সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনতে আয় বুঝে ব্যয় করতে হবে কমাতে হবে চাহিদাজনিত চাপ

এ সময়ে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

মুদ্রাস্ফীতির কারণে অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতা দূর হচ্ছে না। মূল্যস্ফীতি বেশি হলে স্বাভাবিকভাবেই আমানতের সুদ হার বেড়ে যায়। হার যদি ১০ শতাংশ হয় তবে আমানতের সুদ দিতে হবে ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ।  আমানতের সুদ হার যেহেতু ঊর্ধ্বমুখী এ কারণে ঋণের সুদ হার বেড়ে ১৮ থেকে ১৯ শতাংশ হবে এটাই স্বাভাবিক। এগুলো প্রকৃত মূল্যে বাড়বে না, বাড়বে নামমাত্র হারে।

বিনিময় হারের ক্ষেত্রেও চার-পাঁচ বছর ধরে স্থিতিশীলতা বজায় থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে তাতে কিছুটা চিড় ধরেছে। বর্তমানে ডলারের বিপরীতে টাকার মান অব্যাহতভাবে কমে যাচ্ছে। এ অস্থিতিশীলতার জন্যও দায়ী মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতির হার যদি ১১ শতাংশের মতো হয়, বিনিময় হারের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়াটা স্বাভাবিক। বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির হার যেখানে ২ থেকে ৩ শতাংশের মতো, আমাদের বর্তমান মূল্যস্ফীতি সেখানে ১০ শতাংশের ওপর। টাকার মান ৭ বা ৮ শতাংশ হারে কমবে এটাই তো স্বাভাবিক। মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়ার কারণে আমানত ও ঋণ উভয়ের ক্ষেত্রে সুদের হারও বেড়ে যাচ্ছে এবং টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। অর্থাত্ ডলারের দাম বাড়ছে। মূল্যস্ফীতির কারণে সবকিছুতেই একটা চাপ অনুভূত হচ্ছে। ডলারের দাম বাড়ছে, বাড়ছে সোনার দাম এবং সুদের হারও ঊর্ধ্বমুখী। সবকিছুই একটা অস্থিতিশীলতার দিকে ধাবিত হচ্ছে।

দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনতে হলে যেকোনো প্রকারেই হোক মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে হবে। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের যে নীতি ছিল তা হলো, প্রয়োজনে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় হারকে নির্দিষ্ট রাখা এবং ঋণের ক্ষেত্রে সুদের হারকে নির্ধারিত সীমার মধ্যে রাখা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সামগ্রিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে পরে দুটি বিষয়ের ওপর থেকে সিলিং তুলে দেয়। সামষ্টিক অর্থনীতিতে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলেও এগুলো নির্দিষ্ট রাখতে পারত না। সস্তায় ডলার দিলে আমদানির চাহিদা বেড়ে যাবে, অতিরিক্ত আমদানি করতে গিয়ে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়বে। ডলার সস্তা হওয়ায় ইতিমধ্যেই এর প্রভাবে সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে ৪৫ শতাংশ। বাংলাদেশের ইতিহাসে যা কোনোদিন হয়নি। বিনিময় হারের স্থিতাবস্থা তুলে না নিলে অবস্থা আরও খারাপের দিকে যেত তা বুঝতে পারাটা ভালোই হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে। বিনিময় হারের স্থিতাবস্থা তুলে নেওয়ায় বাজার নিজে নিজেই ভারসাম্যে পৌঁছতে সক্ষম হবে। ডলারের দাম যতই হোক বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারসাম্য অর্জিত হবে। ডলারের দাম বেড়ে গেলে আমদানি কমে আসবে। স্বাভাবিকভাবেই আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি আয়ের একটা সমতা বা সামঞ্জস্য আসবে। তাই বিনিময় হারের ওপর থেকে সিলিং তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অবশ্যই সঠিক এবং যথাযথ হয়েছে।

দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক এখনও একটি ব্যাপারে মনোযোগ দিচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয় না। সেটি হলো মুদ্রা সরবরাহ হ্রাস করা। মুদ্রা সরবরাহ কমানো গেলে মূল্যস্ফীতির উত্স যেখানে সেটি দূর হবে না। পণ্যের সরবরাহ অপরিবর্তিত রেখে মুদ্রা সরবরাহ দ্বিগুণ করে দেওয়া হলে দ্রব্যমূল্যও সময়ের সঙ্গে দ্বিগুণ হয়ে যাবে— এটা স্বাভাবিক। তখন পণ্যের সরবরাহ যদি না বাড়ে, ভোক্তারা একই পরিমাণ জিনিস দ্বিগুণ দাম দিয়ে হলেও কিনতে চাইবে। একইভাবে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যদি বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রা সরবরাহের হার কমাতে না পারে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির হার কমানো সম্ভব হবে না। বর্তমানের অস্থিতিশীল সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে হলে মুদ্রা সরবরাহের হার অবশ্যই কমিয়ে আনতে হবে।

