এলডিসি থেকে উত্তরণ :প্রস্তুতিতে ছাড় নয়

এলডিসি থেকে উত্তরণ :প্রস্তুতিতে ছাড় নয়

অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিক থেকে বিশ্বের দেশগুলোকে উন্নত, উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত হিসেবে বিভাজন করা হয়ে থাকে। সত্তর দশকের গোড়ার দিকে জাতিসংঘের উদ্যোগে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা করা হয়। বাংলাদেশ ১৯৭৫ সালে সেই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। ইতোমধ্যে কয়েকটি দেশ এই তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হয়েছে। এলডিসি বা স্বল্পোন্নত থেকে কোন কোন দেশ বের হবে, সে বিষয়ে সুপারিশ করে থাকে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)। এ জন্য তিন বছর পরপর এলডিসিগুলোর ত্রিবার্ষিক মূল্যায়ন করা হয়। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা- এই তিন সূচকের ভিত্তিতে একটি দেশ উন্নয়নশীল দেশ হতে পারবে কিনা, সেই যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে ৩২ পয়েন্ট বা এর নিচে থাকতে হবে। মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ বা এর বেশি পয়েন্ট পেতে হবে। মাথাপিছু আয় সূচকে ১ হাজার ২৩০ মার্কিন ডলার থাকতে হবে।
২০১৮ ও ২০২১ সালের মূল্যায়নে মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা- এই তিন সূচকেই মান অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত শুক্রবার বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ করেছে সিডিপি। এবার বাংলাদেশের পাশাপাশি নেপাল ও লাওস এলডিসি থেকে বের হওয়ার সুপারিশ পেয়েছে। এর মধ্যে নেপাল ২০১৮ সালেই দ্বিতীয়বারের মতো মান অর্জন করেছিল। কিন্তু ভূমিকম্পের ক্ষতি কাটিয়ে উঠে দাঁড়াতে ওই বছর সুপারিশ করা হয়নি। সাধারণত সিডিপির চূড়ান্ত সুপারিশের তিন বছর পর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে চূড়ান্ত স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু করোনার প্রভাব মোকাবিলা করে প্রস্তুতি নিতে বাড়তি দুই বছর সময় দেওয়া হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশও বাড়তি সময় চেয়েছিল সিডিপির কাছে। সে হিসাবে এলডিসি থেকে বের হতে বাংলাদেশকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ তুলনামূলক সব দিক থেকে ভালো অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে চূড়ান্ত সুপারিশ পাওয়া নেপালের মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের চেয়ে কম। অন্যদিকে, বাংলাদেশ তিনটি সূচক অর্জন করলেও লাওস দুটি সূচক অর্জনের মাধ্যমে চূড়ান্ত সুপারিশ পেয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের লক্ষ্য ছিল, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণ ঘটানো। সেই লক্ষ্য একদিক থেকে অর্জিত হয়েছে। প্রস্তুতির জন্য বাংলাদেশকে তিন বছর সময় দেওয়া হয়েছে। চাইলে এ সময় আরও কমিয়ে আনা যেত। সরকারও সময় কমিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগী ছিল। কিন্তু পরে বাজার সুবিধার বিষয়টি চিন্তা করে তা করা হয়নি। এলডিসি হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অন্যান্য দেশে বাংলাদেশ যে বাজার সুবিধা পেয়ে আসছে, সরকার তা আরও কয়েক বছর বজায় রাখতে চায়। বাজার সুবিধা ধরে রাখতে আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোর পাশাপাশি প্রয়োজনীয় অন্যান্য পদক্ষেপও গ্রহণ করতে হবে।
এলডিসি থেকে বের হওয়ার সুপারিশ নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য বড় অর্জন। তবে এর চ্যালেঞ্জও আছে। জাতিসংঘের এই স্বীকৃতির ফলে বিশ্ববাজারে বর্তমানে বাংলাদেশ যেসব সুবিধা বর্তমানে পায়, তা বন্ধ হওয়ার সময় গণনা শুরু হলো। উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠলে সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া এবং বিভিন্ন রপ্তানি সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। এর পাশাপাশি ওষুধ শিল্পে মেধাস্বত্বের আন্তর্জাতিক আইনকানুনের অব্যাহতিও থাকবে না, যদিও এ ক্ষেত্রে আমরা আরও বেশি সময় পাব! কৃষিতে ভর্তুকি সুবিধা সীমিত করতে হবে। ২০১৬ সালেই বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা বাংলাদেশকে ‘ব্লেন্ড কান্ট্রি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ফলে আমরা ইতোমধ্যে উচ্চ সুদ পরিশোধে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। সুতরাং সহজ শর্তে ঋণ না পেলেও খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা নয়। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ফলে বাণিজ্য প্রতিযোগিতা সক্ষমতার ওপর যে বিরূপ প্রভাব পড়বে, তা মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। বিশ্ববাজারে বিপণন ও বিনিয়োগ আকর্ষণ এ ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে। তবে মূল সমস্যা হলো, একমাত্র ভুটান ছাড়া আর কোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের এফটিএ বা পিটিএ নেই। আমাদের উন্নত দেশগুলো ছাড়াও ভারত ও চীনের মতো বড় বড় উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে এফটিএ বা পিটিএ করতে হবে। দেশের বাণিজ্যে স্থানীয় শিল্পের জন্য সুরক্ষা কমানো না হলে অন্য দেশ পিটিএ বা এফটিএতে আগ্রহী হবে না। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ঘাটতি রয়েছে।
অন্যদিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) জিএসপি প্লাস পাওয়ার জন্য আমাদের চেষ্টা করতে হবে। যদি জিএসপি প্লাস পাওয়া কঠিন হয় বা পাওয়া না যায়, তাহলে এর বিকল্প কিছু পেতে হবে। কিন্তু এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করতে যে ধরনের সুরক্ষাগত ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্যাপাসিটি থাকা দরকার, তা আমাদের নেই। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির এই প্রক্রিয়া শুরুর পাশাপাশি দেশের ভেতরেও প্রতিযোগিতা বাড়াতে অভ্যন্তরীণ অনেক কাজ করতে হবে। আমাদের পরিবহন, বন্দর, আইসিটি অবকাঠামো উন্নয়ন করার মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানিতে ব্যয় কমানো যেতে পারে। এর সঙ্গে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে এবং বিদ্যুতের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে। কাজেই শুধু আন্তর্জাতিক বাজার সুবিধার দিকে নজর রাখলে চলবে না। আমরা দেখেছি, যুক্তরাষ্ট্রে তেমন বাজার সুবিধা না পেলেও আমরা শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছি। বাজার সুবিধা না থাকলেও যে আমরা টিকে থাকতে পারি, সে দৃষ্টান্ত আমাদের আছে।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে বেসরকারি খাতে গবেষণা ও উন্নয়নের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সবকিছু মিলিয়ে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। প্রস্তুতিটা নিতে হবে গভীরভাবে। প্রস্তুতির এই সময়ে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে সব সুযোগ-সুবিধা পেতে থাকবে। তা ছাড়া বর্তমান নিয়মে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে বাংলাদেশ ২০২৬ সালের পর আরও তিন বছর অর্থাৎ ২০২৯ সাল পর্যন্ত শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা ভোগ করতে পারবে।
এলডিসি থেকে বের হওয়ার অনেক সুবিধাও রয়েছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী হবে। উন্নয়নের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের কদর বাড়বে এবং উন্নয়নশীল দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা মর্যাদা পাব। এর পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হবেন। দেশের ক্রেডিট রেটিং বাড়বে। বাংলাদেশের বড় ধরনের ব্র্যান্ডিং হবে। এখানকার অর্থনীতি উদীয়মান এবং এখানে বড় বাজার সৃষ্টি হচ্ছে- এমন বার্তা বিশ্ববাসী পাবে। এলডিসি থেকে উত্তরণের অন্যতম শর্ত হলো, অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হওয়া। বাংলাদেশ এ শর্ত পূরণ করতে পেরেছে মানে অর্থনীতিতে তুলনামূলক কম ঝুঁকি রয়েছে। এসব বিষয় বিনিয়োগকারীদের উপলব্ধিতে বিনিয়োগের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এই সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগাতে হবে।
মনে রাখতে হবে, গরিব দেশ হয়ে থাকার মধ্যে কোনো মর্যাদাবোধ নেই। এতে হয়তো সস্তায় কিছু সুবিধা পাওয়া যাবে, কিন্তু সেখানে আত্মতুষ্টি বা আত্মবিশ্বাস থাকবে না। কাজেই শুধু বাজার সুবিধার কথা চিন্তা করে পেছনে পড়ে থাকা যাবে না। দ্রুত এলডিসি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এতে বাংলাদেশের নাগরিকরা সারাবিশ্বে মর্যাদার সঙ্গে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে।

নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট

 

Dr. Ahsan H. Mansur

Dr. Ahsan H. Mansur

Dr. Mansur started his career as a Lecturer, Department of Economics, Dhaka University in 1976. He left for Canada for higher studies in economics in the same year. As a graduate student and research assistant, he was also offering regular economics courses at the undergraduate level at the University of ...

gog