এই সময়ে আইএমএফের ঋণ নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করায় সরকারকে সাধুবাদ দিতে হবে। বিশেষ করে আইএমএফ-এর ঋণ সংশ্লিষ্টতার সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থনৈতিক টিমে যারা আছেন, তারা খুব দ্রুত আইএমএফ-এর প্রোগ্রামটাতে ভালোভাবে নেগোসিয়েশন করতে পেরেছেন। আরেকটি কারণ হলো, তারা এত তাড়াতাড়ি ঋণ পাওয়ার নিশ্চয়তা তৈরি করতে পেরেছেন।
দ্বিতীয়ত, সরকারের পক্ষ থেকে অনেক কিছুই হয়তো কমিটমেন্ট বা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কী কী বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তা আমরা জানি না। কারণ, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার বা আইএমএফ কারোর পক্ষ থেকেই পরিষ্কার করে জনসম্মুখে বলা হয়নি। তবে আমরা কিছুটা অনুমান করছি যে এই ঋণের সঙ্গে যে সমঝোতা হয়েছে, তার ফলে সমস্যায় পড়া ব্যাংকিং খাত ও রাজস্ব খাতের বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রমে হাত দেওয়া হতে পারে।
এছাড়া মুদ্রানীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার এক্সচেঞ্জ মার্কেট সংস্কারের অন্তর্ভুক্ত হতে হতে পারে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এগুলোর সংস্কার এমনিতেই হওয়া উচিত। যুক্তিসঙ্গত কারণেই এগুলো সংস্কার হওয়া দরকার। এখানে সরকারের অনেক কিছুই করার আছে। এই ক্ষেত্রে বলা যায়, এখন আইএমএফ-এর সঙ্গে এই প্রোগ্রামটা হাতে নেওয়া খুবই সময়োপযোগী হয়েছে।
সবাইকে বুঝতে হবে, বাংলাদেশে এখনও ক্রাইসিস তৈরি হয়নি। তবে আমরা কিছুটা ‘ডিফিকাল্ট সিচুয়েশনে’র মধ্যে আছি। ক্রাইসিস সিচুয়েশনে যাওয়ার আগেই আইএমএফের প্রোগ্রামে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য খুবই ইতিবাচক হয়েছে।
আমার মনে হয়, ফেব্রুয়ারির আগেই অর্থাৎ জানুয়ারিতে ঋণের প্রথম কিস্তি পাওয়ার জন্য সরকারের চেষ্টা করা উচিত ছিল। চেষ্টা করলে হয়তো কয়েক সপ্তাহ আগেই পাওয়াও যেতো।
এখন যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো, আমরা জানি যে আমাদের এক্সচেঞ্জ মার্কেটে এখনও ডলারের টানাপড়েন চলছে। ডলার সংকটের কারণে অনেক ব্যাংক এলসি খুলতে পারছে না। অনেক ব্যাংক এলসি নিষ্পত্তি করতে পারছে না। এছাড়া সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক এককভাবে ডলার বিক্রি করছে এই মার্কেট স্থিতিশীল রাখার জন্য। আমি আশা করি, আইএমএফ-এর প্রোগ্রামের কারণে এর উন্নতি হবে। এছাড়া বিশ্বব্যাংক ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকসহ অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকে আমরা আরও বড় আকারে অর্থ সহায়তা পাবো বলে আমি আশা করি। আমাদের এখনই কিছু কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
যেমন, বাংলাদেশ ব্যাংক আগের মতো পুরোনো নিয়মে ডলারের বিনিময় মূল্য নির্ধারণ করতে পারে। যেহেতু আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। প্রতিমাসে গড়ে এই রিজার্ভ কমছে ১.২ থেকে ১.৩ বিলিয়ন ডলার করে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়।
আইএমএফের ঋণের টাকা পেতে ফেব্রুয়ারি মাস লেগে যাবে। এই যে তিন মাস অন্তর্বর্তীকালীন সময়, এই সময়টায় ঋণ পাওয়ার আশা করে বসে থাকাটা উচিত হবে না। কারণ, এই তিন মাসে আমাদের রিজার্ভ আরও কমে যাবে। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই তিন মাসে অন্তত চার বিলিয়ন ডলার কমে যাবে। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আছে ২৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ফেব্রুয়ারিতে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ দাঁড়াবে ২২ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। এটা তখনকার জন্য খুবই অস্বস্তিকর। এই তিন মাসে আমদানির ক্ষেত্রে আরও কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। এলসি নিষ্পত্তি ঠিক রাখার পাশাপাশি নতুন এলসি খোলার ব্যাপারে আরও কঠোর হতে হবে। ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স আনার জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। রফতানি আয় বাড়ানোর জন্য চেষ্টা চালাতে হবে। যদিও এখন রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স কমে যাচ্ছে।
এই তিন মাসের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবস্থাপনা ঠিক করা না গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে বহির্বিশ্বের কাছে যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, তা আরও ঘনীভূত হবে।
শুধু আইএমএফের জন্য নয়, বহির্বিশ্বের কাছে দেশের ইমেজ ঠিক রাখতে হলে নিজেদের জন্য এখনই বেশ কিছু উদ্যোগ হাতে নিতে হবে। আইএমএফের জন্য বসে থাকা যাবে না। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করার সুযোগ নেই। আমরা জানি, এই অর্থবছরে যে পরিমাণ অর্থ আইএমএফ দেবে, এর সঙ্গে বিশ্বব্যাংক বা এডিবিসহ বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকে অর্থ পেতে পারি, তার পরিমাণ হয়তো সর্বোচ্চ হবে তিন থেকে সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার। কিন্তু আমাদের অর্থের দরকার আরও কয়েকগুণ। যেভাবে রিজার্ভ কমছে, এর ধারাবাহিকতায় যদি আগামী ৭ থেকে ৮ মাস সামনের সময়কে বিবেচনা করি তাহলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উদ্বেগজনক পর্যায়ে নেমে আসতে পারে। কাজেই আমাদের পলিসি এমনভাবে নিতে হবে যেন চাহিদার দিক থেকে এবং সরবরাহের দিক, দুদিক থেকেই আমরা সমন্বয় রক্ষা করতে পারি এবং যেকোনও দিকের সমস্যা মোকাবিলা করতে পারি।
এখানে আমাদের করণীয় কী:
আইএমএফের প্রোগ্রামে করণীয় থাকুক বা না থাকুক আমাদের করণীয় বের করতে হবে। সরকারকে পরামর্শ দেবো, আমাদের আমদানি আরও কমাতে হবে। এমনিতে আগামী মাসগুলোতে আমদানি কমবে, কিন্তু দেখতে হবে, সেটা আমাদের জন্য পর্যাপ্ত কিনা। মনে রাখতে হবে, আমদানি কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে এমন একটা সময়ে যখন রফতানিও কমছে, এমনকি রেমিট্যান্সও কমছে। ফলে রেমিট্যান্স ও রফতানি এই দুই জায়গায় যদি উন্নতি করতে না পারি, তাহলে আমদানি আরও অনেক কমাতে হবে। ফলে মনে রাখতে হবে সিচুয়েশনটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এই ঝুঁকিপূর্ণ সিচুয়েশনে আমাদের অবস্থা বুঝেই ব্যবস্থা নিতে হবে।
তবে আমরা আশাবাদী, নতুন আমন ধান উঠলে হয়তো চালের বাজার কিছুটা স্থিতিশীল হবে। শীতকালীন শাকসবজি ফলমূল ও অন্যান্য খাদ্যের দাম কমে আসবে। কিন্তু সরকারকে দেখতে হবে, নতুন চাল ওঠার পর বাজার নিম্নমুখী হচ্ছে, নাকি হচ্ছে না। চাল ছাড়াও অন্যান্য খাদ্যপণ্য নিয়ন্ত্রণে আসছে কিনা তাও দেখতে হবে।
