সরকারের নীতিনির্ধারকদের কালক্ষেপণের কারণে নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পুরোপুরি প্রস্তুতি নিতে পারেনি। এখন পর্যন্ত ঘোষণা দেওয়া হয়নি, ভ্যাটের হার কী হবে, কীভাবে ভ্যাট নেওয়া হবে, রেয়াত কীভাবে নেবেন ব্যবসায়ীরা? অটোমেশনও পুরোপুরি হয়নি। তবে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের একধরনের সমঝোতা হয়েছে। শোনা যাচ্ছে নতুন আইনে ভ্যাটের স্তরগুলো হবে এ রকম-আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ, উৎপাদন পর্যায়ে ১০ শতাংশ, পাইকারি পর্যায়ে সাড়ে ৭ শতাংশ এবং খুচরা পর্যায়ে ৫ শতাংশ। পৃথিবীর কোথাও এমন স্তরভিত্তিক ভ্যাট হার নেই। অন্য দেশে পণ্য বা সেবাভিত্তিক একাধিক ভ্যাট হার আছে।
নতুন আইনের স্তরভিত্তিক ভ্যাট হার বেশ অসামঞ্জস্যপূর্ণ। ব্যবসায়ীরা রেয়াত নিতে না পারলে এটি আবগারি শুল্কের মতো হয়ে যাবে। রেয়াতের টাকা কীভাবে দেওয়া হবে, সে বিষয়ে পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না। একটি উদাহরণ দিয়ে বলা যেতে পারে, কোনো প্রতিষ্ঠান ১০০ টাকার কাঁচামাল আমদানি করতে গিয়ে ১৫ টাকা ভ্যাট দিল। দাম পড়ল ১১৫ টাকা। উৎপাদক ১২০ টাকায় পণ্যটি তৈরি করল। সেখানে ১০ শতাংশ হারে ১২ টাকা ভ্যাট দিল। এরপর ওই একই উৎপাদক যখন খুচরা পর্যায়ে ১৪০ টাকায় পণ্যটি বিক্রি করবে, তখন ভোক্তার কাছ থেকে ৭ টাকা আদায় করে সরকারের কাছে জমা দিতে হবে। কিন্তু ওই উৎপাদক যখন ১২ টাকা রেয়াত চাইবে, তখন সরকারকে ৭ টাকা তো দিতেই হবে না, বরং আরও ৫ টাকা পাবে। নতুন আইনে ব্যবসায়ীরা রেয়াত চাইতে শুরু করলে সরকারকে পকেটের টাকা দিতে হবে। এ জন্য বছরে ৩০-৪০ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়ে যেতে পারে। এভাবে নতুন আইনটি কার্যকর হতে পারে না।
সরকারের পক্ষে যদি ভ্যাটের রেয়াতের টাকা ফেরত দেওয়া সম্ভব না হয়, তবে ভ্যাট কার্যত আবগারি শুল্কে পরিণত হবে। এতে করের ওপর আবার করারোপ হবে। জিনিসপত্রের দাম সাড়ে ৩৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। ভোক্তার ওপর চাপ বাড়বে। এই বাড়তি অর্থ কি ভোক্তা দেবেন? নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে একটি গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা আছে।
নতুন আইনটির পুরোনো আইনের সঙ্গে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই, বরং পুরোনো আইনের চেয়ে খারাপ। আগে যেখানে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায় করতে কষ্ট হয়, এখন যদি সাড়ে ৩৮ শতাংশ ভ্যাট হয়, তবে কীভাবে আদায় করবেন? যদি রেয়াতবিহীনভাবে আইনটি চালু হয়, তবে হঠাৎ করে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যেতে পারে।
বিশ্বজুড়েই বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানের যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ কেনে। পরে বড় প্রতিষ্ঠান সেসব যন্ত্রাংশ সংযোজন করে পূর্ণাঙ্গ পণ্য তৈরি করে। এতে দেশজুড়েই শিল্পের বিকাশ ঘটে। কিন্তু নতুন ভ্যাট আইনটি হলে ছোট শিল্প টিকতে পারবে না। বড়রা আরও বড় হবে। ভ্যাটের রেয়াত নেওয়া সম্ভব না হলে সাব-কন্ট্রাকটিং বন্ধ হয়ে যাবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ বিঘ্নিত হবে।
করদাতার সংখ্যা বাড়াতে হলে আগামী পাঁচ-সাত বছর করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধি করা উচিত নয়। যুক্তরাষ্ট্রে বার্ষিক আয় সাড়ে চার হাজার ডলার হলেই কর দিতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সব নাগরিক এখন করের আওতায় এসে গেছে। বার্ষিক মাথাপিছু আয়ের মাত্র সাড়ে ৭ শতাংশ আয় হলেই সে দেশে কর দিতে হয়। আর বাংলাদেশে বার্ষিক মাথাপিছু আয়ের ১৬০ শতাংশ আয় করেও কর দিতে হয় না। কয়েক বছর করমুক্ত আয়সীমা স্থির রাখলে আরও বেশি মানুষ করের আওতায় আসবে। এটি কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে সহায়তা করবে।
করপোরেট কর হার এ দেশে এমনিতে অনেক বেশি। তারপর করারোপের ক্ষেত্রে বৈষম্যও আছে। যেমন টেলিকম ও ব্যাংক খাত দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা খাত। এই দুটি খাতের কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হলেও কর সুবিধা পায় না। করপোরেট কর বেশি হলে প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যায়। তাই করপোরেট কর কমানো উচিত। সার্বিকভাবে রাজস্ব খাতেও বড় সংস্কার প্রয়োজন।
সামনের দিকে যাওয়ার জন্য এখন আমরা ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে আছি। এ জন্য স্বার্থান্বেষী মহলকে পাশ কাটিয়ে ব্যাপক সংস্কার লাগবে। কঠোরভাবে ব্যাংক খাত পুনর্গঠন করতে হবে। আমি মনে করি, এ মুহূর্তে ১০-১২টির বেশি ব্যাংকের দরকার নেই। এ জন্য অনেক ব্যাংক একীভূত করা উচিত। এখন একটিও আন্তর্জাতিক মানের ব্যাংক নেই। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনে ব্যাপক সম্পদ লাগবে। এই সম্পদ আসতে হবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। তাই সম্পদ আহরণ বাড়াতে রাজস্ব খাতে বড় সংস্কার প্রয়োজন। সার্বিকভাবে বড় ধরনের সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা লাগবে। যেকোনো সরকারের প্রথম দিকেই এ ধরনের সংস্কার কার্যক্রম নেওয়ার উপযুক্ত সময়।
*আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট