পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতায় এসইসি ঘোষিত প্যাকেজের কার্যকারিতা কতটুকু

পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) তিন ধরনের স্কিম ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি স্কিমগুলো শেয়ারবাজারের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারমূলক পদক্ষেপ। এ ধরনের পদক্ষেপের কার্যকারিতা নিয়ে দ্বিমতের কোনো কারণ নেই। মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদের এ স্কিমগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে শেয়ারবাজারের ভবিষ্যত্ ভালো হবে। শেয়ারবাজার ধসের পর গঠিত তদন্ত কমিটি এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিও (বিএপিএলসি) এ ধরনের কিছু স্কিম গ্রহণের ব্যাপারে আগেই সুপারিশ করেছিল। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শেয়ারবাজার নিয়ে আস্থার যে সংকট তৈরি হয়েছিল এ ধরনের সংস্কারমূলক পদক্ষেপের কারণে তা কিছুটা হলেও প্রশমিত হবে। ফলে বাজারে এর প্রভাব ইতিবাচক। স্বল্প সময়ের মধ্যে এসব সংস্কার কার্যক্রমের প্রভাব বা কার্যকারিতা পাওয়া যাবে না। প্যাকেজে ঘোষিত স্বল্পমেয়াদি যে পদক্ষেপগুলো নেওয়ার কথা বলা হয়েছে সেগুলো বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকটা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। বাজারের ধস ঠেকাতে এ ধরনের কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি ছিল।

ঘোষিত স্বল্পমেয়াদি প্যাকেজে শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা হিসাবের ক্ষেত্রে বিদ্যমান পদ্ধতি শিথিল করা হয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকের মোট বিনিয়োগ হিসাবের ক্ষেত্রে নিজস্ব পোর্টফোলিওতে কেনা শেয়ার ছাড়াও সাবসিডিয়ারি কোম্পানিকে দেওয়া মূলধন বিনিয়োগ ও প্রদেয় ঋণ এবং অন্যান্য কোম্পানিতে দীর্ঘমেয়াদি ইকুইটি বিনিয়োগকে হিসাবে ধরা হয়। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সাবসিডিয়ারি কোম্পানিকে দেওয়া মূলধনকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ হিসাবে ধরা হবে না। পাশাপাশি কোনো কোম্পানির শেয়ারে বাণিজ্যিক ব্যাংকের দীর্ঘমেয়াদি ইকুইটি বিনিয়োগকেও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বলে গণ্য করা হবে না। তাছাড়া শেয়ার ব্যবসায় নিয়োজিত কোনো ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাবসিডিয়ারি কোম্পানিকে দেওয়া ঋণের পরিমাণ ব্যাংকের একক গ্রাহক ঋণসীমা (সিঙ্গেল বরোয়ার এক্সপোজার লিমিট) অতিক্রম করে থাকলে অতিরিক্ত ঋণ সমন্বয়ের সময়সীমা ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এর আগে ২০১২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এ ঋণ সমন্বয় করতে বলা হয়েছিল। এ পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়েছে ব্যাংকগুলো যেন লোন-লস প্রভিশনিংয়ের মধ্যে পড়ে না যায়। তাছাড়া এসব পদক্ষেপের কারণে ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের শেয়ার জোর করে বিক্রি করবে না। ফলে অতিরিক্ত বিক্রির চাপ আংশিক ও সাময়িকভাবে কিছুটা কমবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, এ ধরনের পরিবর্তন যেন আমাদের ব্যাংকিং খাতকে পরবর্তী সময়ে বড় রকমের ঝুঁকি ও ক্ষতির সম্মুখীন না করে। সামগ্রিকভাবে ব্যাংকগুলোর পুঁজি বৃদ্ধির যে লক্ষ্য বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়েছিল ব্যাসেল-৩ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে তা থেকে যেন আমরা কোনো ক্রমেই সরে না আসি।

স্বল্পমেয়াদি স্কিমের আওতায় পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সব কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সব সময়ের জন্য সম্মিলিতভাবে নিজ কোম্পানির কমপক্ষে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। একইসঙ্গে প্রত্যেক পরিচালকের মালিকানায় ব্যক্তিগতভাবে কোম্পানির কমপক্ষে ২ শতাংশ শেয়ার থাকার নিয়ম করা হয়েছে। এ ধরনের পদক্ষেপের ফলে বাই ব্যাকের মাধ্যমে বর্তমান বাজারদরে প্রায় ৫ হাজার ২শ’ কোটি টাকার শেয়ারের চাহিদা তৈরি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অনেক উদ্যোক্তাই তাদের নিকটাত্মীয়দের নামে শেয়ার কিনে থাকেন। এক্ষেত্রে কেউ কেউ এসব শেয়ার নিজের নামে ট্রান্সফার করে নিলে এ চাহিদা হয়তো কমে ২ থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকায় নেমে আসতে পারে। তথাপি, এ পদক্ষেপটিও শেয়ারবাজারে চাহিদা বাড়াতে সহায়ক হবে যা বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে কিছুটা সহায়ক হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে দীর্ঘমেয়াদে এ ধরনের স্কিম বাজারে শেয়ারের ফ্রি ফ্লোটিংয়ের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাস্বরূপ। স্বল্পমেয়াদি সব স্কিমই বাজারে ফের ধস ঠেকাতে সাময়িকভাবে গ্রহণযোগ্য হলেও দীর্ঘমেয়াদে বাজারে স্থিতিশীলতার জন্য গ্রহণযোগ্য নয়।

শেয়ারবাজারে বিদেশি ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিনিয়োগ বাড়াতে ঘোষিত প্যাকেজে বিনিয়োগের ওপর অর্জিত মুনাফার ১০ শতাংশ কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে। এটা কতটা ফলদায়ক তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। অন্যান্য দেশের তুলনায় ১০ শতাংশ কর কর্তনের বিষয়টি তুলনামূলকভাবে অনেক কম। সুতরাং এটি বিলোপ করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তাছাড়া বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগনির্ভর করবে বাংলাদেশের সামগ্রিক স্থিতিশীলতা, প্রবৃদ্ধি এবং শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতার ওপর। এক্ষেত্রে ১০ শতাংশ কর কর্তন বিলুপ্তির বিষয়টি খুব একটা কাজে আসবে বলে মনে হয় না। এই কর শুধু সাময়িকভাবে (১ বা ২ বছরের জন্য) রহিত করা উচিত ছিল, পুরোপুরি বিলুপ্তি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

এসইসির ঘোষিত মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি স্কিমগুলোর মধ্যে বেশ কিছু ভালো দিক রয়েছে। গুজবনির্ভর শেয়ারবাজারের পরিবর্তে পূর্ণ সচেতনতামূলক মূলধনী বাজার তৈরির লক্ষ্যে বিনিয়োগ উপদেষ্টা কার্যক্রম (ইনভেস্টমেন্ট অ্যাডভাইজরি সার্ভিস)  উন্মুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পেশাদারিত্ব আনতে বিনিয়োগকারী, গবেষক ও নীতিনির্ধারকদের জন্য তথ্যপ্রাপ্তির সুযোগ (এক্সেস টু ইনফরমেশন) নিশ্চিত করার জন্য গবেষণামূলক প্রকাশনা (ইকুইটি রিসোর্স পাবলিকেশন) উন্মুক্ত করা হবে। এর ফলে বাজারে গবেষণালব্ধ বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। যা বাজারের জন্য অবশ্যই ইতিবাচক।

দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপের আওতায় বলা হয়েছে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির অ্যাকাউন্টিং এবং অডিট ডিসক্লোজারের গুণগত মান উন্নত করার লক্ষ্যে ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট (এফআরএ) প্রণয়ন করা হবে। ইনসাইডার ট্রেডিং আইন শক্তিশালী করা হবে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণে উন্নত দেশের মতো আইন করা হবে। স্টক এক্সচেঞ্জের ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন উদ্যোগ দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে। মিউচুয়াল ফান্ড খাতকে আরও শক্তিশালী করা হবে। সার্ভিলেন্স সিস্টেমকে আরও জোরদার করা হবে। যত দ্রুত সম্ভব এ স্কিমগুলো বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। কারণ এ ধরনের পদক্ষেপ দক্ষতার সঙ্গে নিশ্চিত করতে পারলে শেয়ারবাজারে দীর্ঘস্থায়ী স্থিতিশীলতায় সহায়ক হবে।

এসইসি বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিপূরণের যে ঘোষণা দিয়েছে তা অনেকটাই দুর্বোধ্য। এ ধরনের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হলে পরবর্তী সময়ে বিনিয়োগকারীরা অতিরিক্ত ঝুঁকি নিতেও কুণ্ঠা বোধ করবেন না। ফলে বাজার আবারও অস্থিতিশীলতার মধ্যে পড়তে পারে। তাই মানবিক দিক থেকে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি গ্রহণযোগ্য হলেও বিনিয়োগ ও বাজারের স্থিতিশীলতার দৃষ্টিকোণ থেকে এটি মোটেও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সরকার যদি বিশেষ কমিটির দীর্ঘসূত্রতার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণের এ স্কিমকে বিনিয়োগকারীদের মন থেকে ভুলিয়ে দিতে পারে, তা আমাদের অর্থনীতি ও বাজারের জন্য খারাপ হবে বলে মনে হয় না।

বাংলাদেশে কোনো ধরনের প্যাকেজের কথা বলা হলে বাজার এমনিতেই বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠে সেটা সঙ্গত বা অসঙ্গত কারণেই হোক। তদুপরি বর্তমান প্যাকেজটিতে যেহেতু প্রধানমন্¿ীর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, তাই ৪-৫ সেশনেই সূচক প্রায় ২০ শতাংশের মতো বৃদ্ধি পেয়েছিল। শেয়ারবাজার ও অর্থনীতির পটভূমিতে এ ধরনের উল্লম্ফন অতিরিক্ত এবং ধরে রাখা সম্ভব নয়। ফলে এরই মধ্যে বাজারে সূচকের ৫ শতাংশ কমেছে যা বাজারের Technical Connection হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। বাজারে ঊর্ধ্বমুখিতা ও নিম্নমুখিতা থাকবে। এটাই নিয়ম। অবশ্যই তা অতিরিক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। সামগ্রিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রেক্ষাপটে শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা অর্জন করা নিকট-ভবিষ্যতে কতটা সম্ভব হবে সেটি নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। উন্নত বিশ্বের শেয়ারবাজারের বর্তমান দৃশ্যের দিকে তাকালেই তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। তার ওপর বছর শেষে বিক্রয়ের চাপ কিছুটা হলেও বাড়বে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাজার বর্তমান স্থানে থাকবে কি না সেটিও প্রশ্নবিদ্ধ। এসইসি ও সরকারের উচিত হবে শেয়ারবাজারের মূল্যসূচক থেকে চোখ সরিয়ে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার কার্যক্রমগুলোকে সঠিকভাবে বাস্তবায়নের দিকে নজর দেওয়া। এসইসির মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি স্কিমগুলোর মাধ্যমেই অবশেষে বাজারের স্থায়ী স্থিতিশীলতা আনা সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)

 

Dr. Ahsan H. Mansur

Dr. Ahsan H. Mansur

Dr. Mansur started his career as a Lecturer, Department of Economics, Dhaka University in 1976. He left for Canada for higher studies in economics in the same year. As a graduate student and research assistant, he was also offering regular economics courses at the undergraduate level at the University of ...

gog