গত অর্থ বছরের দ্বিতীয়ার্ধেই বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে বেশ অস্থিরতা বিরাজ করছিল। এখনও এ অস্থিরতা বিদ্যমান রয়েছে এবং কিছু ক্ষেত্রে আরও ঘনীভূত হয়েছে। গত দু’তিন বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক অধিক তারল্য বাজারে সরবরাহ করেছে। বিশেষত বেসরকারি ঋণ দেওয়ার মাধ্যমেই এ তারল্য বাজারে প্রবাহিত হয়েছে। বাজারে তারল্য প্রবাহ বেশি হওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে দ্রব্যমূল্যের ওপর, প্রভাব পড়েছে শেয়ারবাজারের ওপর। শেয়ারবাজারে ঘটে যাওয়া বড় ধরনের বাবলের পেছনে বাজারে তারল্য প্রবাহের আধিক্য একটি কারণ হিসেবে কাজ করেছে। তাছাড়া তারল্য প্রবাহ অধিক হওয়া বৈদেশিক মুদ্রাবাজারেও এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে।
বর্তমান সময়ে দেশের লেনদেনের ভারসাম্যে একটা বড় ধরনের চাপ অনুভূত হচ্ছে। যা আগে ছিল না। গত বছরও সরকারের ফিসকাল পলিসি পরিকল্পনা অনুযায়ীই বাস্তবায়িত হয়েছে। যদিও সরকার ব্যাংক থেকে অনেক ঋণ গ্রহণ করেছিল। তখন নন-ব্যাংকিং সেক্টর থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছিল কম, যার ফলে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে সরকারি ঋণের পরিমান বাজেট প্রাক্কলনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। ফলে এ খাত থেকে অর্থনীতিতে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়নি। বছর শেষে সংশোধিত বাজেটে ঘাটতি কমে এসেছিল। তাই বড় ধরনের কোনো ঝুঁকির মধ্যে পড়েনি দেশের অর্থনীতি।
এই পটভূমিতে চলতি অর্থবছরের বাজেট করা হয় সরকারের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কৌশলের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। বাজেটে উচ্চ প্রবৃদ্ধির হার প্রাক্কলন করা হয়েছে এবং সেই সঙ্গে খরচেরও উচ্চ প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয় বাজেটে। কয়েকটি বিষয় বাজেটে খোলাখুলিভাবে আলোচনা করা হয়নি সেগুলো হলো— বাজেট নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিছু অনুমান। এর মধ্যে প্রথমত রয়েছে— বিদ্যুত্, তেল এবং অন্যান্য খাতে ভর্তুকি কমানোর মাধ্যমে এ সংক্রান্ত ব্যয়কে বাজেটের প্রাক্কলিত ব্যয়ের সীমার মধ্যে নিয়ে আসা। দ্বিতীয়ত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংস্কারমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ে উচ্চ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা। তৃতীয়ত হলো বৈদেশিক সাহায্যের উচ্চ ল্যমাত্রা প্রাক্কলন যার মূল ভিত্তি বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং অন্যান্য দাতা সংস্থা।
বাজেট বাস্তবায়নের ত্রে দেখা যাচ্ছে, সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী সময়মতো জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি না করার পাশাপাশি বৈদেশিক সাহায্য যথাযথভাবে না আসায় অর্থবছরের শুরুতেই সরকারকে ব্যাংক ঋণের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করতে হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের তিন মাসেই (২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) সরকার প্রায় ৮ হাজার ১৬২ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ করেছে। যা চলতি বাজেটে প্রাক্কলিত ব্যাংক ঋণের অর্ধেকেরও বেশি। যদিও সরকার গত মাসে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করে