যদি নিম্নমুখী না হয় তাহলে বুঝতে হবে সরবরাহে ঘাটতি আছে। তখন আমাদের ত্বরিত আমদানির সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একই সঙ্গে দেশের বাজার থেকে আমন সংগ্রহ না করার দিকটাও বিবেচনা করতে হবে। সরকারি গুদামগুলো ভরতে হবে বাইরে থেকে আমদানি করে ধানে। এছাড়া সরকারের খাদ্য কর্মসূচিও আমদানি করা চাল দিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। দেশের বাজার থেকে চাল কিনে খাদ্য কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে গেলে বাজারের ওপর চাপ পড়বে।
শতভাগ আমদানি করা চাল দিয়ে খাদ্য কর্মসূচি বাস্তবায়ন করলে মূল্যস্ফীতির উন্নতি হবে। ধান ও চাল আমদানি করতে হবে সরকারের নিজের জন্যই। সেটা আগে থেকেই করতে হবে।
সামনেই শীতকাল। আমাদের আগে থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে যেন বোরো মৌসুমে কোনও রকমের বিদ্যুৎ ঘাটতি না হয়। এছাড়া এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে বোরো মৌসুমে হাওর অঞ্চলে যেন বাঁধ ভেঙে আগাম বন্যায় ফসলের ক্ষতি না হয়। মনে রাখতে হবে, আমরা গত দুই বছর পরপর হাওর অঞ্চলে ফসলের ক্ষতি হতে দেখেছি। এবারও যেন একই পরিস্থিতির তৈরি না হয়।
আমি মনে করি, বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ হবে বা হতে পারে এমনটা মনে করার কোনও কারণ নেই। তবে খাদ্য নিরাপত্তা আমাদেরই করতে হবে। এজন্য খাদ্যের ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ যথাযথভাবে হচ্ছে কিনা দুদিকেই নজর দিতে হবে।
সরবরাহ পরিস্থিতি যদি ভালো করতে পারি, তাহলে আমরা সমস্যায় পড়বো না। এখানে আইএমএফের কিছু করারও নেই। আমাদেরকেই করতে হবে বিদ্যুতের সরবরাহ বাড়িয়ে। হাওর অঞ্চলে বাঁধ ভেঙে যাতে না যায় তার ব্যবস্থা নিতে হবে। এর মধ্য দিয়ে আমন এবং বোরো ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারি এবং রক্ষা করতে পারি, তাহলে মূল্যস্ফীতি নিম্নমুখী রাখা সম্ভব হবে। একইসঙ্গে খাদ্য সংরক্ষণে বিশেষ করে শাকসবজির সংরক্ষণে বিশেষ নজর দিতে হবে। ব্যক্তি খাতকে এই খাদ্য সংরক্ষণে নিয়ে আসার ব্যাপারে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। এখন শুধু আলু সংরক্ষণ হয় বেসরকারি খাতে। বেসরকারি খাত যদি শাকসবজি ফলমূল মাছ মাংসসহ সব ধরনের খাদ্য সংরক্ষণে বিনিয়োগ করার সুযোগ পায় তাহলে বহুলাংশে খাদ্যের সংকট দূর হবে। এই সেক্টরে ব্যক্তি উদ্যোগকে উৎসাহিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পলিসি সাপোর্ট দিতে হবে। এক্ষেত্রে ট্যাক্স মওকুফ অথবা অন্য যেকোনও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর মধ্য দিয়ে হতে পারে। সার্বিকভাবে আমি বলবো, আইএমএফের এই ঋণ কার্যক্রম আমাদের বাজারকে স্থিতিশীল করতে সাহায্য করবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে, প্রোগ্রামে সরকার যেসব প্রতিশ্রুতি বা কমিটমেন্ট দিয়েছে সেগুলো যেন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করে। সরকার যেন শুধু প্রথম কিস্তির ঋণ পাওয়া ও জাতীয় নির্বাচন পাড়ি দেওয়ার চিন্তা না করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
আইএমএফের এই ঋণ কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য ৪২ মাসের যে পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে তার মধ্য দিয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। আমি আশাবাদী, এই সংস্কার কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে আমাদের ব্যাংকিং খাত ও রাজস্ব খাতে পরিবর্তন আসবে, পাশাপাশি অর্থনীতিতে স্থায়ী এবং উন্নত ব্যবস্থাপনা তৈরি হবে।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট