বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন ভারত সফরে। প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে বাণিজ্যিক অংশীদারিত্বের আলোচনার জন্য সময়টি গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে ছয়টি বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই। প্রথমত. যখনই বাংলাদেশ ও ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা হয়, তখনই বাণিজ্যিক বৈষম্য কিংবা ঘাটতির বিষয়টি সামনে আসে। যদিও ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক ঘাটতির বিষয়ে উদ্বেগের কোনো বিষয় আছে বলে আমি মনে করি না। এখানে দুটি বিষয় রয়েছে। একটি হলো- আমরা প্রধানত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপের বাজারে রপ্তানি করি। সেখান থেকেই প্রধানত আমাদের রপ্তানি আয় হয়। আবার আমদানি বেশি করি চীন ও ভারত থেকে। কাজেই এ দুই দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক ঘাটতি থাকাই স্বাভাবিক। দ্বিতীয়টি হলো, ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী। আমাদের প্রয়োজনেই অনেক পণ্য ভারত থেকে আমদানি করি। সেখান থেকে আমদানীকৃত পণ্যের মধ্যে রয়েছে অতি প্রয়োজনীয় উৎপাদনমুখী কাঁচামাল ও দ্রব্যাদি। যেমন- সুতা, কাপড়, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল ও কয়লা, যানবাহন, যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ, পাথর, চুনাপাথর ইত্যাদি। আমরা আমদানি করি বিভিন্ন প্রকার খাদ্যপণ্য। যেমন- চাল, গম, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ ও অন্যান্য ভোগ্যপণ্য। এই আমদানি যদি ভারতের বদলে চীন থেকে করা হয়, তাতে খরচ যেমন বাড়বে, তেমনি সময়ও বেশি লাগবে। ভারত থেকে যে পণ্য তিন দিনে চলে আসতে পারে, সেটা চীন থেকে আসতে তিন মাসও লেগে যেতে পারে। সেদিক থেকে ভারত স্বাভাবিকভাবেই আমাদের জন্য সুবিধাজনক।
দ্বিতীয়ত. বাণিজ্য ঘাটতি থাকুক; একই সঙ্গে ভারতের বাজারেও আমাদের পণ্য রপ্তানি বাড়ানোর বিষয়ে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। কারণ, সেখানকার বিশাল বাজার ধরতে পারলে বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে লাভবান হবে। বিশেষ করে ভারতের তৈরি পোশাকের বাজার আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এরই মধ্যে আমাদের রপ্তানি অবশ্য বেড়েছে। প্রাণ-আরএফএল কোম্পানি, ওয়ালটনের বাজার সেখানে সম্প্রসারিত হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে পাট ও পাটজাত দ্রব্য, সাবান, গার্মেন্টস সামগ্রী, ব্যাটারি, মাছ, কেমিক্যাল, এসি ও ফ্রিজ ভারতে রপ্তানি হচ্ছে। এসব পণ্য রপ্তানি আরও অনেক বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।
তৃতীয়ত. ২০২৬ সালে বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণ হবে। অর্থাৎ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবে। তখন বিশ্ববাজারের অনেক সুবিধা আর থাকবে না। সে বিষয়টি সামনে রেখে এখনই দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক চুক্তির দিকে নজর দিতে হবে। তারই আলোকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি ‘সেপা’ নামে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। আমরা দেখেছি, এ ব্যাপারে যৌথ সমীক্ষাও হয়েছে। সেপা চুক্তির মধ্যে পণ্য ও সেবা বাণিজ্য, বিনিয়োগ, মেধাস্বত্ব ও ই-কমার্সের মতো অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকছে। এ চুক্তি হলে উভয় দেশের বাণিজ্য আরও বাড়বে এবং বিনিয়োগের নতুন দরজা উন্মুক্ত হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমাদের সতর্কতারও বিষয় রয়েছে। এ চুক্তির কারণে দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তার চেয়েও বড় বিষয়, এ চুক্তির আওতায় আমদানি শুল্ক্কের প্রতিবন্ধকতা কমাতে হবে, যাতে বাংলাদেশ যথাযথভাবে এর সুফল পেতে পারে। আরেকটি বিষয় বলা দরকার। এ ধরনের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক চুক্তি ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আসিয়ান কিংবা চীনের সঙ্গেও হতে পারে।
চতুর্থত. ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কানেক্টিভিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেদিক থেকে রেল ও নৌপথে যোগাযোগ আরও সহজ ও সম্প্রসারণ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরে সাতটি সমঝোতার মধ্যে দুটি রেল সংক্রান্ত। একটির আওতায় বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মীরা ভারতীয় রেলওয়ের ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষণ নেবে। আরেকটি হচ্ছে ভারত ও বাংলাদেশের রেলওয়ের মধ্যে আইটিবিষয়ক সহযোগিতা। এগুলো ঠিক আছে। তবে আমি বলছি মালপত্র আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে রেল যোগাযোগ বাড়ানোর কথা। ট্রাকে পণ্য আনা-নেওয়ার খরচ অনেক বেশি; ঝামেলাও কম নয়। সেদিক থেকে ট্রেন ভালো বিকল্প নিঃসন্দেহে। সে লক্ষ্যে রেলওয়ের অবকাঠামো ও অন্যান্য সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বাংলাদেশ রেলওয়ের সে ধরনের প্রস্তুতি থাকতে হবে এবং প্রয়োজনে প্রাইভেট সেক্টরকে কাজে লাগানোর কথা ভাবতে হবে। এখন পদ্মা সেতু নির্মিত হয়ে গেছে এবং সেখানে রেলওয়ে সংযোজনের কাজও হচ্ছে। ফলে ভারতের সঙ্গে রেল যোগাযোগ আরও সহজ হবে।
রেলওয়ের পাশাপাশি নদীপথে যোগাযোগের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। নদীপথে জাহাজে চাল, গম সহজেই আসতে পারে। ভারতীয় পাথর বা ভারী নির্মাণসামগ্রী আনা-নেওয়ার জন্য নদীপথ কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম। কলকাতা নদীবন্দরের সঙ্গে সরাসরি এবং ব্যাপক যোগাযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে এটি করা সম্ভব।
পঞ্চমত. ভারতীয় বিনিয়োগ আমাদের দেশে কীভাবে বাড়ানো যায়, সে লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে চলমান লাইন অব ক্রেডিটগুলোর (এলওসি) আওতাধীন প্রকল্পগুলোর গতিশীলতা বাড়াতে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশনও গঠন করা যেতে পারে। এলওসির বাইরেও ভারতীয় বিনিয়োগ বাড়াতে সে দেশের বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সরকারি প্রতিনিধি ছাড়াও আমাদের ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ আলোচনায় বসতে পারেন। ভারতের টাটা, বিড়লা, রিলায়েন্স বা আদানির মতো বড় বড় কোম্পানির বিনিয়োগের প্রসার বাংলাদেশে ঘটলে অর্থনৈতিক দিক থেকে উভয় দেশ লাভবান হবে।
ষষ্ঠত এবং গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি অর্থনীতি ও বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট, সেটি হলো রাজনৈতিক অঙ্গীকার। আমরা দেখেছি, ভারত মাঝেমধ্যেই রপ্তানি পণ্যে বিধিনিষেধ জারি করে। যেমন- পেঁয়াজ, চাল ও অন্যান্য অতি প্রয়োজনীয় পণ্য। বস্তুত ভারত যখনই পেঁয়াজ বা চাল রপ্তানি করবে না বলে, তখনই আমাদের এখানে পেঁয়াজ বা চালের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে যায়। এভাবে যেসব পণ্যের ক্ষেত্রে আমরা ভারতের ওপর নির্ভরশীল, সেসব পণ্যে ভারত যেন হঠাৎ বিধিনিষেধ না দেয়, সে জন্য তাদের রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রয়োজন। যেহেতু আমরা ভারতের ওপর নির্ভরশীল এবং আস্থাবান বাণিজ্যিক অংশীদার, সেহেতু ভারত অন্যদের সঙ্গে যে আচরণ করে, সেটা আমাদের সঙ্গে করা উচিত হবে না। রাজনৈতিক অঙ্গীকারের দিক থেকে অন্যান্য বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন- তিস্তা চুক্তিসহ অন্যান্য নদীর ক্ষেত্রেও দ্রুত সমঝোতায় পৌঁছতে হবে। এবার প্রধানমন্ত্রীর সফরে যেমন রহিমপুর খাল দিয়ে কুশিয়ারা নদী থেকে ১৫৩ কিউসেক পানি বণ্টনে সমঝোতা স্মারক সম্পন্ন হয়েছে। অন্যান্য নদীর ব্যাপারেও আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে।
প্রতিবেশী হিসেবে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে উভয়েরই যেন ‘উইন উইন’ পরিস্থিতি হয়, সে জন্যই আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ। সম্পর্ক ঠিক থাকলে চিকিৎসা, শিক্ষাসহ অন্যান্য খাতেও বিনিয়োগ বাড়ানো যেতে পারে। যার মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশই উপকৃত হবে। দুই দেশের মধ্যকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বন্ধন আরও সুদৃঢ় করা এবং পরস্পরের সহযোগী হিসেবে ও সমতার ভিত্তিতে এ সম্পর্ক আরও উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়াই উভয় দেশের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
ড. আহসান এইচ মনসুর :অর্থনীতিবিদ ও নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ
https://www.samakal.com/opinion/article/2209130543/