বেশ কিছুদিন ধরেই আমাদের জাতীয় অর্থনীতি চাপের মুখে রয়েছে। শেয়ারবাজার থেকে শুরু করে রিয়েল
এস্টেট, ব্যাংকিং খাত এবং বহির্বাণিজ্য— সব ক্ষেত্রেই এ চাপ ঘনীভূত হয়েছে, হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্¿ণে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নিয়েও বাজেটের অতিরিক্ত ভর্তুকির চাপের কারণে তা ঠিক রাখতে পারছে না। ইউরোজোনের ঋণ সংকটকে কেন্দ্র করে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে তা আমাদের অর্থনীতির বড় চালিকাশক্তি রফতানি খাতকেও বাধাগ্রস্ত করছে। ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে আগের মতো গতিশীলতা নেই। সব মিলিয়ে জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিমোচনের যে লক্ষ্যমাত্রা সরকার গ্রহণ করেছে তা অর্জনে পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবে অর্থনীতির সার্বিক দিক নিয়ে আশাভঙ্গের কিছু নেই। সঠিক পদক্ষেপ নিয়ে দৃঢ়ভাবে এগোতে পারলে এ অবস্থা থেকে দ্রুত উত্তরণ পাওয়া কঠিন হবে না।
জাতীয় অর্থনীতিতে প্রতিকূল অবস্থা সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। উচ্চ প্রবৃদ্ধিসম্পন্ন দেশ ভারতে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রভূত চেষ্টা সত্ত্বেও মূল্যস্ফীতি ও রুপির অবমূল্যায়ন সুষ্পষ্ট হয়ে উঠেছে। উল্লেখ্য, যে ভারতে ১২ বার সুদের হার বাড়ানোর পর গত কয়েক মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৭-৮ শতাংশে নেমে এসেছে। ইউরোপের ঋণ সংকটের ফলে রুপি ২০ শতাংশের অধিক অবমূল্যায়ন হয়েছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল ছোট অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় খাতের কিছুুু মৌলিক অব্যবস্থাপনার কারণে বড় ধরনের চাপ পড়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এ ধরনের অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হলে সুচিন্তিত পথে সঠিকভাবে ও দৃঢ়তার সঙ্গে এগোতে হবে। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা দূর করতে সর্বপ্রথম সরকারকে সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর কথা স্বীকার করে নিতে হবে। এরপর তা সমাধানে পদক্ষেপ নিতে হবে। পদক্ষেপগুলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেদনাদায়ক ও রাজনৈতিকভাবে অপ্রিয় হবে। এ ধরনের বেদনা ও রাজনৈতিক অপ্রিয়তাকে ছাপিয়ে সঠিকভাবে ও দৃঢ়তার সঙ্গে পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে ২০১২ সালের মধ্যেই সামগ্রিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে। এসব পদক্ষেপ বা করণীয় বিষয়গুলো নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে আলোচিত হয়েছে। তাই এগুলো নতুন কিছু নয়। যেটা প্রয়োজন তা হলো একটা সামগ্রিক নীতির অধীনে পলিসির সঠিক ও কঠোর বাস্তবায়ন করা। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে আলোকপাত করব ২০১২ সালের মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির ওপর।
গত তিন বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক যে মুদ্রানীতি নিচ্ছে শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। প্রতি বছরই মুদ্রানীতিতে মুদ্রা সরবরাহের প্রবৃদ্ধি ধরা হচ্ছে ১৫ থেকে ১৬ শতাংশের মতো। বছর শেষে প্রকৃত মুদ্রা সরবরাহ দাঁড়াচ্ছে ২২ থেকে ২৩ শতাংশ। মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হচ্ছে ১৭ থেকে ১৯ শতাংশের মতো। বছর শেষে তা ২৭ থেকে ২৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। এ ধরনের পরিকল্পনাসর্বস্ব মুদ্রানীতি পরিহার করে কীভাবে মুদ্রানীতির মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতিকে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নামিয়ে আনা যায় তা বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংককে কঠোর হতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের দ্বিধা বা সংকোচ করা যাবে না। