বেকারত্ব দূর করতে শিল্প খাতে শ্রমিকের অংশগ্রহণ দ্রুত বাড়াতে হবে

প্রতি বছর দেশে ৩ শতাংশ করে শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে হারে বাড়ছে না কর্মসংস্থানের সুযোগ। ফলে স্বাভাবিক নিয়মেই বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্ধমান এ বেকারত্ব দূর করতে হলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে ৩ শতাংশের বেশি হারে। যাতে করে প্রতি বছরে নতুন আসা শ্রমিকদের পাশাপাশি আগের বেকারদের কর্মসংস্থান করা যায়। তাছাড়া বেকারত্ব দূর করতে হলে ৩ শতাংশের বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে শিল্প ও সেবা খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে হবে।

দেশে পুরোপুরি বেকারের সংখ্যা খুব কম। কারণ কোনো কাজ করে না এমন মানুষের সংখ্যা বাংলাদেশে খুব একটা বেশি নেই। সে হিসাবে বিবিএসের ৫ শতাংশ বেকারত্বের হার ঠিকই আছে। আমাদের দেশের মানুষের সামর্থ্য খুব বেশি নেই। ফলে জীবন রক্ষার তাগিদে তাদের কোনো না কোনো কাজ করতে হয়। ফলে আমাদের দেশে অর্ধ বা আংশিক বেকারের সংখ্যাই বেশি। অর্ধ বেকার বলতে বোঝায় যারা কিছু সময়ের জন্য কাজ করে। ফুল টাইম কাজ পায় না, কিংবা কারও কাজের সঙ্গে অংশীদার হয়ে কাজ করছে। অথবা যোগ্যতা অনুযায়ী যারা কাজ পাচ্ছে না এমন শ্রমিকদেও বোঝায়। ফলে এ ধরনের কাজের মাধ্যমে অল্পকিছু উপার্জন করা যায়। কোনোভাবে জীবন অতিবাহিত করা যায়। তবে একে পুরোপুরি কর্মসংস্থান বলা যায় না। কারণ এ ধরনের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা সম্ভব হয় না। তাই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নে বেকারত্বের পাশাপাশি অর্ধ বেকারত্ব দূর করা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আরেকটি ব্যাপার হলো, বর্তমানে দেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ধীরে ধীরে বাড়ছে। যা বেকারত্বের হার আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণ প্রয়োজন আছে। ক্রমান্বয়ে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াটাই স্বাভাবিক। বর্তমানে আমাদের দেশের নারী সমাজের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কর্মসংস্থানে এসেছে। সময়ের সঙ্গে এই হার বেড়ে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশের মতো যেতে পারে। ফলে বেকারত্বের হারের ওপর আরও চাপ বাড়বে এটাই স্বাভাবিক।

সেবার ক্ষেত্রে আমাদের দেশে ফরমাল খাতে কর্মসংস্থান খুব একটা বাড়েনি। অথচ শিল্প খাতের পাশাপাশি ফরমাল সেবা খাতে কর্মসংস্থান না বাড়লে বেকারত্ব দূও করার স্থায়ী কোনো সমাধান হবে না। এখানে ফরমাল খাত বলতে এমন কর্মসংস্থান যা সরকারি বা বেসরকারি হতে পারে। তবে এ ধরনের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে পূর্ণ সময় দিয়ে শ্রমিকরা উপার্জন করে থাকে। এটা হতে পারে ব্যাংক, বীমা, ব্যবসা-বাণিজ্য, সেবা খাত, শিল্প-কারখানা এবং পর্যটন খাত। আমাদের দেশে এ ধরনের ফরমাল খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার অনেকটাই সীমিত। ফরমাল খাতে কর্মসংস্থানের পরিমাণ আগে আরও কম ছিল তবে এখন তা কিছুটা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইনফরমাল খাতের প্রধান উদাহরণ হলো কৃষি খাত। কৃষি খাতের মাধ্যমে বেকারত্ব দূর করা সম্ভব হবে এটা ভাবা ঠিক হবে না। কারণ কৃষি খাতের ওপর নির্ভরশীলতা আয় বৃদ্ধিতে তেমন একটা সহযোগিতা করে না, কারণ কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি ৩ থেকে ৪ শতাংশের বেশি না। ফলে কৃষি খাতে দক্ষতা বৃদ্ধি করে শ্রমিককে কৃষি খাত থেকে শিল্প খাতে নিয়ে যেতে হবে। এর ফলে কৃষি খাতের উত্পাদন কমবে না। আবার কৃষি খাত থেকে শ্রমিকের স্থানান্তর হবে শিল্প খাতের দিকে যা শিল্পোন্নয়নে সহায়ক হবে।

সামপ্রতিক সময়ে বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক দিক হলো, কৃষি খাতের চেয়ে শিল্প ও সেবা খাতে কর্মসংস্থানের অংশগ্রহণ বাড়তে শুরু করেছে। যদিও ঐতিহাসিকভাবে কৃষি খাতে শ্রমিকের অংশগ্রহণ বেশি ছিল এবং আছে। কিন্তু কৃষি খাতেও শ্রমিকের অংশগ্রহণ মৌসুমি শ্রমিকের মতো। এ খাতে শ্রমিকরা অনেক ক্ষেত্রেই অল্প সময়ের জন্য কাজ পায় এবং দীর্ঘমেয়াদি কোনো কাজ নেই। কৃষি খাতে যারা কাজ করে তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জীবন জীবিকা নিয়ে কোনোভাবে বেঁচে থাকার জন্যই করে থাকে। তাই কৃষি খাতে অধিকতর অংশগ্রহণের মাধ্যমে জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন সম্ভব নয়। উপরন্তু কৃষি খাতে যন্¿পাতির ব্যবহার এবং শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষি উত্পাদন বৃদ্ধি অল্প শ্রমিক দ্বারাই করা সম্ভব।

এ পরিস্থিতিতে কত দ্রুত কৃষি খাতের বাইরে গিয়ে শিল্প ও সেবা খাতে ফরমাল কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা যায় তার ওপরেই নির্ভর করবে বেকারত্ব কত দ্রুত দূর হবে। অন্যান্য দেশের অর্থনীতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিভিন্ন দেশে কয়েক দশক আগেও যেখানে কৃষি খাতে শ্রমিক অংশগ্রহণের হার অনেক বেশি ছিল সেখানে বর্তমানে তা অনেক কমে নেমে এসেছে। আমেরিকায় ১৫০ বছর আগেও যেখানে কৃষি খাতে শ্রমিক অংশগ্রহণের হার ছিল ৯০ শতাংশের ওপর সেখানে বর্তমানে এই হার ২ শতাংশে নেমে এসেছে। একইভাবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও শিল্প খাতে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে বেকারত্ব দূর করতে হলে।

বেকারত্বের হার কমানোর জন্য দেশে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়াতে হবে। বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই। বর্তমানে জিডিপিতে বিনিয়োগের অবদান ২৪ শতাংশ। বেকারত্বের হার কমাতে হলে এই হার ৩২ শতাংশের ওপরে নিয়ে যেতে হবে। বিনিয়োগ বাড়লে বাড়বে জিডিপির প্রবৃদ্ধি। বাড়বে কর্মসংস্থানের আওতা। ফলে কমে আসবে বেকারত্বের হার। এদিকে শিল্পে বিনিয়োগের পাশাপাশি অবকাঠামো খাতেও বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়াতে হবে। কারণ অবকাঠামো উন্নয়ন নিশ্চিত করতে না পারলে শিল্প খাতের উন্নয়ন সম্ভব নয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ানোর বিকল্প নেই। কারণ বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে বিদেশ থেকে যন্¿পাতি, উন্নত প্রযুক্তি এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনাও আসে। পাশাপাশি দেশীয় পণ্যের জন্য বাজারও সৃষ্টি হয় বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে। বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ প্রধানত জ্বালানি ও বিদ্যুত্ খাত এবং টেলিযোগাযোগ খাতে এসেছে। টেলিযোগাযোগ বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রচুর কর্মসংস্থান হয়েছে এবং শ্রমিকের উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে। আরেকটি ব্যাপার হলো, যদিও বিদ্যুত্ ও গ্যাসে বিদেশি বিনিয়োগ সরকারি বহু কর্মসংস্থান করে না, তবে এ বিনিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে শিল্প খাতের উন্নয়নের জন্য।

দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধির প্রয়োজন অনেক। কারণ দক্ষতা বৃদ্ধি পেলে দেশের পাশাপাশি বিদেশেও শ্রমিক রপ্তানির পরিমাণ বেড়ে যাবে। তাছাড়া দেশেও মজুরির পরিমাণ বেড়ে যাবে। দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তা সরকারি বা বেসরকারি উভয়ভাবেই হতে পারে। দক্ষতার পাশাপাশি ভাষার উন্নয়নেও কাজ করতে হবে। ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষার দক্ষতা আমাদের দেশকে ভারত ও ফিলিপিন্সের মতো আউট সোর্সিং (out sourcing) সেন্টারে পরিণত করতে পারে। অনেক দেশেই নার্সিং, হাউস মেইডসহ এ ধরনের কাজের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে নার্সিংয়ের চাহিদা অনেক। তাই এ ধরনের কাজে দক্ষতা বৃদ্ধি করে শ্রমিক রপ্তানির পরিমাণ আরও বাড়ানো যেতে পারে। যা দেশের বেকারত্ব দূর করতে সহায়ক হবে।

বাংলাদেশের অনেক শ্রমিক বিদেশে কর্মরত। বিভিন্ন হিসাবে তার সংখ্যা ৫০ থেকে ৭০ লাখ মনে করা হয়। বিদেশে শ্রমিক রপ্তানির পরিমাণ আরও বাড়াতে পারলে দেশে বেকারত্বের চাপ হ্রাস পাবে। তাই এ ব্যাপারে সরকারের উদ্যোগ নেওয়া দরকার। বর্তমানে বাংলাদেশের বড় বড় শ্রমবাজার যেমন সৌদি আরব, মালয়েশিয়া এবং কুয়েতে শ্রমিক রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। অথচ এসব দেশে শ্রমিকের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে সৌদি আরবে অনেক বড় বড় ভৌত অবকাঠামো প্রকল্প হচ্ছে। তাই এসব দেশের বাজার ফের বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য খোলার ব্যাপারে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারকে রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতার উর্ধ্বে উঠে কূটনৈতিকভাবে সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসার ব্যাপারে কোনো বিলম্ব করা ঠিক হবে না। তাছাড়া বিদেশে শ্রমিক রপ্তানি দেশের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব রাখে। বিশেষ করে রেমিট্যান্স আয়ের মাধ্যমে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেতে পারে। যা দেশের ভেতরে কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে পারে।

 

 

Dr. Ahsan H. Mansur

Dr. Ahsan H. Mansur

Dr. Mansur started his career as a Lecturer, Department of Economics, Dhaka University in 1976. He left for Canada for higher studies in economics in the same year. As a graduate student and research assistant, he was also offering regular economics courses at the undergraduate level at the University of ...

gog