা স্বল্পতা রয়েছে। তাই নতুন ব্যাংক দেওয়া হলে গ্রামাঞ্চলের জন্য দেওয়া যেতে পারে। তবে এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো নতুন বেসরকারি ব্যাংক শুধু গ্রামাঞ্চলে ব্যবসা করে মুনাফার মাধ্যমে টিকে থাকতে পারবে কি না। গ্রামাঞ্চলে ব্যাংকিং ব্যবসা করার খরচ অনেক বেশি। সেজন্য মুনাফাভিত্তিক বেরসকারি ব্যাংকের শুধু গ্রামাঞ্চলে শাখা পরিচালনার মাধ্যমে টিকে থাকার কোনো উদাহরণ পাওয়া যায় না। তাই ক্ষুদ্রঋণ এবং সরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে ব্যাংকিং সেবা দেওয়া হয়।
ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় আমাদেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকিতে উন্নতি হলেও কিছু দুর্বলতা রয়ে গেছে। দক্ষ ও পর্যাপ্ত লোকবলের অভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তফসিলি ব্যাংকগুলোকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তফসিলি ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশিত সিডিআর (ক্রেডিট ডিপোজিট রেশিও), তারল্য, পর্যাপ্ত মূলধন রাখা, সঠিক হিসাবায়ন এবং শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের পরিমাণ (শেয়ারবাজার এক্সপোজার) অমান্য করলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক সঠিক সময়ে সঠিকভাবে তদারকি করতে পারছে না। তাই তদারকির সক্ষমতা বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংকে দক্ষ ও পর্যাপ্ত লোকবল নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে ব্যাংকিং সেক্টরের উন্নতি হলেও এখনও অনেক সমস্যা রয়ে গেছে যা সমাধান করা প্রয়োজন। সব দিক বিবেচনা করে নতুন ব্যাংক দেওয়ার আগে ব্যাংকিং সেক্টরকে আরও বেশি শক্তিশালী করতে হবে। বিশ্ব অর্থনীতিতে চলমান আর্থিক সংকট থেকেও বাংলাদেশ শিক্ষা নিতে পারে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ আমেরিকার কিছু ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা খুব একটা শক্তিশালী না হওয়ায় এর বিরূপ প্রভাব পরে মার্কিন অর্থনীতিতে। এ বাস্তবতায় আমাদের ব্যাংকগুলোর মূলধন আরও শক্তিশালী করা দরকার। অন্যথায় ব্যাংকগুলো ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর পরিশোধিত মূলধনের যে নির্দিষ্ট মানদ বর্তমানে রয়েছে তা ৪শ’ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে অন্ততপক্ষে ৬০০ কোটি টাকা করা দরকার।
লেখক : ভাইস চেয়ারম্যান, পলিসি রিসার্চ
ইনস্টিটিউট (পিআরআই)