বিশ্বব্যাংক, অধ্যাপক ইউনূস এবং ড্যান মজিনার মন্তব্য

বিশ্বব্যাংকের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট পদের প্রার্থীকে অবশ্যই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা

এবং টিমকে নেতৃত্ব প্রদানের যোগ্যতা থাকতে হবে। এ বিবেচনায় এ পদের সম্ভাব্য প্রার্থীরা অধ্যাপক ইউনূসের কাছে ম্লান হয়ে যাবেন বলেই আমার ধারণা। তিনি শূন্য থেকে গ্রামীণ ব্যাংক ও গ্রামীণ ফাউন্ডেশন গড়ে তুলেছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপক ও কর্মীরা কেবল চাকরির জন্য সেখানে নেই। এ প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ও মহৎ আদর্শের প্রতি রয়েছে তাদের বিশ্বাস ও আস্থা। আমরা এমন একটি বিশ্বব্যাংকের কী স্বপ্ন দেখতে পারি যেখানে কর্মীরা বেতন-ভাতা ও পদোন্নতির পরিবর্তে প্রতিষ্ঠানের মহৎ আদর্শকে বড় করে দেখবে!

গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ইউনূসকে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট করার প্রস্তাব যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তরফে করা হয়, তখন কেউ কেউ তা ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেন, কেউবা মনে করেন নিছকই কথার কথা। শেষোক্ত দলের এমন ধারণার পেছনে হয়তো গ্রামীণ ব্যাংক থেকে তার স্থপতির অপসারণের বিষয়টি বিবেচনা পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবটি প্রথমে করা হয়েছিল ঢাকায় সফররত ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি পার্লামেন্টারি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনার সময়। সে সময়ে তারা কিছু বলেননি, কিন্তু পরদিন সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন_

এ প্রস্তাব ইতিবাচক এবং তা ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে সুবিবেচনা পেতে পারে। প্রতিনিধি দলের নেতা জিন ল্যামবার্টের বিবেচনায়, বিশ্বব্যাংকের প্রধান হিসেবে ড. ইউনূস একজন যোগ্য ব্যক্তি।

আমরা জানি যে, প্রথাগতভাবে এ মর্যাদার পদে এ পর্যন্ত কেবল আমেরিকান কাউকেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ কারণে অনেকে হয়তো মনে করেছেন, প্রস্তাবটি নিছকই সৌজন্যমূলক। তবে মঙ্গলবার রাজশাহীতে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা বলেছেন, ‘ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাজি হলে তাকে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়নের বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করবে যুক্তরাষ্ট্র। অনেক মানুষ বলেছে, যেটা করতে পারা যাবে না বলে মনে করা হয়, তিনি তা করে দেখিয়েছেন। আমি তার কাজের প্রশংসা করি।

যুক্তরাষ্ট্রের এ অবস্থানের কারণে গোটা বিষয় নিয়ে গভীরভাবে বিবেচনার সুযোগ এসেছে। আমি নিজে বিশ্বব্যাংকে ২৮ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করেছি। আমার বিবেচনায় প্রস্তাবটি চমৎকার এবং উদ্ভাবনীমূলক। প্রথমেই আমি এ পদে কীভাবে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হয়, সে বিষয়ে বলছি। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে কাউকে এ পদে বেছে নেওয়ার জন্য এটা জানা প্রয়োজন।

বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৪৪ সালে। এ পর্যন্ত এ সংস্থার ১০ জন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। তারা প্রত্যেকে মার্কিন নাগরিক এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকারই তাদের মনোনয়ন দিয়েছে। আরও একটি তথ্য_ এ পর্যন্ত সব প্রেসিডেন্ট ছিলেন পুরুষ। কোনো কোনো প্রেসিডেন্ট দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে এ বিশ্ব সংস্থার নেতৃত্ব দিয়েছেন। এদের মধ্যে রবার্ট ম্যাকনামার নাম উল্লেখ করা যায়। কেউ কেউ ছিলেন একেবারেই সাধারণ এবং এমনকি তাদের কাজ সংস্থার লক্ষ্য অর্জনের জন্য ক্ষতিকর মনে হয়েছে। এ প্রসঙ্গে পল উলফউইজের নাম করা যায়। তিনি এ গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড খুবই সীমিত করে ফেলেছিলেন। প্রতিষ্ঠার পর প্রথমবারের মতো তার আমলেই কর্মীরা বিদ্রোহ করে বসেন। আমি এ কথা এখন গর্বের সঙ্গে বলতে পারি যে, আমিও ছিলাম বিদ্রোহের অংশ। তবে বিশ্বব্যাংকের নির্বাহী পরিচালকদের বোর্ড ক্ষতির মাত্রা অনুধাবন করতে পারে এবং তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে পরিস্থিতি সামাল দেয়।

বিশ্বব্যাংকের কর্মকাণ্ড বিভিন্ন প্রেসিডেন্টের আমলে সমান গতিতে চলেনি এবং এ অভিজ্ঞতা স্মরণে রেখে এ মর্যাদার সংস্থার শীর্ষ পদে মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। পল উলফউইজের পদত্যাগের সময় এ বিষয়টি স্বীকৃত হয়। বোর্ড একটি মনোনয়ন প্রক্রিয়াও ঘোষণা করে, যাতে মেধাই প্রধান বিবেচ্য হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে এখন পর্যন্ত অগ্রগতি দেখছি না। যুক্তরাষ্ট্র থেকেই এ পদে মনোনয়ন দেওয়ার ধারা চলছে।

মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় নির্বাহী পরিচালকরা যে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন বিশ্বব্যাংকে তাদের শেয়ারের হিস্যা বিবেচনায় নেওয়া হয়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে সবচেয়ে বেশি ভোট_ ১৫.৮ শতাংশ। এর পরের স্থান জাপানের_ ৯.৪ শতাংশ। জার্মানির শেয়ার ৪.৯, ফ্রান্সের ৪.৪ এবং ব্রিটেনের ৪.৪ শতাংশ। এ পাঁচটি দেশ মোট ভোটের প্রায় ৩৯ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। ব্রেটন উডস প্রতিষ্ঠানের আরেকটি হচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ। প্রথা অনুযায়ী ইউরোপের কেউ এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান পদে নিযুক্ত হন। ইউরোপীয় দেশগুলো এবং জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট পদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে আসছে। এ পদে যাকে মনোনয়ন দেওয়া হলো তার যোগ্যতা রয়েছে কি-না, সেটা কখনোই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি।

ভোটের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা না হলে সেরা প্রার্থী বেছে নেওয়ার চিন্তা কাজে আসবে না। যুক্তরাষ্ট্র যদি তার অবস্থানে পরিবর্তন আনায় অনিচ্ছুক থাকে, তাহলে এ লক্ষ্য অর্জন প্রকৃতই দুরূহ। এ বাস্তবতায় অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস কিংবা অন্য কোনো নাম এ পদে বিবেচনার জন্য প্রস্তাব করার কোনো যুক্তি রয়েছে কী?

আমি দুটি ভাগে এর উত্তর দেব। প্রথমেই বলব অধ্যাপক ইউনূসের প্রার্থিতা বিষয়ে। দারিদ্র্য দূর করা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে তার অবদান বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট পদে তার মতো যোগ্য ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া কঠিন। উদ্ভাবনী ক্ষমতা, সাংগঠনিক দক্ষতা এবং নেতৃত্বের অনন্য গুণাবলি রয়েছে তার।

বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট পদে এমন কাউকে দরকার যার রয়েছে দূরদৃষ্টি। অধ্যাপক ইউনূস উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন একজন ব্যক্তি। তিনি এমন স্বপ্ন দেখেন এবং দেখান, যা বাস্তবের কাছাকাছি থাকে। সহায়সম্পদহীন নারী-পুরুষকে কেবল ব্যক্তিগত জিম্মায় ঋণ প্রদানের ধারণা উন্নয়নশীল বিশ্বে বৈপ্লবিক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এখন ভাবতে বিস্ময় লাগে যে তিনি তিন দশক আগে এ ধারণা কেবল উদ্ভাবন করেননি, বাস্তবে তা প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন। অর্থনৈতিক উদ্যোগের জন্য পুরুষের পরিবর্তে নারীকে সামনে নিয়ে আসাও চমকপ্রদ ধারণা। বেশিরভাগ উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বেদনাদায়কভাবে কম। অর্থনৈতিক উদ্যোগে তারা পিছিয়ে। এ অব্যবহৃত সম্পদ কাজে লাগানোর ধারণা সুফল দিয়েছে। বাংলাদেশ এবং আরও কয়েকটি দেশের রেকর্ড বলছে, তাদের ঋণ প্রদান বৃথা যায়নি, বরং অগণিত পরিবার এবং সার্বিকভাবে দেশের জন্য তা মঙ্গল নিয়ে নিয়েছে। ব্যক্তির পরিবর্তে কয়েকজনের একটি দলকে ঋণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার কারণে ঝুঁকির মাত্রা অনেক কমে এসেছে।
অধ্যাপক ইউনূসের দূরদর্শিতার আরেকটি দৃষ্টান্ত তার সামাজিক ব্যবসার ধারণা।

বিশ্বব্যাংকের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট পদের প্রার্থীকে অবশ্যই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং টিমকে নেতৃত্ব প্রদানের যোগ্যতা থাকতে হবে। এ বিবেচনায় এ পদের সম্ভাব্য প্রার্থীরা অধ্যাপক ইউনূসের কাছে ম্লান হয়ে যাবেন বলেই আমার ধারণা। তিনি শূন্য থেকে গ্রামীণ ব্যাংক ও গ্রামীণ ফাউন্ডেশন গড়ে তুলেছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপক ও কর্মীরা কেবল চাকরির জন্য সেখানে নেই। এ প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ও মহৎ আদর্শের প্রতি রয়েছে তাদের বিশ্বাস ও আস্থা। আমরা এমন একটি বিশ্বব্যাংকের কী স্বপ্ন দেখতে পারি যেখানে কর্মীরা বেতন-ভাতা ও পদোন্নতির পরিবর্তে প্রতিষ্ঠানের মহৎ আদর্শকে বড় করে দেখবে!

সবশেষে বলতে চাই, বিশ্বব্যাংকের নেতাকে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনের জন্য নানা দেশের সমর্থন পেতে হবে। এ কাজের জন্যও তিনি উপযুক্ত। বিশ্বব্যাপী তিনি নন্দিত। রাষ্ট্রনেতারা যেমন তেমনি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্তরাও তাদের কাজের ইতিবাচক মূল্যায়ন করছেন। তার চিন্তাকে বাস্তবে প্রয়োগ করার জন্য যেসব উদ্যোগ তিনি নিয়েছেন তার প্রতি সব মহল থেকে মিলেছে সমর্থন ও সহায়তা। বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশের একজন নাগরিক হয়েও তিনি বিশ্বের শীর্ষনেতাদের কাছ থেকে মর্যাদা ভোগ করে আসছেন। যুক্তরাষ্ট্র্রের সাবেক জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এবং তার স্ত্রী বর্তমানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন রয়েছেন তার সেরা বন্ধুদের তালিকায়। এ গুণের কারণে বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান সুচারুরূপে পরিচালনা করা তার পক্ষে সম্ভাব্য অন্য প্রার্থীদের তুলনায় সহজ হবে বলে আমি মনে করি।

হ্যাঁ, আমি অধ্যাপক ইউনূসের পক্ষে অনেক কিছু বলে ফেলেছি। কিন্তু তাতেই সব হয়ে যাবে না। এ পদের নির্বাচন প্রক্রিয়া আমাদের মনে রাখতে হবে। যদি যুক্তরাষ্ট্র যোগ্যতাকে স্বীকৃতি দেয়, বিদ্যমান বাস্তবতায় সেটাই একমাত্র পথ। বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার মন্তব্য এ ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে আশা জোগায়। মঙ্গলবার রাজশাহীতে সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, ‘মুহাম্মদ ইউনূস যদি বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়নের জন্য রাজি থাকেন, তাহলে আমি নিশ্চিত তাকে ওই পদের জন্য বিবেচনা করা হবে।’

আমার ধারণা, বিল ও হিলারি ক্লিনটন অধ্যাপক ইউনূসকে এ পদে নিয়োগদানে আগ্রহ দেখালে তারা ওবামা প্রশাসনকে এ বিষয়ে রাজি করাতে পারবেন। প্রেসিডেন্ট ওবামা নতুন ধ্যান-ধারণাকে সর্বদাই স্বাগত জানান এবং সম্ভবত এ অভিনব প্রস্তাব গ্রহণ করায় তার আপত্তি থাকার কথা নয়। একটি কথা শোনা যাচ্ছে, হিলারি ক্লিনটন নিজেই প্রার্থী হতে পারেন। এমনটি ঘটলে বিশ্বের সর্বত্রই তাকে স্বাগত জানানো হবে এবং আমি নিশ্চিত যে অধ্যাপক ইউনূসও থাকবেন তাদের দলে। বিশ্বব্যাংককে নেতৃত্ব প্রদানের জন্য তিনি যোগ্য ব্যক্তি তাতে সন্দেহ নেই। এ পদে তিনি প্রথম মহিলাও হবেন।

কিন্তু হিলারি ক্লিনটন যদি প্রার্থী না হন এবং অধ্যাপক ইউনূস যদি এ সংস্থাকে নেতৃত্ব প্রদানে সম্মত থাকেন তাহলে আশা করতে পারি যে পরবর্তী পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা সহজ হয়ে যাবে। তার বলিষ্ঠ সমর্থন পেলে বিশ্বব্যাংকের প্রধান পদে যোগ্যতা প্রধান মানদণ্ড হিসেবে স্বীকৃত হতে পারবে এবং এ সংস্থা যাত্রা শুরু করবে প্রকৃত পরিবর্তনের পথে।

সাদিক আহমদ :ভাইস চেয়ারম্যান, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ

sahmed1952@live.com

Dr. Sadiq Ahmed

Dr. Sadiq Ahmed

Dr. Sadiq Ahmed began his career as a Lecturer in Economics at the Dhaka University in 1974 and later worked at the Bangladesh Institute of Development Studies as a Research Fellow. Dr. Ahmed did his MSc from London School of Economics and PhD from Boston University. He joined the Young ...

gog