ভর্তুকি কিছুটা কমানোর চেষ্টা করছে। অন্য অনেক ত্রে যেমন বিদ্যুত্, কৃষি উপাদান এবং খাদ্যে ভর্তুকি এখানও কমানো হয়নি। ফলে সহসাই ব্যাংক ঋণ গ্রহণ কমে যাবে বলে মনে করা যাচ্ছে না। ইতিবাচক দিক হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের রাজস্ব আদায় এখন পর্যন্ত বেশ সন্তোষজনক। যদি ভর্তুকি সম্পর্কিত ব্যয় বাজেট প্রাক্কলনের সীমার মধ্যে নামিয়ে আনা না যায় এবং অতি দ্রুত বৈদেশিক সাহায্যের প্রবাহ বৃদ্ধি করা না যায় তবে সরকারি অতিরিক্ত ঋণের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি ভেস্তে যেতে পারে।
এই পরিপ্রেতে বিবেচনা করে বলা যায়, মূল্যস্ফীতির চাপ কমার আশা করা অনেকটাই অমূলক। কিছু চাপ গত অর্থবছরেই ছিল তার ওপর এবারের বাজেট থেকে নতুন কিছু চাপ যোগ হয়েছে। ব্যাংকিং খাতে যে তারল্য সংকট আগে ছিল সেটা সরকারের ঋণ গ্রহণের কারণে আরো ঘনীভূত হচ্ছে। সামনে এ প্রবণতা আরও বাড়তে পারে। কারণ আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে। রেমিট্যান্স আয় কমে আসায় আমানতের ওপর চাপ পড়ছে। একদিকে আমানতের প্রবৃদ্ধি কম হলে ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার মতাও কমবে। তার ওপর সরকার ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত পরিমাণে ঋণ করায় ব্যাংকগুলো বেসরকারি খাতে চাহিদা অনুযায়ী ঋণ দেওয়ার মতা খুব দ্রুত হারাচ্ছে। এদিকে শিল্প খাত চাহিদা অনুযায়ী ঋণ না পাওয়ায় বিনিয়োগের মাধ্যমে শিল্প প্রসার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে করে কমে আসছে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি। শিল্প বাধাগ্রস্ত হওয়ার ফলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থান তৈরির মাধ্যম। যা পুরো অর্থনীতিকেই নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। সরকার যদি সামনে ভর্তুকি কমাতে না পারে তবে সরকারকে আরও বেশি ব্যাংক ঋণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক বাধ্য হয়ে টাকা ছাপানোর পরিমাণ বাড়িয়ে দেবে। এতে করে অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতিজনিত চাপ আরও বেড়ে যেতে পারে।
একই কারণে মুদ্রামূল্যের ওপর ঋণাত্বক চাপও বেড়ে যাবে। মুদ্রামূল্য কমে যাওয়ার আরও দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, সামনের মাসগুলোতেও লেনদেনের ভারসাম্য বেশ চাপের মুখে থাকবে যেহেতু রেমিট্যান্স আসছে কম। সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স আয় হয়েছে আগস্টের তুলনায় প্রায় ২৩ শতাংশ কম। ফলে ইতিমধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। রিজার্ভ কমে এলে স্বাভাবিকভাবেই মুদ্রামূল্যের ওপর চাপ পড়বে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে মূল্যস্ফীতির পার্থক্যের কারণে আমাদের টাকার মান আরও কমে যাবে। আমাদের দেশের মূল্যস্ফীতি হলো প্রায় ১২ শতাংশ যেখানে বিশ্ব মূল্যস্ফীতির হার হলো মাত্র ৩ শতাংশ।
এদিকে ব্যাংক ঋণের অভাবে রিয়েল এস্টেট সেক্টরে কিছুটা স্থবিরতা নেমে এসেছে। রিয়েল এস্টেটের স্থবিরতার পেছনে মূলত দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত হলো রিয়েল এস্টেটের অতিমূল্য আর দ্বিতীয়ত হলো ব্যাংক ঋণের অভাব। রিহ্যাবের তথ্য অনুসারে ইতিমধ্যে ফ্যাট বিক্রি কমে গেছে ৩০ শতাংশ। আমাদের অর্থনীতিতে কন্সট্রাকশন খাতের অবদান হলো ৮ থেকে ১০ শতাংশের মতো। এ অবস্থায় রিয়েল এস্টেটে স্থবিরতা নেমে আসায় এ খাত আমাদের জন্য বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিকে পদ্মা সেতু ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো বিশাল প্রকল্পগুলোর কার্যক্রম স্থগিত হওয়ায় নির্মাণ খাতের প্রবৃদ্ধি আশানুরূপ হবে বলে মনে হয় না।
