সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশর সামষ্ঠিক অর্থনীতির ধারা ভালো থাকলেও প্রয়োজনীয় সেবা খাতকে মান সম্মত এবং বড় বিনিয়োগ করে প্রবৃদ্ধির গতি বাড়াতে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে বাংলাদেশ। রাজস্ব খাতে কম শুল্ক আদায়
হওয়ায় সরকার অবকাঠামো বিশেষত রাস্তা, বিদু্যৎ খাতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করতে পারছেনা। একই ভাবে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে মানব সম্পদের উন্নয়ন করা যাচ্ছেনা। শুধু তাই নয় এই বিনিয়োগের ঘাটতি সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে থমকে দিচ্ছে এবং বেসরকারি খাতের প্রচুর সম্ভাবনাকে ব্যাহত করছে। এত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ভালো খবর হচ্ছে বাংলাদেশ সরকার রাজস্ব আয় এবং একইসাথে উন্নয়নমূলক ব্যয় বাড়িয়ে অর্থনীতির গতি বাড়ানোর দিকে নজর দিয়েছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের বিভিন্ন খাতের রাজস্ব আয় বাড়াতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সিনিয়র কর্মকতর্াদের সাথে বৈঠক করেছেন এবং এই বিষয়ে সকলকে উদ্বুদ্ধ করার প্রচেষ্টা নিয়েছেন।
বাংলাদেশের রাজস্ব আদায় আশানুরূপ নয়। জাতীয় আয়ের (জিডিপির)-তুলনায় কর সংগ্রহের হার হচ্ছে ৯ শতাংশ। এই অনুপাত সমগ্র দক্ষিণ এশিয় অঞ্চলে শুধু আফগানিস্তানের চেয়ে বেশী এবং অন্যান্যদের তুলনায় অনেক কম। বর্তমানে চীন এবং ভারতে প্রবৃদ্ধির জোয়ার চলছে। বাংলাদেশ এখনই রাজস্ত বাড়ানোর উদ্যোগ না নিলে তাদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে পড়বে এবং বাংলাদেশ তার ভৌগলিক অবস্থানের অর্থনৈতিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। “এশিয় শতাব্দীতে” বাংলাদেশ তার নায্য স্থান থেকে বঞ্চিত হবে এটা আমাদের কাম্য নয়। নিচে এ অঞ্চলের জিডিপি-কর অনুপাতের চিত্র দেয়া হল।
কর-জিডিপি অনুপাত (২০০৮-২০০৯)
বাংলাদেশ ৯.০%
আফগানিস্তান ৭.৪%
ভুটান ১০.৭%
ভারত ১৬.৮%
মালদ্বীপ ২০.৫%
নেপাল ১২.৬%
পাকিস্তান ১০.২%
শ্রীলংকা ১৩.৩%
উৎস ঃ আর্টিকেল ওঠ, কান্ট্রি রিপোর্ট আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আই. এম. এফ)
রাজস্ব আদায়ে করুন চিত্রের প্রেক্ষাপটে সরকার এ খাতে বিভিন্ন সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। যারমধ্যে একটি হচ্ছে নতুন ভ্যাট আইন। এ আইনে আনর্্তজাতিক চর্চা দেখে করদাতাদের সেবার মান উন্নত করা, অনিয়ম কমানো এবং অন্যান্য নিয়ম নীতি নতুন করে ঢেলে সাজানোর প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে। অন্যদিকে বর্তমান অর্থনীতির সাথে তাল মিলিয়ে আরো অর্থবহ এবং যুগোপযোগী করতে আয়কর আইনেও পুর্নলিখন করা হচ্ছে।
রাজস্ব প্রশাসনকে কম্পিউটারইজ করতে ডিজিটাল এনবিআর কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। এতে করে করদাতাদের সাথে প্রতিদিনকার যোগাযোগের ঝামেলা কমে যাবে। যারা এখনো কর জালের বাইরে আছে এবং কম কর দিচ্ছে এমন সম্ভাব্য করদাতাদের সন্ধান পাওয়া যাবে।
রাজস্ব আদায় বাড়াতে নতুন ভ্যাট আইন প্রয়োজন
এনবিআরের ওয়েবসাইডে ভ্যাট আইন সংক্রান্ত খসড়া দেয়া হয়েছে। স্তাভাবিকভাবেই এই খসড়া আইন নানা ভাবে আলোচনায় এসেছে। আমদানি পণ্য এবং ম্যানুফ্যাকচারিং খাতকে লক্ষ্য করে ভ্যাট পদ্ধতি প্রথম প্রবর্তন করা হয়। নির্দিষ্ট কয়েকটি সেবা খাতও এই আইনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এরপরের কয়েক বছরের মধ্যে পাইকারি ও খুচরাসহ বৃহৎ সেবা খাতে এর আওতা বৃদ্ধি করতে গিয়ে ভ্যাট পদ্ধতিতে নানা ত্রুটি-বিচূ্যতি ঢুকে যায়। ভ্যাটের আওতায় রাজস্ব প্রাপ্তির দক্ষতার (ঠঅঞ ঊভভরপরবহপু) হার ২০ শতাংশের নিচে থাকাটা তারই প্রমাণ। কর কাঠামোর অসামানঞ্জস্যতাসহ পুরানো আমলের কর প্রশাসনের সাথে বিভিন্ন খাতের তথ্যের অপব্যবহারের ফলে নাগরিকদেরও কর দিতে অনীহা সৃষ্টি হয়েছে।
এখন নতুন আইনে দক্ষ কর প্রশাসন গড়ে তোলার পাশাপাশি করদাতার যাবতীয় কার্যক্রম ভ্যাট কোডের আওতায় ঢেলে সাজানো হবে। একই সাথে এতে প্রশাসনিক ও নীতিগত সংস্কার করা হবে। তবে প্রচলিত ভ্যাট আইনের শুধু কিছু সংশোধন এনে বা কয়েকটি আদেশ জারি করে কাঙ্খিত ফল পাওয়া যাবেনা।
রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে ভ্যাট পদ্ধতিতে একটি বিস্তৃত ব্যবস্থাপনা দরকার। এ কথা মাথায় রেখে উৎসে অধিক কর্তন মাধ্যমে করের আওতা বাড়ানোর দিকে নজর দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া বাজার দর এবং মূল্যায়ন পদ্ধতির ভিত্তিতে একটি সুষ্টু মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি এতে উলেস্নখ করা হয়েছে । এর ভিত্তিতে ১৫ শতাংশ ফ্ল্যাট রেট অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। নতুন আইনে করদাতা এবং সরকারি কর্মকতর্াদের যোগাযোগের ইস্যুটি উলেস্নখ করা আছে। প্রচলিত আইনে সার্কেল ভিত্তিক করদাতার মনিটরিং করতে হয়। কিন্তু নতুন আইনে কেন্দ্রীয় নিবন্ধন পদ্ধতি থাকবে এবং একটি মাত্র ব্যবসায়িক পরিচিতি নম্বর ( ব্যবসা চিহিূতকরণ নম্বর বা বিন) চালুর কথা বলা আছে।
নতুন আইনে করদাতার অর্থ পরিশোধের বিষয় সহজ, নিরাপদ এবং ঝামেলামুক্ত করা হবে। পুরান আইনে ট্যাজেরি চালান দিয়ে অর্থ পরিশোধ করতে হয়। এ ছাড়া ফ্যাক্টরি থেকে পণ্য খালাসের সময়ে অগ্রিম হিসেবে শুল্ক পরিশোধ করতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। নতুন আইনে ইল্কেট্রনিক ব্যাংকিং, ক্রেডিট কার্ড এবং চেকের মাধ্যমে রিটার্ণের অর্থ জমা দেয়া যাবে। নতুন আইনে কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ হবে রাজস্ব আদায়ের মেরুদন্ড। এতে করে করদাতা এবং রাজস্ব কর্মকতর্া উভয়ের ভোগান্তি এবং এ খাতে দুনীর্তি কমে যাবে। নতুন ভ্যাট আইনে আউটসোর্সিং হিসেবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডাটাবেজ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। কিন্তু ডাটাবেজের মূল প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করবেন এনবিআরের কর্মকর্তারা। খসড়া আইন সরকার গ্রহণ করলে করদাতারা আরো সহজে এবং ঝামেলামুক্তভাবে তাদের কর পরিশোধ করতে পারবে। এতে নিশ্চিত করে বলা যায় এনবিআরের রাজস্বও বাড়বে। কারণ করদাতারা ঝামেলামুক্তভাবে কর দিতে পারলে কর দিতে উৎসাহী হবেন।
সম্প্রতি প্রস্তাবিত ভ্যাট আইন নিয়ে অপপ্রচার ছড়ানো হয়েছে। বলা হয়েছে এতে করে ব্যবসায়ীদের আরো বেশী কর দিতে হবে এবং পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। বাড়বে ব্যবসায়িক খরচ। কিন্তু এ তথ্য একেবারেই ঠিক নয়।
রাজস্ব প্রবাহ বাড়লে অর্থনীতির লাভ, দেশের লাভ। এতে করে অবকাঠামোসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ বাড়বে। উন্নতি হবে জীবন যাত্রার মানের। একইভাবে ব্যবসায়ীরাও লাভবান হবেন। কম খরচে ব্যবসা করা যাবে। বেসরকারিখাতের বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান দুইটি বাড়বে। আমাদের অবকাঠামো খাতে টেকসই বিনিয়োগ দরকার। এ ক্ষেত্রে সম্প্রতি সরকারের বিদু্যৎখাত, রাস্তা এবং পদ্মাসেতুতে বিনিয়োগের উদ্যোগ ভালো উদাহরণ। ভ্যাট আইন এবং এর কার্যক্রমের ব্যাপারে জনসচেতনতা সৃষ্টি প্রয়োজন। যাতে জনগণ জানতে পারেন এ আইনের ফলে জনগণের কি সুবিধা এবং দেশের কি লাভ হবে।
ভ্যাট আইন এবং এর কার্যক্রমের ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা কি ত্রুটিপূর্ণ পুরানো ভ্যাট পদ্ধতিতে থাকবো নাকি এ খাত সংস্কার করে ভ্যাটের দক্ষ ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলবো এই সিদ্ধান্ত আমাদেরই নিতে হবে। আমাদের এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতি বদলে দিতে পারে।
[ লেখক : নির্বাহি পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ]