বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময় পার করছে। এরই মধ্যে ঘোষণা করা হলো নতুন মুদ্রানীতি।
পত্রপত্রিকায় এটির ভালোমন্দ দিকগুলো বিশ্লেষণ করে অনেক অর্থনীতিবিদ মতামত দিয়েছেন। আমি সেদিকে যেতে চাই না। তার চেয়ে নতুন মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ ও করণীয় সম্পর্কেই এখানে আলোচনা করা ভালো। বিশ্ববাস্তবতা ও দেশে সাম্প্রতিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আমলে নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এখন উচিত অবিলম্বে কী উপায়ে দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল পর্যায়ে নিয়ে আসা যায়, সে চেষ্টা করা। অস্থিতিশীল পরিস্থিতি একটি দেশের অর্থনীতির শক্তিকে নীরবে ও ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে দেয়।
প্রশ্ন উঠতে পারে, নতুন মুদ্রানীতিতে এমন কী চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা অর্থনীতিবিদদের চিন্তিত করে তুলছে? আমি মনে করি, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চ্যালেঞ্জ মূলত দুটি। প্রথমটি হলো, রেকর্ড মূল্যস্ফীতিকে দুই অঙ্কের কোটা থেকে সহনীয় পর্যায় অর্থাত্ ৫ শতাংশে পরিষ্কারভাবে নামিয়ে আনা এবং দ্বিতীয়টি হলো, জরুরি ভিত্তিতে নমিনাল এক্সচেঞ্জ রেটে স্থিতিশীলতা ফেরানো। এ ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকদের মাথায় রাখা প্রয়োজন, মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রা বিনিময় হার আন্তঃসম্পর্কযুক্ত; তাই এসবের সমাধান বিচ্ছিন্নভাবে করা যাবে না। মুদ্রা বিনিময় হার সুস্থিত করতে চাইলে মূল্যস্ফীতিকে অবশ্যই ৪-৫ শতাংশের মধ্যে ধরে রাখতে হবে। আমাদের মুদ্রা বিনিময় হারে অস্থিরতা সৃষ্টির অন্যতম দৃশ্যমান কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে মূল্যস্ফীতি সূচকের পার্থক্য বেড়ে যাওয়া। আবার মূল্যস্ফীতি কমাতে চাইলে এ পার্থক্যের মান নামিয়ে আনা দরকার। এসব দিক বিবেচনা করে যৌক্তিকভাবেই বলা যায়, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক কর্মসূচি হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে সামাল দেয়া।
এটি নিয়ন্ত্রণের উপায় কী? কীভাবে উচ্চ মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিতে মুদ্রানীতি পরিচালনা করতে হয়? এসব বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা অনেক বলেছেন; আমিও লিখেছি প্রচুর। তবু এ ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক কয়েকটি গবেষণার ফল না জানিয়ে পারছি না। আধুনিক টাইম সিরিজ ইকোনমেট্রিক অ্যানালাইসিস ও বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে কিছুদিন আগে কয়েকটি গবেষণা সম্পন্ন করেছি আমি। সেসবের পুরো ফল এখানে তুলে ধরা কঠিন। তবে ওইসব গবেষণার ফলাফলের সারবত্তা হলো, বাস্তবে অর্থ সরবরাহের হার কমাতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত হারে মূল্যস্ফীতিও নামিয়ে আনা যাবে না। ২০০৯-১০ এবং ২০১০-১১ অর্থবছরে এ ক্ষেত্রে আমরা সরকারকে অসংযতই দেখেছি। এটির ফলও সবাই প্রত্যক্ষ করেছেন সামষ্টিক অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারে অস্থিতিশীলতার স্বরূপে। ওই দুই অর্থবছরে অর্থসরবরাহ (বছরপ্রতি গড়ে ২২ শতাংশ) ও অভ্যন্তরীণ ঋণের (গড়ে ২৮-২৯ শতাংশ) অতিরিক্ত প্রবৃদ্ধির কারণে অস্থিতিশীলতা দেখা গেছে। তাই অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনতে হলে অর্থ সরবরাহের হার বেশ কিছুটা কমাতে হবে। এর প্রয়োজনীয়তা সূর্য পূর্বদিকে উদিত হওয়ার মতই সত্যি।