আশার দিক হচ্ছে যে, বহির্বিশ্বের প্রতিকূল অবস্থা সত্ত্বেও আমাদের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বেশ সন্তোষজনক। আগস্ট মাসে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৩০ শতাংশ। এক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো কাঁচামালের মূল্য ৩৩ থেকে ৫০ শতাংশ কমে যাওয়ার পরও দেশের পোশাক খাতে ৩০ শতাংশ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হওয়া খুবই আশাব্যঞ্জক। গ্রাহকদের চাহিদা চীন থেকে আমাদের দেশের দিকে ধাবিত হওয়াই এর অন্যতম কারণ। এ ধারা সামনেও চলতে থাকবে যদি আমরা এ খাতের বিদ্যুত্ ও অন্যান্য চাহিদা বজায় রাখার পাশাপাশি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারি। রপ্তানি খাতের এ প্রবৃদ্ধি আগামী মাসগুলোতে ধরে রাখতে পারলে এর সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন খাত যেমন পরিবহন, ব্যাংক, বীমাসহ বিভিন্ন খাতের প্রবৃদ্ধিও ভালো হবে। যা অর্থনীতিকে ইতিবাচভাবে প্রভাবিত করবে।
অনুকূল আবহাওয়া এবং তেমন বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না থাকায় আমনের ভালো ফলন আশা করা হচ্ছে। তাই কৃষি খাতের যে লক্ষ্যমাত্রা তা থেকে বিচ্যুতি ঘটার কোনো কারন এখনও প্রতিয়মান নয়। কৃষকরা এবার পাটের দাম কিছুটা কম পাওয়ায় আগামীতে পাট চাষ খানিকটা কমে আসতে পারে। তবে সে জায়গায় অন্যান্য ফসল চাষ হবে। মোদ্দাকথা কৃষিতে তেমন বড় কোনো আশঙ্কা আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে না।
উপরোক্ত পর্যালোচনার পরিপ্রেতে চলতি অর্থবছর সামগ্রিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখা অনেকটা চ্যালেঞ্জিং। মূল্যস্ফীতির চাপ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সরকারকে প্রতিকূল অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই চাপ সামাল দিতে যে অর্থনৈতিক নীতি দরকার তাও রাজনৈতিকভাবে অপ্রিয়। কারণ এ নীতির প্রধান বিষয় হলো সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির বাস্তবায়ন (যার ফলে সুদের হার বাড়তে পারে), জ্বালানির দাম বৃদ্ধি, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি এবং সার ও ডিজেলের দাম বৃদ্ধি। যা সরকারের এই মধ্যবর্তীকালীন অবস্থায় বাস্তবায়ন করা খুবই কষ্টকর। অন্যদিকে সরকার যদি এখনই যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে দেরি করে বা ব্যর্থ হয় সেক্ষেত্রে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আরও বেড়ে যাবে। আগামী দু’বছরে এ স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা আরও বেশি কষ্টকর এ কারণে যে ইতিমধ্যে রাজনৈতিক আন্দোলন ঘনীভূত হচ্ছে। পণ্যমূল্যবৃদ্ধি ও শেয়ারবাজারের ধসের প্রেক্ষাপটে যদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা না যায় তবে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলন আরও গতিশীল হবে। এ পরিপ্রেতে সরকারের নীতিনির্ধারকরা আগামী মাসগুলোতে কীভাবে এগুবেন এটাই এখন লণীয়।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)