বাংলাদেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃত। সামনে লক্ষ্য উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া। বিশ্বের দেশগুলোকে গ্রস ন্যাশনাল ইনকামের (জিএনআই) ভিত্তিতে বিভিন্ন গ্রুপে শ্রেণিবদ্ধ করেছে বিশ্বব্যাংক। মধ্যম আয়ের মধ্যেও দুটি ভাগ তারা করেছে_ নিম্ন ও উচ্চমধ্যম আয়। সর্বশেষ সংজ্ঞা অনুযায়ী ১০৪৬ থেকে ৪১২৫ ডলার পর্যন্ত মাথাপিছু গড় আয় হলে নিম্নমধ্যম এবং ৪১২৫ থেকে ১২ হাজার ৭৩৫ ডলার পর্যন্ত উচ্চমধ্যম আয় ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ মাথাপিছু গড় আয় ১৩১৪ ডলারে পেঁৗছানোর পরেই প্রথম ধাপে পা ফেলার স্বীকৃতি মেলে। এক সময়ে ধারণা ছিল, নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে ২০২১ সাল লেগে যাবে। ওই বছরটি আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ে উন্নীত হওয়ার জন্য একটি চমৎকার সময়কেই বেছে নেওয়া হয়েছিল। তবে আমাদের বড় অর্জন, নির্ধারিত সময়ের ছয় বছর আগেই বিশ্বসমাজ থেকে এ স্বীকৃতি মিলেছে। এখন লক্ষ্য পরবর্তী ধাপে পেঁৗছানো। তবে সেটা ২০২১ সালে অর্জন করা যাবে না। বর্তমান সরকার এ জন্য নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে_ ২০৩০ সাল। এ লক্ষ্যে পেঁৗছাতে কিছু অবশ্য করণীয় নির্ধারণ করা হয়েছে। হাত দেওয়া হয়েছে বড় ধরনের সংস্কার কাজে।
আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার পরপর কয়েক বছর ছিল ৬ শতাংশের কাছাকাছি। উন্নত বিশ্বের অর্থনীতিতে মন্থর গতি এমনকি মন্দার সময়েও আমরা এ হার বজায় রাখতে পেরেছিলাম। এরপর লক্ষ্য নির্ধারিত হয় ৭ শতাংশের গণ্ডিতে পেঁৗছা। সেটাও অর্জিত হয়েছে। এখন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ২০৩০ সালে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশের সারিতে যেতে হলে বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার হতে হবে ৮ শতাংশ বা তারও বেশি। ২০১৭ থেকে ২০৩০_ এই দীর্ঘ সময় প্রবৃদ্ধির এই উচ্চ হার বজায় রাখতে হবে। আমাদের সামনে অভিজ্ঞতা নিয়ে আছে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীন। তারা বছরের পর বছর ১০ শতাংশ বা তার বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে বলেই উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ হতে পেরেছে। এখন তাদের লক্ষ্য বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতির দেশে পরিণত হওয়া। এভাবে তারা পেছনে ফেলে দেবে যুক্তরাষ্ট্রকে। ভারতও এ ধাপে পেঁৗছাতে চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশের জন্য আরেকটি টার্গেট নির্ধারিত আছে_ ২০৩০ সালে চরম দারিদ্র্যাবস্থায় আর কেউ জীবন কাটাবে না। বর্তমানে প্রায় ১২ শতাংশ নারী-পুরুষ রয়েছে অতি দরিদ্র। এর অর্থ হচ্ছে প্রায় দুই কোটি লোক এখনও অতি দরিদ্র রয়ে গেছে এবং তাদের জীবনমান উন্নীত করার কাজ মোটেই সহজ হবে না। তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা_ এসব নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য চাই বাড়তি সম্পদ এবং আমাদেরই তা সৃষ্টি করতে হবে।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি বছরে ৮ শতাংশে নিয়ে যেতে হলে অপরিহার্য করণীয় কী কী? আমরা প্রকৃতই কি ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি, এটা নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন। তবে তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হচ্ছে, ৭ শতাংশের উচ্চ হার কি আমরা ধরে রাখতে পারব? এ প্রশ্ন ওঠার প্রধান কারণ আমাদের অর্থনীতিতে শিল্প খাতের কাঙ্ক্ষিত হারে প্রবৃদ্ধি না হওয়া। এখনও এ খাত তৈরি পোশাক ও বস্ত্রশিল্প-নির্ভর। অন্যান্য খাতে তেমন অগ্রগতি নেই। আবার পোশাক খাতেও সমস্যা রয়েছে। আমাদের পোশাকের বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা এবং ইউরোপের কয়েকটি উন্নত দেশ। এ বাজারে কোনো সমস্যা সৃষ্টি হলে তার বিরূপ প্রভাব পড়ে আমাদের ওপর। সঙ্গত কারণেই ‘বিয়ন্ড আরজি অ্যান্ড টেক্সটাইল’ স্লোগান সামনে চলে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণিজ্য মেলা উদ্বোধন উপলক্ষে প্রদত্ত ভাষণে রফতানি বাণিজ্য গতানুগতিকতামুক্ত করার তাগিদ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, নতুন বাজার খুঁজতে হবে। নতুন নতুন পণ্য উৎপাদন করতে হবে। তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন পাট ও চামড়া শিল্পের কথা। এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। প্রযুক্তির ওপর জোর দিতে হবে। দক্ষ শ্রমশক্তি বাড়াতে হবে। ভারত, চীন ও অন্যান্য দেশ এ পথেই চলেছে। আমাদের জিডিপির তুলনায় বিনিয়োগ এখন পর্যন্ত ২৮ শতাংশ। ২০২১ সালে এ হার ৩৪ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারিত রয়েছে। এটা কি সম্ভব? বর্তমানে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ জিডিপির ২২ শতাংশ। আর সরকারি খাতে ৬ শতাংশ। সরকারি বিনিয়োগ ৮ শতাংশ করতে হলে চাই বাড়তি সম্পদ। এ জন্য রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। বর্তমানে জিডিপির ১০.৫ থেকে ১১ শতাংশ রাজস্ব আয় হয়ে থাকে। বছরে এ হার ১৪ শতাংশে নিতে হবে।
ঝড়-বন্যা, জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ রক্ষা করে উন্নয়ন_ এসবও আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা আমাদের জন্য বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে, এ শঙ্কা বিশেষজ্ঞদের রয়েছে।
বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য অপরিহার্য শর্ত হচ্ছে কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস কমিয়ে আনা। দক্ষ কর্মী সংখ্যা বাড়ানো আরেকটি শর্ত। বর্তমানে মোট শ্রমিকের মাত্র ২৫ শতাংশ দক্ষ। উন্নত ও উন্নয়নশীল যে কোনো দেশে এ হার অনেক বেশি। বর্তমানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রয়েছে। এটা ভালো লক্ষণ। এ পরিস্থিতি যেন বজায় থাকে, সেটা নিশ্চিত করা রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি_ সবার দায়িত্ব। কিন্তু উৎপাদনশীল খাতে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে হলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে আরও বেশি বিনিয়োগ করতে হবে। অবকাঠামো উন্নত করতে হবে। সড়ক ও রেল যোগাযোগ, বন্দর, বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাত_ সবকিছুতে চাই বাড়তি মনোযোগ।
প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো শক্তিশালী করাও বড় চ্যালেঞ্জ। ব্যাংকিং খাতে রয়েছে প্রচুর আমানত। কিন্তু খেলাপি ঋণের বোঝা উদ্বেগজনক। শিল্পায়নের জন্য চাই জমি; কিন্তু শহরে জমি মিলছে না। সরকার স্পেশাল ইকোনমিক জোন করছে। কয়েকটির কাজও শুরু হয়েছে। জমি কেনাবেচার কাজটি ডিজিটাল করার লক্ষ্য অর্জনে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি নেই।
বিকেন্দ্রীকরণও যথাযথ মনোযোগ পাচ্ছে না। রাজধানী ঢাকার ওপর সবকিছুতেই আমাদের নির্ভরতা। স্থানীয় সরকারের নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠানই যথেষ্ট নয়। তাদের হাতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং অনেক ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ছেড়ে দিতে হবে।
উন্নয়ন সহযোগীরা বাংলাদেশের সম্ভাবনার কথা বারবার বলছেন। চীন, ভারত, জাপান এবং বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের ঋণ সহায়তার প্রস্তাব রয়েছে। চীন থেকে বাংলাদেশ বছরে ৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে; কিন্তু বছরে রফতানি মাত্র ৮০ কোটি ডলার। রফতানি বাড়াতে হলে আমাদের চাই নিজস্ব উৎপাদন বাড়ানো। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি মেটাতে না পারার প্রধান কারণও এই পণ্য ভাণ্ডারে যথেষ্ট মজুদ না থাকা। এখন এদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। চীন প্রায় চার হাজার কোটি ডলার ঋণের প্রস্তাব দিয়েছে। তারা বেসরকারি খাতের উন্নয়নেও সহায়তা দিতে অঙ্গীকার করেছে। কিন্তু তারা যদি দেখে, ঋণ কাজে লাগানোর
ক্ষেত্রে অগ্রগতি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নেই, তাহলে অন্য দেশে চলে যাবে।
উন্নতির হার দ্রুততর করতে গবেষণা কাজেও আমাদের মনোযোগ বাড়াতে হবে। এ জন্য সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে। আমাদের যেমন চাই নতুন প্রযুক্তি, তেমনি শ্রমশক্তিকেও দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। যারা এ ক্ষেত্রে উদ্যোগী হবে, সরকারকে তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে এখন শিল্পের চাহিদা মেটানোর কাজকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। চীন গবেষণা কাজে জিডিপির ২ শতাংশ ব্যয় করছে। কিন্তু আমরা রয়েছি শূন্যের কাছাকাছি। উচ্চমধ্যম আয়ের দেশের সারিতে যেতে হলে এটা অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। উন্নত প্রযুক্তি মিলতে পারে উন্নত বিশ্ব থেকে। এ ঘাটতি পূরণ হতে পারে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে। বিনিয়োগ এলে প্রযুক্তি আসবে। উন্নত বিশ্বের পাশাপাশি এশীয় দেশগুলোও আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের পররাষ্ট্রনীতিতে লুক ইস্ট গুরুত্ব পাচ্ছে। এটা ভালো লক্ষণ। তবে হাতে অনেক কাজ। চীনের প্রেসিডেন্ট বা জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সফর হলেই এ উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার জন্য কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিনিয়োগ আসবে না।
এটা ঠিক যে, সরকার কয়েকটি অগ্রাধিকার প্রকল্প নির্ধারণ করেছে। যেমন পদ্মা সেতু, এলএনজি টার্মিনাল, মেট্রোরেল। এগুলো দ্রুত শেষ করা চাই। প্রয়োজন হলে নতুন প্রকল্প গ্রহণ কমিয়ে দিয়ে হাতে যেসব প্রকল্প রয়েছে সেগুলোর কাজ শেষ করতে হবে। মনে রাখা দরকার যে, সময়মতো কাজ শেষ করতে পারলে তা অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক। আমরা অনেক প্রকল্প হাতে নিলাম, কিন্তু কাজ চলল মন্থর গতিতে_ এটা কাম্য নয়। সড়ক, বন্দর, রেল, বিদ্যুৎ, গ্যাস_ প্রতিটি খাতেই এ বিষয়টির ওপর জোর দিতে হবে। যদি দক্ষ ও যোগ্য প্রতিষ্ঠানকে কিছু বেশি অর্থ দিয়েও সময়মতো কাজ শেষ করানো যায়, সেটাই কাম্য। এটাকে আমরা বলতে পারি টাইম ভ্যালু অব মানি। কেউ ১০০ কোটি টাকার কাজের ঠিকাদারি পেয়ে তিন বছরের কাজ শেষ করতে পাঁচ বছর লাগিয়ে দিল, আর কেউ ১০০ কোটি টাকার কাজ পেল ১২০ কোটি টাকায়; কিন্তু কাজ শেষ করল সময়মতো। এ দুটি বিষয়ের মধ্যে বেছে নেওয়ার সময় এসেছে। এখন বড় প্রকল্প হাতে রয়েছে পদ্মা সেতু। চীনের প্রতিষ্ঠান সেতু নির্মাণ ও নদী নিয়ন্ত্রণের কাজ পেয়েছে। সরকারকে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে সময়মতো এ প্রকল্প সম্পন্ন করার জন্য। এটাই সময়ের দাবি। একই সঙ্গে যে কোনো প্রকল্পের কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিও গুরুত্বপূর্ণ। দেশি কিংবা বিদেশি সময়মতো ও নিখুঁতভাবে যারা কাজ করতে পারবে, তাদেরই
কাজ দিতে হবে। এভাবে চলতে পারলে আগামী ১৫-১৬ বছর টানা ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন আর অসম্ভব মনে হবে না_ উচ্চমধ্যম আয়ের দেশও নিছক স্বপ্ন থাকবে না।