দেশীয় মুদ্রা সরবরাহের অতিরিক্ততা এবং ডলার সস্তা হয়ে পড়ার কারণে অর্থনীতির সব চাহিদাজনিত চাপ এসে পড়ছে বিনিময় হারের ওপর। মানুষের কাছে টাকা অনেক। এর ফলে বিদেশি পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। বেড়ে যাচ্ছে আমদানির পরিমাণ। প্রভাবিত হচ্ছে বিনিময় হার। বিদেশি পণ্যের চাহিদা কমানো না গেলে আমদানির পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে। এতে করে বিনিময় হারের ওপর চাপও বাড়বে। এ ধরনের চাহিদা হতে পারে বিদেশি পণ্যের জন্য, হতে পারে জ্বালানির জন্য। এসব চাহিদা কমাতে না পারলে স্বাভাবিকভাবেই চাপ পড়বে বিনিময় হারের ওপর। গত বছরে আমাদের দেশে ডলার আসে ৩৩ বিলিয়নের মতো। আমাদের খরচ করতে হতো এর মধ্যেই। এর বেশি চাহিদা পূরণ করতে গেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের ওপর এর চাপ পড়বে। অথবা বিদেশি ঋণ নিতে হবে যা সব সময় পাওয়া যায় না। তাই আয় বুঝে ব্যয় করতে হবে। কমাতে হবে চাহিদাজনিত চাপ। চাহিদাজনিত চাপ কমাতে হলে মানিটারি পলিসি এবং ফিসকাল পলিসিতে সংকোচন আনতে হবে। এবারের বাজেট অনুযায়ী ফিসকাল পলিসিতে সংকোচনের কোনো নজির দেখা যায়নি, উপরন্তু উচ্চ ব্যয়সমৃদ্ধ ফিসকাল পলিসি নির্ধারণ করা হয়েছে। যে বাজেট পাস করা হয়েছে তাতে সামষ্টিক অর্থনীতি আরও ভঙ্গুর হয়ে পড়তে পারে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় না করা যায়, বিদেশি অর্থায়ন না আনা যায়। রাজস্ব প্রবৃদ্ধি যদি যথাযথভাবে বৃদ্ধি পায় তাহলে ব্যয় বৃদ্ধি পেলেও এতে করে সামষ্টিক চাহিদা বাড়ে না। বাজেটে রাজস্বের প্রবৃদ্ধি বেশ উচ্চ হারে ধরা হয়েছে (২০ শতাংশের বেশি), সেজন্য এবারের বাজেটের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। সরকার লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আয় করতে না পারে, মুদ্রা সরবরাহ বাড়িয়ে দিয়ে খরচ করবে এবং এর ফলে চাহিদাজনিত চাপ আরও বেড়ে যাবে, বাজারে মূল্যস্ফীতিজনিত চাপ আরও তীব্র হয়ে উঠবে। দেশীয় চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের জন্য আরও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ ক্ষেত্রে মুদ্রানীতিকে বেশি সংকুচিত করতে হবে।

সবারই অনুধাবন করতে হবে, মূল্যস্ফীতির হার বর্তমানের মতো এত বেশি থাকলে বা আরও বেড়ে গেলে সুদের হারও বেশি হবে এবং মুদ্রা বৃদ্ধির হার না কমালে সুদের হারও কমানো যাবে না। এক্ষেত্রে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কারণে সুদের হার সাময়িকভাবে আরও কিছুটা বাড়তে পারে। তাতে ভ্রূক্ষেপ করার দরকার নেই। আগে সামষ্টিক অর্থনীতিকে গুরুত্ব দিতে হবে। না হলে বিনিময় হারে অনেক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ডলারের দাম অনেক বেড়ে যাবে। মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে, যা সরকারের জন্যও কোনোভাবেই ভালো ফল বয়ে আনবে না। বিশেষ করে দরিদ্রদের জন্য বেশি খারাপ ফল বয়ে আনবে। সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনতে হলে বাড়াতে হবে দেশীয় সঞ্চয়ের পরিমাণ। এক্ষেত্রে পুঁজি ও আমানতের প্রকৃত রিটার্নের হার না বাড়লে সঞ্চয় বাড়বে না। মানুষ তখনই সঞ্চয় করতে চাইবে যখন এ থেকে মানুষ কিছুটা লাভবান হতে পারবে। মূল্যস্ফীতির তুলনায় সুদ বেশি না হয় মানুষ সঞ্চয় করে লাভবান হতে পারবে না, সঞ্চয়ও বাড়বে না।

বাংলাদেশের শেয়ারবাজার নিয়ে বলতে হয়, শেয়ারবাজারে দেশীয় সামষ্টিক অর্থনীতির প্রভাব খুব একটা দেখছি না। নিয়ম অনুযায়ী সুদের হার বেড়ে গেলে শেয়ারবাজারে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সুদের হার বাড়লে বিনিয়োগকারীরা মানি মার্কেটে অর্থ বিনিয়োগের ব্যাপারে আগ্রহী হয়। শেয়ারবাজারের টাকা মানি মার্কেটে চলে যায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তেমন কোনো প্রভাব দেখছি না। তাছাড়া কোম্পানির আর্থিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে শেয়ারের দাম বাড়ে-কমে। এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দাম বাড়ে কালো টাকা বাজারে বিনিয়োগ করতে দেওয়া হবে কি-না বা এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্তের কারণে। বর্তমানে বাজারে যে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তা বাজেটে কালো টাকা বিনিয়োগ সংক্রান্ত কিছু সিদ্ধান্তের কারণেই হচ্ছে। এ সিদ্ধান্তের সার্থকতা নিয়ে অনেকের মতো আমিও সন্দিহান। অনেকেই হয়ত এ সুযোগে বিভিন্ন গুজবের মাধ্যমে শেয়ারের দাম বাড়ানোর চেষ্টায় লিপ্ত। এভাবে বাড়তে থাকলে শেয়ারবাজারে আবারও যে একটা বিপর্যয় আসবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা ও স্থায়ী প্রবৃদ্ধি নিয়ে খুব একটা উচ্চাকাঙ্ক্ষা করা ঠিক হবে না।

Dr. Ahsan H. Mansur

Dr. Ahsan H. Mansur

Dr. Mansur started his career as a Lecturer, Department of Economics, Dhaka University in 1976. He left for Canada for higher studies in economics in the same year. As a graduate student and research assistant, he was also offering regular economics courses at the undergraduate level at the University of ...

gog