নতুন মুদ্রানীতির কয়েকটি দিক নিয়ে আমি আশাবাদী। গত কয়েক বছরের মধ্যে এবারই বাংলাদেশ ব্যাংক সামষ্টিক অর্থনীতির সমস্যাগুলো এড়িয়ে না গিয়ে প্রকৃতপক্ষে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে সেগুলোকে। অর্থাত্ তারা তিন বছর পর বুঝতে পেরেছে সমস্যা কোথায়। এটি ইতিবাচক। বড় কথা হলো, উপলব্ধিটি প্রতিফলিত হয়েছে নতুন মুদ্রানীতিতে। এটিই অর্থসরবরাহ ও অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবৃদ্ধি সংযতকরণে উদ্যোগী করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। যেসব লক্ষ্যমাত্রা তারা নির্ধারণ করেছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন করা গেলে সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল পর্যায়ে রাখা সম্ভব। ‘স্থিতিশীল পর্যায়ে’ বলছি এ ভিত্তিতে যে, সাধারণত এ ধরনের পদক্ষেপ সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিবেশে স্থিরতা আনে। নতুন মুদ্রানীতির যথাযথ বাস্তবায়ন নির্ভর করছে অর্থনীতির দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের ওপর— সরকারের রাজস্ব বিভাগ ও স্থানীয় ব্যবসায়ী সম্প্রদায়।
মুদ্রানীতির সুষ্ঠু বাস্তবায়নে, বিশেষ করে রাজস্ব বিভাগের ভূমিকা কৌশলগত ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। স্বীকার করতেই হবে, বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতায় ঘাটতি রয়েছে, সেখানে রাজস্বনীতি ও মুদ্রানীতির সমন্বয় সাধন চাট্টিখানি কথা নয়। কঠিন হলেও বিরাজমান পরিস্থিতিতে সমন্বয়টি করতে হবে অর্থমন্ত্রীকে, যিনি মুদ্রানীতি প্রণয়নসংক্রান্ত বোর্ডের প্রধান। এখন মূল্যস্ফীতি কমাতে উপযুক্ত মুদ্রা বিস্তার (মানিটারি এক্সপানশন) হার নির্ধারণ করতে হবে। কী হারে বেসরকারি ও সরকারি (ব্যাংক থেকে রাজস্ব ঘাটতি অর্থায়নে নেয়া অর্থ) খাতে সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবৃদ্ধি বণ্টন করা হবে, তা নীতিগত পছন্দের বিষয়। জটিলতা হলো, মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। সুতরাং এ ক্ষেত্রে যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হবে তার মূল্যায়ন হতে হবে যথাযথ এবং গৃহীত কর্মসূচির বাস্তবায়ন ঘটতে হবে সমন্বিতভাবে।
দুর্ভাগ্যজনক হলো, এখনো এ ধরনের সুসমন্বিত পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না অথচ অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি কমিয়ে আনতে সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতে দূরদর্শী অর্থসরবরাহ বিস্তার হওয়া দরকার। এ ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ ঋণের ব্যবহার হওয়া চাই আরও সাশ্রয়ী ও ফলপ্রদ। গত কয়েক মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে সরকার যে হারে ঋণ নিয়েছে, তাতে মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন করা কঠিন। স্বভাবতই রাজস্ব খাতে ঋণ বেশি চলে যাওয়ার অর্থ হলো বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়া। এ অবস্থায় সমস্যাটি যে সংকটের দিকে যেতে পারে, তা ঋণে সুদের হারের ঊর্ধ্বগামিতায় প্রতিফলিত হচ্ছে। আমি বলছি না যে, মুদ্রা বিস্তারের যথাযথ হার ধরে রাখার চেষ্টা নেয়া হলে সুদের হার বাড়ে না। তা অবশ্যই বাড়ে; এটি এড়ানোর উপায় নেই। এও মানতে হবে, রাজস্ব খাতে সঞ্চালিত ঋণ নিয়ন্ত্রণে আনা গেলে সুদের হারও আয়ত্তে রাখা যায়। আর এভাবে মূল্যস্ফীতি কমাতে শক্তিশালী রাজস্ব ব্যবস্থাপনার সঙ্গে মুদ্রানীতির সমন্বয় অত্যাবশ্যক।
রাজস্ব ব্যবস্থাপনার পর মুদ্রানীতি বাস্তবায়নে স্থানীয় ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের বড় ভূমিকা রয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকসহ ব্যবসায় খাতের অনেক খেলোয়াড় ২০০৮ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে জমি এবং শেয়ারবাজারের উচ্চমূল্য থেকে ব্যাপক মুনাফা অর্জন করে। অংশত এতে সহায়তা জোগায় অর্থনীতিতে অতিরিক্ত তারল্যের আধিক্য, যেটি সৃষ্টি হয়েছিল অর্থব্যবস্থাপনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছুটা নমনীয় অবস্থান থেকে। অর্থের অব্যবস্থাপনা নিয়ে তখন ব্যবসায়ী সম্প্রদায় থেকে কোনো অভিযোগ তোলা হয়নি। বরং এ সুযোগে গৃহায়ন খাত ও শেয়ারবাজারে বাবল তৈরি করে তারা স্বল্প মেয়াদি মুনাফা উপভোগ করছিলেন। তারা বুঝতে পারেননি এ অতিরিক্ত তারল্য একসময় উপচে পড়তে পারে ও তাতে অনিয়ন্ত্রিত মূল্যস্ফীতির মতো ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে। দেশের বিদ্যমান অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রা বিনিময় হারে অস্থিতিশীলতাকে উদ্দীপ্ত করে তুলেছে ওই অতিরিক্ত তারল্য। অথচ ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ক্ষোভ প্রকাশ শুধু নয়, উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিষয়ে এখন বারবার অভিযোগ জানাচ্ছে। তাদের মূল অভিযোগ, বৈদেশিক মুদ্রার উচ্চ হার ও সুদের হারের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর রাজনৈতিকভাবে চাপ দিচ্ছেন তারা, যাতে অভ্যন্তরীণ তারল্য প্রবাহের গতি সহজ করা হয় ও সুদের হার পড়ে আসে এতে। এ অবস্থায় সুখবর হলো, বাংলাদেশ ব্যাংক দেরিতে হলেও অতীতের এসব ভুল সংশোধনে আগ্রহ দেখিয়েছে। এ জন্যই তারা এমন মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন করতে চাইছে, যাতে সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আবার ফিরে আসে।
বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার চড়া দাম ও সুদের হারের ঊর্ধ্বগতিতে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের ভূমিকা স্মরণে রেখেও বলা যায়, তাদের উদ্বেগ সঙ্গত ও সমর্থনযোগ্য। তবে তাদের উপলব্ধি হওয়া প্রয়োজন, কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো? এ সমস্যার বীজ একসময় অভ্যন্তরীণ তারল্য সম্প্রসারণে তাদের অব্যাহত চাহিদার মধ্যেই নিহিত। তারাই তো ঋণের অর্থ শেয়ারবাজার ও জমিতে বিনিয়োগ করেছে; মুদ্রানীতির অব্যবস্থাপনার সুযোগে ও কিছু ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে প্রভাবিত করে। তারা বুঝতে পারেনি যে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও টাকার বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রার উঠতি দাম পরস্পর সম্পর্কিত ও তা সৃষ্টিই হয়েছে অতিরিক্ত অভ্যন্তরীণ তারল্য প্রবাহের কারণে। এখন তারা নিয়ন্ত্রিত মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রা বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা দেখতে চাইছেন! এ ক্ষেত্রে অবশ্যই অভ্যন্তরীণ তারল্য প্রবাহ সহজ করার বিষয়ে সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংককে কোনো চাপ দেয়া যাবে না। এর বদলে তাদের উচিত, সরকারকে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা আরও কঠোর করার পরামর্শ দেয়া ও এ ক্ষেত্রে সহযোগিতা জোগানো। এ ক্ষেত্রে সুষ্ঠুভাবে কর দেয়া ও জ্বালানি খাতের অসহ্য ভর্তুকি কমাতে সরকারের নেয়া বিভিন্ন কর্মসূচিতেও তাদের এগিয়ে আসা উচিত।
আমি আগেও বহুবার লিখেছি, সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারে চাই সমন্বিত মুদ্রা ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা। এতে থাকবে ১৫-১৬ শতাংশ পরিব্যাপ্তির বার্ষিক মুদ্রা সম্প্রসারণ নীতি। রাখতে হবে উপযুক্ত রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, যাতে রাজস্ব ঘাটতিকে জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যে ধরে রাখা যায়। অভ্যন্তরীণ ব্যাংকঋণকে কোনোমতেই জিডিপির ৩ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে দেয়া যাবে না। পদক্ষেপ নিয়ে এসবের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন করা গেলে আশা করা যায়, সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। এ ছাড়া জিডিপির ২ শতাংশের মতো বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে অবশ্যই বিদেশী সহায়তা প্রয়োজন। রাজনৈতিক কারণে তা সম্ভব না হলে কর আহরণ বাড়াতে হবে বা সম্ভাব্য বৈদেশিক সাহায্যের প্রাপ্যতা অনুযায়ী বাজেট ঘাটতি যথাসম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। এ অবস্থায় ব্যয়সংকোচনে সমন্বয়মূলক পদক্ষেপ নিতে হবে, প্রধানত চলতি বাজেটে ভর্তুকির অংশে। খেয়াল রাখতে হবে, যেন সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনতে গিয়ে ব্যয়সংকোচনের সব বোঝা উন্নয়ন ব্যয়ে চড়ে না বসে। কারণ সে ক্ষেত্রে কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে সেটি ধরে রাখা সম্ভব হবে না।
লেখক: অর্থনীতিবিদ, ভাইস প্রেসিডেন্ট, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট
sahmed1952@live.com