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যক্তি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমে এসেছে। তা আরও কমাতে হবে। যাতে গড়ে ঋণের প্রকৃত প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রার গড় প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারের মুদ্রানীতির বাস্তবায়ন কিছুটা কঠিন হবে। কারণ সরকারের বাজেট ব্যবস্থাপনা অতিরিক্ত ভর্তুকির চাপে বেশ দুর্বল। ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংককে সর্বদাই সরকারের ঋণ নিশ্চিত করতে হবে, এক্ষেত্রে বাজেট ব্যবস্থাপনায় দ্রুত উন্নতি না ঘটলে অর্থাত্ ভর্তুকির চাপ কমাতে না পারলে মুদ্রানীতিকে কোনোভাবেই লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করা সম্ভব হবে না। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তঃব্যাংক মানি মার্কেটে (কলমানি মার্কেট) সুদ হার বর্তমানে যে উচ্চ হারে রয়েছে তা আরও বাড়তে দিতে হবে এবং তা কয়েক মাসের জন্য উচ্চ পর্যায়ে ধরে রাখতে হবে।
মুদ্রানীতি সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য এর সঙ্গে রাজস্বনীতিও সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। আমাদের রাজস্বনীতিতে কয়েকটি সমস্যা রয়েছে।
প্রথমত, বাজেটে সরকার বড় ধরনের ভর্তুকির প্রাক্কলন করা করেছে। বছর শেষে প্রাক্কলনের চেয়েও এ ভর্তুকির পরিমাণ অনেক বেশি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
৫ বছর আগেও যেখানে আমাদের জিডিপিতে ভর্তুকির অংশ ছিল ১ শতাংশের কম। তা চলতি অর্থবছরে ৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এত বেশি ভর্তুকির চাপ মেটাতে গিয়ে অর্থনীতির সব খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ভর্তুকি কমাতে সরকার কিছুটা দৃঢ়তার পরিচয় দিচ্ছে। ভর্তুকি কমাতে গত বছরে জ্বালানির দাম ৪ বার সমন্বয় করা হয়েছে। এটা রাজনৈতিকভাবে খুব কঠিনম তবে অর্থনৈতিকভাবে আবশ্যিক। প্রয়োজনে এক্ষেত্রে আরও কঠিন পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রকৃত ভর্তুকির পরিমাণ যেন বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে খুব বেশি না হয়ে যায় সে বিষয়ে কঠোরভাবে নজর রাখতে হবে।
দ্বিতীয়ত, বহির্বাণিজ্যের লেনদেনের ভারসাম্যের দিকে দেখলে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে নিট সংগ্রহ আয় ঋণাত্মক। এর একটি বড় কারণ হলো, বিদেশি অর্থায়নের প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে না পারায় বৈদেশিক সহায়তার অর্থ ছাড় করানো যাচ্ছে না। এ অবস্থা থেকে অবশ্যই উত্তরণ পেতে হবে। সেজন্য প্রয়োজন প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা, টেন্ডারিংয়ে স্বচ্ছতা এবং দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের দক্ষতা বাড়ানো। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে নজর দেওয়া যেতে পারে প্রজেক্ট পরিচালকদের ওপর। তাদের কাজের ওপর ভিত্তি করে পুরস্কার ও শাস্তি উভয়েরই প্রচলন করা যেতে পারে। যা দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।
তৃতীয়ত, ভর্তুকিজনিত চাপ কমাতে রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে রাজস্ব আদায়ে গতিশীলতা আনতে হবে। অর্থনীতির চাকা গতি হারালে রাজস্ব আদায়েও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যার কিছুটা প্রভাব এখনই রাজস্ব সংগ্রহের প্রবৃদ্ধিতে অনুভূত হচ্ছে। তাই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি আধুনিকায়ন পরিকল্পনা যথাযথভাবে এবং দ্রুত বাস্তবায়ন শুরু করতে হবে।
আমাদের অর্থনীতিতে বহির্বাণিজ্যের লেনদেনের ভারসাম্যহীনতা উদ্ভব হয়েছে ২০১১ সালে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির কারণে আমদানি প্রবৃদ্ধি ৪০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ায় এ ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে। কোনোভাবেই আমদানিতে এত বেশি প্রবৃদ্ধি হওয়া উচিত নয়। এতে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আমদানি প্রবৃদ্ধি বেশি হওয়ার মূল কারণ ছিল অভ্যন্তরীণ চাহিদার প্রবৃদ্ধি এবং বিদ্যুত্ খাতের তেল ও মূলধনী যন্¿পাতি আমদানি। ফলে সহজ ঋণ লভ্যতা, সম্পদের অতিমূল্যায়ন এবং বাজেট ঘাটতি বৃদ্ধি— এ তিনের সমন্বয়ে হয়েছে অভ্যন্তরীণ চাহিদা প্রবৃদ্ধি। উচ্চ প্রবৃদ্ধিসম্পন্ন আমদানির অর্থের উত্স ছিল অভ্যন্তরীণ খাত। যার জোগান দিতে গিয়ে আমাদের রিজার্ভের ওপর বড় রকমের চাপ পড়ে এবং দেশীয় মুদ্রার দ্রুত অবমূল্যায়ন হয়। আমাদের রিজার্ভ লেভেল যা ২০১০-১১তে ৫ মাস আমদানি মূল্যের চেয়েও বেশি ছিল তা ৩ মাসের আমদানি মূল্যে নেমে এসেছে। এ পরিস্থিতিতে টাকার অবমূল্যায়ন হতে দেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য সঠিক ছিল। অন্যথায় রিজার্ভ কমার হার আরও বেড়ে যেত। তবে মুদ্রামান কোনোভাবেই আর বেশি কমতে দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ তা ভর্তুকির ওপর চাপ সৃষ্টি করে বাজেট অর্থায়নের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে এবং মূল্যস্ফীিতকেও উস্কে দেবে।
বহির্বাণিজ্যের অভারসাম্যের এ পরিস্থিতিতে মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতিতে এ পরামর্শগুলো বাস্তবায়ন করা হলে বাংলাদেশ অতি সহজেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা সংস্থার (আইএমএফ) সঙ্গে এক ধরনের প্রোগ্রামে চলে আসতে পারে। যে অর্থনৈতিক নীতিমালা ওপরে বর্ণনা করা হয়েছে এ বৈশিষ্টগুলো দাতা সংস্থার কাছেও বিশেষভাবে গ্রহণযোগ্য হবে। আর্থিক সংকটের সময় আইএমএফের মতো সংস্থার কাছে দ্বারস্থ হওয়া বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়। অতীতে বাংলাদেশ অনেকবার আইএমএফের সমর্থিত অর্থনৈতিক নীতিমালা গ্রহণ করেছে। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের জন্যও এ ধরনের উদাহরণ রয়েছে। যেমন ্বর্তমানে গ্রিস, পর্তুগাল, আয়ারল্যান্ড এবং ফিনল্যান্ড। অতীতে দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত এবং যুক্তরাজ্যও দাতা সংস্থার দ্বারস্থ হয়েছে সংকটের সময়। আইএমএফের সঙ্গে একটি প্রোগ্রাম হলে আমাদের অর্থনীতিতে আস্থা বাড়তে সাহায্য করবে। রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় অতীব প্রয়োজনীয় শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। সেই সঙ্গে ১-২ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক সাহায্যও পাওয়া যাবে। যা আমাদের রিজার্ভ সংহত করতে সাহায্য করবে।
বাংলাদেশের বাজেটে এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে যে ধরনের ভারসাম্যহীনতা দেখা যাচ্ছে তা চিন্তার বিষয়। তবে আশাভঙ্গের কিছু নেই। এ সমস্যা মোকাবেলা করার জন্য আমাদের সামর্থ্য রয়েছে। আলোচিত পদক্ষেপগুলো সঠিকভাবে গ্রহণ করে সুচারুরূপে এবং দৃঢ়ভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। সঠিক নীতি গ্রহণ করলে দাতা সংস্থা ও সহযোগী দেশ থেকেও আর্থিক সাহায্য পাওয়া যাবে। যার মাধ্যমে আমরা এ অবস্থা থেকে অবশ্যই উত্তীর্ণ হতে পারব।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)