যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবকাঠামো খাতে ব্যাপক উন্নয়ন দরকার। এ খাতের উন্নয়ন ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন আসবে না। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক কর্মকা পরিচালনার ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হলো অবকাঠামোগত অনুন্নয়ন। বর্তমানে অবকাঠামোর মধ্যে বিদ্যুত্ এবং সড়ক ব্যবস্থাতে সবচেয়ে বেশি দুর্বলতা ফুটে উঠেছে। শুধু টেলিযোগাযোগ, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা খাতে কিছুটা উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ তিনটি খাতে বেসরকারি খাত এগিয়ে না এলে এসব খাতের অবস্থাও হয়তো দুর্বলই থেকে যেত। সড়ক ব্যবস্থা এবং বিদ্যুত্ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ আসছে না সরকারের অদক্ষ ও অদূরদর্শী নীতিমালা ও কার্যক্রমের জন্য। এ খাতগুলো এসব কারণে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সরকার এ খাতগুলোর উন্নয়নে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তাতেও আশানুরূপ অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। কয়েক বছর ধরেই সরকার এ খাতে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্রয়োগ করার চেষ্টা করছে। বিদ্যুত্ খাতে সীমিত প্রয়োগ ছাড়া পিপিপির বাস্তবায়ন এখনও সম্ভব হয়নি।
অবকাঠামো খাতে যদি বড় ধরনের উন্নতি করতে হয় এ খাতে বেসরকারি খাতকে আসার সুযোগ করে দিতে হবে। অবকাঠামো খাতে আমাদের সমস্যা অনেক বেশি। বিশেষ করে বিদ্যুত্ এবং রাস্তাঘাটের উন্নয়নে। এ দুটি খাতে সে হারে বিনিয়োগ করার মতো আমাদের সরকারি রাজস্ব নেই। শুধু সরকারের পক্ষে এত বেশি বিনিয়োগ চাহিদা অল্প সময়ের মধ্যে মেটানো অনেকটাই অসম্ভব ব্যাপার। জনগণের বর্ধিত চাহিদা মেটাতে হলে এখাতে দেশীয় বেসরকারি খাতকে বিনিয়োগে আগ্রহী করে তুলতে হবে। পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগও আনতে হবে। এ খাতে দেশি-বিদেশি বেসরকারি খাতকে বিনিয়োগে আগ্রহী করার জন্য যে ধরনের নীতিমালা ও সাংগঠনিক কাঠামো দরকার তা সরকারকে তৈরি করে দিতে হবে। অন্যথায় তারা এ খাতে বিনিয়োগ করতে চাইবে না।
সামপ্রতিক সময়ে বিদ্যুত্ খাতে বেসরকারি খাতকে কিছুটা কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তাদের কার্যক্রমের সীমা খুবই সীমিত। তারা শুধু উত্পাদনই করতে পারে, সরাসরি ব্যক্তি খাতে বিক্রি করা বা সঞ্চালন করার অনুমতি পায় না। এ ধরনের সুযোগ দেওয়ার কোনো পরিকল্পনাও আপাতত নেই। দেশের বিদ্যুত খাতের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন ছিল বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) বিদ্যুত্ খাতে একটি বড় প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করতে যাতে বাজারে কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান একচেটিয়া বাজার সৃষ্টি করতে না পারে। পিডিবির পাশাপাশি যেকোনো প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানকে বিদ্যুত্ উত্পাদন এবং বাজার চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তা বিক্রি করারও সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। তাদের বিদ্যুত্ বিক্রি করার সুযোগ দিলে প্রতিষ্ঠানগুলো দক্ষতার সঙ্গে অনেক প্রতিষ্ঠান বা এলাকাকে বিদ্যুতের আওতায় নিয়ে আসতে পারবে। তারা বিদ্যুতের দাম খরচের সঙ্গে সামঞ্জস্য এনে নির্ধারণ করে তারপরও দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো কিনতে রাজি হবে। কারণ জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুত্ উত্পাদন করতে গেলে প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেক বেশি দাম পড়ে যায়। বিদ্যুত্ খাতে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি, ব্যক্তি খাতে ভারত থেকেও আমদানি করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। সরকারি পর্যায়ে ভারত থেকে বিদ্যুত্ আমদানির কথা চলছে। ভারতের বেসরকারি খাত থেকে বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে বিদ্যুত্ আমদানির কথা চিন্তা করা যেতে পারে। এতে করে দ্রুত বিদ্যুত্ পাওয়া সম্ভব হবে।
সর্বোপরি সরকার বিদ্যুত্ খাতকে বাজার ব্যবস্থার ওপর ছেড়ে না দেয় তাহলে ক্রমবর্ধমান চাহিদার এ খাতে সরকারের একার পক্ষে উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। উপরন্তু এ খাতে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। এ খাতকে যদি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া যায় তাহলে সরকার এ খাতে বর্তমানে ও ভবিষ্যেত বিশাল পরিমাণে যে ভর্তুকি দিচ্ছে বা দিতে যাচ্ছে তা থেকে মুক্তি পাবে। এ ধরনের বিশাল ভর্তুকি দিয়ে এ খাতকে পরিচালনা করা এক সময় অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে। কোনো দেশের সরকারই এ খাতে এত বেশি ভর্তুকি দিয়ে চালাতে পারেনি, বাংলাদেশও পারবে না। সরকারের উচিত বিদ্যুত্ খাতকে ক্রমান্নয়ে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিয়ে শুধু রেগুলেট করার দায়িত্ব হাতে রাখা। তাহলে দেশের জনগণ অনেক বেশি বিদ্যুতের সুবিধা ভোগ করতে পারবে। পাশাপাশি দক্ষতাও নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়নে নতুন উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের প্রধান সড়কগুলো ভেঙে যান চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। এ খাতে সরকারের তদারকি আরও বাড়াতে হবে। বাড়াতে হবে দক্ষতা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হাইওয়ে নির্মাণ এবং ব্যবস্থাপনা বেসরকারি খাতে দিয়ে দেওয়ার বিষয়টিও সুপরিচিত। বাংলাদেশের বড় হাইওয়েগুলোর উন্নয়ন ও নির্মাণ পিপিপি প্রক্রিয়ায় বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রাইভেট কোম্পানি হাইওয়ে নির্মাণের পাশাপাশি তার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করবে। এতে দেশের হাইওয়ের মান উন্নত হবে। সেক্ষেত্রে হাইওয়ে ব্যবহারের জন্য প্রাইভেট কোম্পানি টোল আদায় করবে। এতে করে একদিকে সড়ক ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা ও দুর্নীতি দূর হবে, পাশাপাশি মানুষও সঠিক সেবা পাবে। দেশের শিল্প খাতের ওপর যোগাযোগ ব্যবস্থার বড় ধরনের প্রভাব রয়েছে। সে কারণে সড়ক ব্যবস্থা যদি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয় তা শিল্পের জন্যও উপকার হবে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির আরেকটি বড় প্রতিবন্ধকতা হলো দুর্নীতি। দুর্নীতি সর্বগ্রাসী। দুর্নীতি পুরো অর্থনীতি তথা সমাজকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। দুর্নীতির কারণে পুরো অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ে এবং অর্থনৈতিক কর্মকা ে খরচ বেড়ে যায়। যা শিল্পকে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দেয়। দুর্নীতির কারণে দেশের বিদ্যুত্ এবং সড়ক ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়েছে। ফলে অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল করতে হলে দুর্নীতি কমিয়ে আনতে হবে। ব্যক্তি খাতের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে এবং সরকারের সীমিত কার্যক্ষমতাকে পরিকল্পনা, নীতিনির্ধারণ ও পরিদর্শনে ব্যবহার করে দুর্নীতি কিছুটা হলেও কমানো যেতে পারে।
বর্তমানে দেশের আর্থিক খাত অনেকটাই ব্যাংকনির্ভর। শেয়ারবাজার প্রায় স্থবিরই বলা চলে। সুতরাং এ মুহূর্তে শেয়ারবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ করার চিন্তা খুব একটা করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বন্ড মার্কেটকে কার্যকরী করতে সরকারের উদ্যোগ গ্রহণ করা অতি প্রয়োজন। বর্তমানে দেশের আর্থিক খাতে যে টানাপড়েন চলছে এর মূলে রয়েছে সরকারের অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ এবং গত বছর বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত ঋণ প্রদান। গত বছর ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ২৮ শতাংশ। এটা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি। ব্যাংকগুলো গত বছরে ব্যক্তি খাতে এত বেশি ঋণ দিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি সরকারের অতিরিক্ত ঋণের চাহিদা মেটাতে গিয়ে এখন অর্থ ব্যবস্থাপনায় কিছুটা সংকটে পড়েছে। ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে। অন্যথায় সরকারের অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণের ফলে ব্যাংকগুলোতে তহবিল কমে আসবে। ফলে বেসরকারি খাত ঋণ পাবে না। যার প্রভাব পড়বে শিল্প, ব্যবসা, আবাসন ও যোগাযোগ খাতে। সরকার বিদ্যুত্, জ্বালানি এবং কৃষি খাতে যে পরিমাণ ভর্তুকি দিচ্ছে তা কমিয়ে আনতে না পারলে সরকারের ঋণ গ্রহণ কমানো সম্ভব হবে না। এভাবে ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকলে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সরকারের ঋণ জিডিপির ৩ শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমনকি এ হার জিডিপির ৫-৬ শতাংশ পর্যন্ত উঠতে পারে। যদি এ ধরনের অবস্থা হয় তবে দেশের আর্থিক খাত ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা চরম সংকটের মধ্যে পড়ে যেতে পারে। তাই ভর্তুকি কমিয়ে সরকারের ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ গ্রহণের পরিমাণ সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা অতি প্রয়োজনীয়। বাজেট অর্থায়ন ব্যবস্থাপনায় সরকারকে আরও দক্ষ ভূমিকা পালনে সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন। তহবিলের সংকট যে ধরনেরই হোক না কেন কোনো অবস্থাতেই ঋণের সুদ হার নির্দিষ্ট করে দেওয়া ঠিক হবে না। বাজারভিত্তিক ঋণের সুদহার বহাল রাখা দরকার। অন্যথায় সুদহার কম হওয়ায় ঋণের চাহিদা বেড়ে যাবে যা আর্থিক খাতকে আরও সংকটের মুখে ফেলে দেবে।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট