বাংলাদেশের আর্থসামাজিক যে অবস্থা তাতে সরকারি খাতের বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে এবং থাকবে।
সরকারের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দারিদ্র্য বিমোচনে সামাজিক (শিক্ষা, স্বাস্থ্য) ও ভৌত অবকাঠামো খাতে প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখলাম এ ধরনের বিনিয়োগ এবং অভ্যন্তরীণ অতিরিক্ত চাহিদা আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতিকে চাপের মুখে ফেলে দিয়েছে। এর মূল কারণ হলো, বাজেটের ঘাটতি অর্থায়ন। বহির্বিশ্বেও অর্থায়নের মাধ্যমে পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘাটতি পূরণ করতে না পারায় সরকারকে অভ্যন্তরীণ খাতের ওপর বেশি নির্ভর করতে হয়েছে। যা অভ্যন্তরীণ বা বেসরকারি খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ফলে মার্কেটে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। এ পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে হলে প্রয়োজন অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায়ের হার দ্রুত বৃদ্ধি করা। যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে।
বর্তমানে বাংলাদেশের বাজেটের মাধ্যমে ব্যয়ের পরিমাণ জিডিপির প্রায় ১৬-১৭ শতাংশ। এ ধরনের ব্যয়ের পরিমাণ সামগ্রিকভাবে পার্শ্ববর্তী এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় বেশ কম। চাহিদা থাকা সত্ত্বেও এ ব্যয়ের আকারকে বৃদ্ধি করা বিশেষ করে উন্নয়নমূলক কাজের বিস্তৃতি ঘটানো কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ আমাদের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ জিডিপির মাত্র ১২ শতাংশের মতো। এর মধ্যে কর সংগ্রহের পরিমাণ প্রায় ১০ থেকে সাড়ে ১০ শতাংশ। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কর সংগ্রহের পরিমাণ তাদের জিডিপির ১৮ থেকে ১৯ শতাংশ। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে এর পরিমাণ আরও অনেক বেশি। কাজেই অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় ছাড়া সরকারের পক্ষে আর্থসামাজিক উন্নয়নমূলক বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সর্বদাই কঠিন হবে।
আমাদের কর ব্যবস্থার বিন্যাসের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, রাজস্ব আদায়ের প্রধান উত্স হলো মূল্য সংযোজন কর। তারপরই প্রত্যক্ষ কর বা আয়করের স্থান। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য শুল্কের মাধ্যমে আমাদের রাজস্ব আদায় তুলনামূলকভাবে কমছে, সামনে তা আরও কমবে। কারণ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থার উদারীকরণের ফলে এ খাত থেকে আয় আরও কমে যাবে। তাই ভবিষ্যতে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর জন্য এ খাতের ওপর নির্ভর করার কোনো উপায় নেই। এ প্রেক্ষাপটে আমাদের মূল্য সংযোজন করের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ে জোর দিতে হবে, যা ভোক্তার ভোগের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। বাংলাদেশের মতো দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিতে মিডল ক্লাস বা মধ্যম আয়ের পরিবার বিস্তৃত হচ্ছে। সুতরাং আমাদের সামষ্টিক ভোগের পরিমাণও দ্রুত বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক। কাজেই ভ্যাটের ভিত্তি বিস্তৃত হওয়ার সঙ্গে, ভ্যাট আমাদের রাজস্ব খাতের প্রবৃদ্ধির জন্য প্রধান সহায়ক হিসেবে ভবিষ্যতে কাজ করবে। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে ব্যক্তি এবং করপোরেট খাতের আয়ের পরিমাণও দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য বিস্তৃত হওয়ার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান নিজেরাই করপোরেট ব্যবস্থাপনার দিকে যাচ্ছে। আর্থিক খাত ও সেবা খাতের বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে আয়কর ব্যবস্থার ভিত্তিও ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা প্রত্যক্ষ করের প্রবৃদ্ধির জন্য বিপুলভাবে সহায়ক হতে পারে।
এ দুই খাতে যে ধরনের বড় সম্ভাবনা পরিলক্ষিত হচ্ছে তাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন হবে আমাদের কর ব্যবস্থার আধুনিকায়ন। এ আধুনিকায়ন দুই পর্যায়ে হতে হবে। কর ব্যবস্থার নীতিগত পরিবর্তন তথা কর আইনগুলোর সংস্কার এবং কর প্রশাসনের আধুনিকায়ন। একটি ছাড়া অন্যটির সফল প্রয়োগ ও অর্জন সম্ভব নয়। দুটোকেই সমানভাবে আধুনিকীকরণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ২০১২-এর বাজেট ঘোষণার সময় কর ব্যবস্থার আধুনিকায়ন সংক্রান্ত একটি পরিকল্পনা জাতীয় সংসদে পেশ করে। ওই প্রস্তাবনায় এ সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা রয়েছে। তবে সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এ আধুনিকায়ন পরিকল্পনার যে রূপরেখা তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা। এ পরিপ্রেক্ষিতে লক্ষণীয় যে, ভ্যাট আইনের খসড়া এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে, কেবল কেবিনেটের অনুমতির অপেক্ষায় রয়েছে। এ খসড়া আইনে ভ্যাট ব্যবস্থাকে সুস্পষ্টভাবে আধুনিকীকরণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে কর ব্যবস্থার কার্যকারিতা বৃদ্ধির জন্য আইনগত সহায়ক ব্যবস্থাও রাখা আছে। সঙ্গত কারণেই সরকার এ আইনকে ৩ বছর পর বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করেছে। কারণ সংস্কারমূলক কর প্রশাসনিক কাঠামোর সমন্বয় এবং কর কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সময়ের প্রয়োজন রয়েছে। এ সব পরিবর্তন আনতে হলে তার আইনগত ভিত্তি এখনই করতে হবে। যে কারণে নতুন ভ্যাট আইনকে আসন্ন বাজেটের সময়ই সংসদীয় অনুমোদন দেওয়া প্রয়োজন হবে। একই লক্ষ্যে প্রত্যক্ষ কর আইনের সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। হয়তো ২০১৪ অর্থবছরের মধ্যেই আইনগত ভাবে এর কাজ শেষ করা যাবে।
ভ্যাটের আওতায় তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে প্রায় ৭ লাখ, কিন্তু আইনগত বাধ্যতামূলক মাসিক ভ্যাট রিটার্ন দাখিল করে মাত্র ৬০ হাজারের মতো প্রতিষ্ঠান। যারা তাদের ভ্যাট রিটার্ন দাখিল করছে না তাদের আমাদের কর প্রশাসন ঠিকমতো ধরতেও পারে না তথ্যের অভাবে। ফলে কর ব্যবস্থায় একটি বড় সমস্যা হলো তথ্যপ্রযুক্তির অভাব। আমাদের বর্তমান কর প্রশাসন অনেকটা মান্ধাতা আমলের। আইনগত অনেক পরিবর্তন সত্ত্বেও স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে কর প্রশাসনে সামগ্রিক কোনো সংস্কার হয়নি। ব্রিটিশ উপনিবেশের কাছ থেকে আমরা যে কর ব্যবস্থা পেয়েছিলাম বর্তমানে আমরা বহুলাংশে তাই প্রয়োগ করছি। শুধু প্রশাসনের বিস্তৃতি হয়েছে মাত্র। কর ব্যবস্থায় আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির যে ঘাটতি রয়েছে তা দ্রুত দূর করতে হবে।
বাংলাদেশের রাজস্ব আদায়ে দুর্বলতা আমাদের সবারই জানা। আমাদের রাজস্ব বৃদ্ধির সম্ভাবনাও আছে প্রচুর। ভারতের মতো না হলেও যদি রাজস্ব আদায়ে কিছুটা উন্নতি করা যায় তবে বর্তমানের যে বাজেট ঘাটতি (জাতীয় আয়ের ৪-৫ শতাংশ) তা পূরণ করা সম্ভব হবে। কিংবা ঘাটতি বিদ্যমান রেখে উন্নয়নমূলক ব্যয় বাড়ানো সম্ভব হবে। এ ধরনের অর্জনের জন্য যে সামগ্রিক সংস্কার ও পরিবর্তন প্রয়োজন তা প্রতিহত করতে বিভিন্ন মহল থেকে প্রচার ও প্রচেষ্টা নেওয়া হচ্ছে এবং হবে। বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল থেকে এ ধরনের অপপ্রচার খুবই স্বাভাবিক। তবে সরকারের উচিত হবে এসব চাপের মুখে নতিস্বীকার না করে জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে এবং রাজনৈতিক তথা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য কর আইন ও কর প্রশাসনকে আধুনিকীকরণ করতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)