এ তো দিনদুপুরে ডাকাতি

প্রিন্ট সংস্করণ

http://paimages.prothom-alo.com/contents/cache/images/0x400x1/uploads/media/2017/06/02/2c9bcf70cf7a252cabc1294bced0fe75-593077785ac67.jpgআহসান এইচ মনসুরনতুন করে ব্যাংকে টাকা রাখার ওপর কর বাড়ানো হলো, এটা ব্যতিক্রমধর্মী পশ্চাৎপসরণ। সার্বিকভাবেই তো আমানতের ওপর সুদ কমছে। ফলে আমানতকারীরা দুভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সুদ কমছে, করও বাড়ছে। আমানতকারীরা এখন শঙ্কিত, তারা কোথায় যাবে। একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে বলতে পারি, এ সিদ্ধান্তটাই আত্মঘাতী। এর ফলে আমাদের আর্থিক খাতে ছায়া অর্থনীতির পরিমাণ বাড়বে। লেনদেন যেভাবে ব্যাংকিং খাতে হওয়ার সুযোগ ছিল, তা আর হবে না। এতে কর আদায় ও আর্থিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা কমবে। অল্প কিছু অর্থের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এমন খারাপ পরামর্শ সরকার কেন গ্রহণ করল, এটা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। এর মাধ্যমে সরকার যে পরিমাণ আয় করবে, ব্যাংকবিমুখ হওয়ায় তার চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে সরকার।
আমরা চাই, দেশে বৈধ আর্থিক মাধ্যমে লেনদেন বাড়ুক। তবে অতিরিক্ত করের মাধ্যমে তা নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে, আবার এসব টাকা নিয়ে সরকারি ব্যাংক টিকিয়ে রাখা হচ্ছে, এটা কোন ধরনের নীতি? জনগণকে এভাবে নিরুৎসাহিত করে আমরা অদক্ষ ব্যাংক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। এটা কোনো মতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। জনগণ এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দেখাবে বলে আমি মনে করি। কারণ, হিসাব থেকে এভাবে টাকা কেটে নিতে পারে না, সবাই তো সুদের ওপর কর দিচ্ছেই। এটা তো দিনদুপুরে ডাকাতি।
২৬ বছর ধরে বাংলাদেশে ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ছিল, এখনো বহাল থাকল। যেসব পণ্যের ওপর সরকারের ভ্যাট বাড়ানোর সুযোগ ছিল, পণ্যমূল্য না বাড়াতে তা সমন্বয় করা হয়েছে। ভ্যাট বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমি মূল্যবৃদ্ধির কোনো সম্ভাবনা দেখি না; বরং কিছু পণ্যের মূল্য কমানোর সুযোগ আছে, কিন্তু ব্যবসায়ীরা তা করবেন না। ১৯৯১ সালে প্রথম এ ভ্যাট হার নির্ধারণ করা হয়েছিল, এটা বেশিও না, কমও না। এ থেকে ভালো রাজস্ব আয় হলে পরে কিছুটা কমানো যেতে পারে।
সম্পূরক শুল্ককে আমি বলব দেশীয় শিল্প সুরক্ষা নীতি। নৈতিকভাবে এসব শুল্ক বসাতে হলে দেশীয় ও বিদেশি পণ্য উভয় ক্ষেত্রেই বসানো উচিত। বাংলাদেশ অসামঞ্জস্যভাবে শুধু আমদানি পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক বসাচ্ছে। এটা সাময়িক হলে ঠিক ছিল। বেশি সুরক্ষিত শিল্প ভোক্তার জন্য ভালো না, দেশের সামগ্রিক আর্থিক পদ্ধতির জন্যও ভালো না। এটা অদক্ষ দেশীয় শিল্প খাতকে উৎসাহিত করে। কিছু গাড়ি আছে যা বাংলাদেশে সংযোজন করলে দাম হয় ৭৫ লাখ টাকা, আর কোরিয়া থেকে আমদানি হয়ে এলে হয় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। এ ধরনের দেশীয় শিল্প তো টিকে থাকার প্রয়োজন নেই। সুরক্ষার মাধ্যমে এমন কিছু খাত টিকে আছে এবং ভোক্তারা প্রতারিত হচ্ছে। কেন এখন বিস্কুটের ওপর ১০০-১৫০ শতাংশ কর দিতে হবে। ১০০ বছরের পুরোনো এ খাত কি এখনো প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখার মতো সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি?
বাজেটের চ্যালেঞ্জ মূলত রাজস্ব আয় ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ব্যয়ে। রাজস্ব আয় বাড়াতে ভ্যাটের ব্যবস্থা আধুনিকায়ন কার্যক্রম সঠিকভাবে ও দৃঢ়তার সঙ্গে চালাতে হবে। অনেকেই চেষ্টা করবে এই উদ্যোগকে ব্যর্থ করতে। সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি কিছু মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাও বিভিন্নভাবে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করবেন।
এডিপিতে ভালো কিছু প্রকল্প আছে। স্থানীয় সরকারে ভালো বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এখানে অর্থের অপচয় হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এসব কাজ গুণগত মানে ভালো করতে হবে। না হলে এসব কাজ ভোটের পক্ষে না এসে বিরুদ্ধেও চলে যেতে পারে।
আমি মনে করি, বাজেটের মন্দ দিক হলো আর্থিক খাতের কর বাড়ানো। এটা ঠিক হয়নি। মোবাইল ফোনের ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো ঠিক হয়নি। সিগারেটের ক্ষেত্রে নিম্নস্তরের ক্ষেত্রে দেশি ও বিদেশির জন্য দুটো ভাগ করা হয়েছে। এ ধরনের শ্রেণিবিন্যাস বৈদেশিক বিনিয়োগ নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সেটা সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে।
বাংলাদেশ ৭ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। ভবিষ্যতেও করবে। ব্যাপক বিনিয়োগ প্রয়োজন আছে, অর্থায়ন লাগবে। এ জন্য ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করতে হবে। ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে ‘ব্যর্থতা’ কোনো উপায় হতে পারে না। আয়কর খাতকেও ঢেলে সাজাতে হবে। ব্যাংক ব্যবস্থা বা একই ব্যক্তির ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ করে অর্থ সংগ্রহ করা ঠিক হবে না।
আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দামে বড় ওঠানামা হবে না। চালের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা হয়েছে। চাল আমদানিতে কর তুলে দিতে হবে। তাহলেই ভারত থেকে চাল আসবে, দামও কমে আসবে। তবে বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানি করাই ভালো।
বাজেটে প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে, তা অর্জন করা সম্ভব। তবে রপ্তানি আয়ে দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি, প্রবাসী আয়ে ঊর্ধ্বগতি না আসা পর্যন্ত স্বস্তির কোনো কারণ নেই। এটা চলতে থাকলে লেনদেন ভারসাম্যে টানাপোড়েন থাকবে। যা দীর্ঘ মেয়াদে সামষ্টিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রবণতা ফেলবে। প্রয়োজন হলে রপ্তানির স্বার্থে টাকার অবমূল্যায়ন করতে হবে। বাজেট বাস্তবায়নে মুদ্রানীতিকে সমন্বয় করতে হবে।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট

Dr. Ahsan H. Mansur

Dr. Ahsan H. Mansur

Dr. Mansur started his career as a Lecturer, Department of Economics, Dhaka University in 1976. He left for Canada for higher studies in economics in the same year. As a graduate student and research assistant, he was also offering regular economics courses at the undergraduate level at the University of ...

gog