বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে কয়েকটি সূচক বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বর্তমান প্রবৃদ্ধি অর্থনীতিকে একটা উন্নয়নের দিকে ধাবিত করছে। ৭ শতাংশের কাছাকাছি প্রবৃদ্ধি আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য অবশ্যই ইতিবাচক। রপ্তানি প্রবৃদ্ধি গত বছর ৪০ শতাংশের ওপরে ছিল। এবারও ৩৫ শতাংশের ওপরে রয়েছে। শিল্প উত্পাদন বাড়ছে। বিনিয়োগ বাড়ছে। কৃষি উত্পাদনও বেশ ভালো। নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের কারণে কৃষিতে একটা বড় ধরনের উন্নতি দেখা যাচ্ছে। এ বিষয়গুলো আমাদের অর্থনীতিতে আশা তৈরি করছে।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনীতিতে বেশ কিছু ঝুঁকি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে প্রধানতম ঝুঁকি হলো মূল্যস্ফীতি। প্রায় ২ বছর ধরে প্রায় ১১ শতাংশ মূল্যস্ফীতি বিদ্যমান রয়েছে। এটি আমাদের মতো দেশের জন্য খুবই তিকর।
আমাদের দেশের অনেক মানুষ দরিদ্র। বেশিরভাগ মানুষের আয় সীমিত। ফলে মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকলে এসব সীমিত আয়ের মানুষদের ভোগের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হয়। দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে একই পরিমাণ টাকা খরচ করে আগের তুলনায় কম দ্রব্য পাওয়া যায়। ফলে সীমিত আয় দিয়ে কম পণ্য কিনতে হয়। দেশে মূল্যস্ফীতির একটা বড় কারণ হলো আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধি। তাছাড়া দেশের অভ্যন্তরেও চাহিদা বাড়ছে। ফলে বাড়ছে দাম। এদিকে প্রাইভেট সেক্টরের ঋণ চাহিদা ও সরকারের বাজেট ঘাটতি পূরণ করতে গিয়ে মুদ্রার সরবরাহ অতিরিক্ত হারে বাড়ছে যা পণ্যমূল্যকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বর্তমানে অর্থনীতিতে আরেকটি বড় ঝুঁকি হলো যাতায়াত ব্যবস্থা। যাতায়াত ব্যবস্থার কাঠামো এমন যে আমাদের মূলত সড়ক ব্যবস্থার ওপরই নির্ভর করতে হয়। যদিও নৌ পথে কিছুটা পণ্য পরিবহন হয়ে থাকে। রেল ব্যবস্থাও তেমন একটা উন্নত নয়। সড়ক ব্যবস্থাই আমাদের দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। অথচ দেশের সড়ক ব্যবস্থা মোটেও শিল্পবান্ধব নয়। একদিকে তীব্র যানজট, অন্যদিকে রাস্তাঘাটের বেহাল দশার কারণে অতিরিক্ত পরিবহন খরচ। সঙ্গে রয়েছে সময়ের দীর্ঘসূত্র। সব মিলিয়ে যাতায়াত ব্যবস্থা আমাদের শিল্পকে পরিপূর্ণভাবে সহায়তা করতে পারছে না। এদিকে যাতায়াত ব্যবস্থার অনুন্নয়নের কারণে জীবনযাত্রার মানের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সম্প্রতি সরকার যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন কল্পে বেশ কিছু পদপে নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে ৪ লেনে উন্নীত এবং দেশের সর্বত্র রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করা।
বাংলাদেশের তৃতীয় আরেকটি বড় ঝুঁকি হলো— অবকাঠামো। গত দুই বছরে দেশের জাতীয় গ্রিডে ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ যোগ হয়েছে। তবুও বিদ্যুতের তেমন কোনো উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। লোডশেডিংয়ে পড়তে হচ্ছে অহরহ। বিদ্যুতের অভাবে শিল্পে বেশ নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে নতুন বিদ্যুত্ সংযোগ না দেওয়ায় নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান বিপাকে পড়ছে। বিদ্যুত্ সমস্যার পরই রয়েছে গ্যাস সংকট। তাছাড়া ইদানীং সুপেয় পানির অভাবও পরিলতি হচ্ছে। যে হারে পানির চাহিদা বাড়ছে সে হারে পানির জোগান বাড়ছে না।
আমাদের অর্থনীতিতে এ ঝুঁকিগুলো ছাড়াও আরও কিছু ঝুঁকি রয়েছে যেমন কর্মসংস্থানের অভাব এবং দরিদ্রতা। এ অবস্থায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি যদি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে কিংবা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দেয় তবে অর্থনীতিতে এর তীব্র প্রভাব পড়বে। এমনকি অর্থনীতির চাকা গতিহীন হয়েও পড়তে পারে। তাই অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা জরুরি হয়ে পড়েছে।
পাকিস্তান, ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া, নেপাল ও আফি”কার বিভিন্ন দেশ এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, একটি দেশের অর্থনীতিতে টেকসই প্রবৃদ্ধি আনতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীল পরিবেশের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বাংলাদেশে ওইসব দেশের মতো অস্থিতিশীলতা দেখা যায় না। তাহলেও আমাদের গণতান্¿িক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে যাতে সেখানে সব ধরনের মতামত প্রতিফলিত হয়।
দেশের বড় বড় অর্থনৈতিক সমস্যা বা ঝুঁকি নিয়ে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনা হওয়া প্রয়োজন। এতে করে একটি সমস্যার বিভিন্ন দিক উঠে আসবে। সরকারও বিরোধী দলসহ সংশ্লিষ্টদের সমালোচনাগুলোকে বিবেচনা করে একটি ভালো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবে। রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং বিশেষজ্ঞ সবারই ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে। সরকার এ মতামতগুলো বিবেচনায় নিয়ে একটি সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
অর্থনৈতিক প্রতিটি নীতিরই কিছু ইতিবাচক এবং কিছু নেতিবাচক দিক থাকে। সরকার কোনটিকে গুরুত্ব দেবে তার ওপর নির্ভর করে নীতিটি নেওয়া হবে কি, হবে না। উদাহরণস্বরূপ, সরকার যদি জ্বালানি তেলের ওপর ভর্তুকি দেয় তবে সরকারকে ঋণ করতে হবে যা অর্থনীতিতে মুদ্রা সরবরাহ বাড়িয়ে দেবে যার কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যেতে পারে। আবার যদি ভর্তুকি না দেয় তবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়বে। এখন আলোচনা এবং সমালোচনার ভিত্তিতে যদি সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তবে সংশ্লিষ্ট সবাই সরকারের একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণ সম্পর্কে জানতে পারবে। ফলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা কম হতে পারে। তখন সংশ্লিষ্ট সবাই জানতে পারবে কেন জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলো।
সব সময়ই হরতাল বা এ ধরনের কর্মসূচি অর্থনীতিকে বাধার মধ্যে ফেলে দেয়। তাই আমাদের মতো দেশে হরতাল বা এ ধরনের কর্মসূচি এড়িয়ে গিয়ে সংসদে গিয়ে প্রতিবাদ করাই অর্থনীতির জন্য বেশি মঙ্গলজনক। সেক্ষেত্রে অবশ্যই সরকারকেও যত্নবান হতে হবে। বিরোধী দলকে প্রতিবাদ করার সুযোগ দিতে হবে। আমেরিকায় হোয়াইট হাউসের সামনেও প্রতিবাদ করার সুযোগ পায় প্রতিবাদকারীরা। তাছাড়া প্রতিবাদ কিংবা সমালোচনার সুযোগ না থাকলে সরকারও তার দোষত্র”টি বা সরকারের নেওয়া বিভিন্ন নীতির নেতিবাচক দিক সম্পর্কে জানতে পারবে না।
সামাজিক বা অর্থনৈতিক যেকোনো বড় বড় সমস্যার সঠিক সমাধানের জন্য বেশি বেশি আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে শুধু রাজনৈতিক নেতাদের মতামত নয়, বিশেষজ্ঞ এবং সংশ্লিষ্ট সবারই মতামত নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। সর্বোপরি বিভিন্ন ঝুঁকি সামাল দিয়ে অর্থনীতির বর্তমান ইতিবাচক সূচকগুলোতে গতি ফিরিয়ে আনতে তথা টেকসই এবং দরিদ্রবান্ধব প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অংশগ্রহণমূলক গণতন্¿ের প্রয়োজন রয়েছে।
লেখক : ভাইস চেয়ারম্যান, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট