বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দিয়ে বিভিন্ন জেলা ও মন্ত্রণালয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। উন্নয়ন অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তিনি বিশ্বব্যাংকের পরামর্শক হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর ও শুল্ক সংস্কারে ভূমিকা রাখেন। পরে ইউএনডিপির সামষ্টিক অর্থনীতিবিদ হিসেবে পরিকল্পনা কমিশনেও কাজ করেন। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসে জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নানা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। চলতি হিসাবে ঘাটতি, রফতানি প্রবৃদ্ধি হ্রাস, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, বেসরকারি বিনিয়োগ, বড় প্রকল্পের অগ্রগতি প্রভৃতি বিষয় নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা হয় তার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা
সদ্য বিদায়ী বছরে লেনদেনের চলতি হিসাবে ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিকে আপনি কীভাবে বিশ্লেষণ করেন?
লেনদেনের চলতি হিসাবের ঘাটতি নিয়ে যথেষ্ট জল্পনা-কল্পনা চলছে। অন্যান্য খবরের মতো এটিও গণমাধ্যমের কাছে চাঞ্চল্যকর একটি খবর। লেনদেনের চলতি হিসাবের ঘাটতি গেল অর্থবছর ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ায় উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি। আমি এর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করি। চলতি হিসাবের ঘাটতির ভালো-মন্দ উভয় দিকই রয়েছে। আমার মতে, উভয় দিক বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে। বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে এর বিশ্লেষণ প্রয়োজন। লেনদেনের ভারসাম্যের চলতি হিসাবের ঘাটতি ভালোর দিকে যাচ্ছে নাকি মন্দের দিকে, অথবা এর চাপ আমাদের অর্থনীতিতে কতটা পড়ছে ইত্যাদি বিষয় বের হয়ে আসবে যৌক্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমেই। কোনো একটি বছরে ১০ বিলিয়ন ডলারের চলতি হিসাবে ঘাটতি আমাদের অর্থনীতির জন্য বিরাট ক্ষতির কারণ, বিষয়টিকে এভাবে দেখার অবকাশ নেই। দুশ্চিন্তার কিছুই হয়নি এখন পর্যন্ত। বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত এখনো শক্ত। যদিও অনেক আঘাত আসছে। ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতা আমাদের অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের আঘাত নিঃসন্দেহে, এ পরিস্থিতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদের অর্থনীতির ভারসাম্যের দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এক্সটার্নাল ব্যালান্স ও ইন্টারনাল ব্যালান্স। উভয় ক্ষেত্রেই আমরা মোটামুটি টেকসই অবস্থায় রয়েছি। এ কারণে আমরা এখনো কোনো অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হচ্ছি না।
২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১৮ বছরের লেনদেনের ভারসাম্য বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখব মাত্র পাঁচ বছর খুবই সামান্য পরিমাণ চলতি হিসাবে ঘাটতি হয়েছে। বাকি সব বছরে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল। চলতি হিসাবের ঘাটতির নম্বরটি গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো জিডিপির অনুপাতে চলতি হিসাবের ঘাটতি কত। অর্থাৎ আমাদের অর্থনীতির আকারের তুলনায় চলতি হিসাবের ঘাটতির অংকটা কত বড়। ১০ বিলিয়ন ডলার আমাদের জিডিপির সাড়ে ৩ শতাংশের মতো। অনেক বিশেষজ্ঞও চলতি হিসাবের উদ্বৃত্তকে ভালো হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশ, যার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ, এমন অর্থনীতির জন্য প্রতিটি বছর চলতি হিসাবের উদ্বৃত্ত কি ভালো লক্ষণ? চলতি হিসাবের উদ্বৃত্তের একটি অর্থ হলো, আমরা যথেষ্ট বিনিয়োগ করতে পারছি না। আমাদের সঞ্চয়ের হারের চেয়ে বিনিয়োগের হার কম। আমরা প্রয়োজন অনুযায়ী বিনিয়োগ করতে পারি না, তখন চলতি হিসাবের উদ্বৃত্ত দেখা দেয়। গেল ১৮ বছরের মধ্যে ১৩ বছর এ অবস্থায় কেটেছে। চলতি হিসাবের ঘাটতির বার্তাটি এর উল্টো। আমরা এখন বিনিয়োগ করছি সঞ্চয়ের চেয়ে বেশি। বিনিয়োগ যদি আমরা ঠিক ঠিক জায়গায় করে থাকি, তাহলে এর ফল আমরা ভবিষ্যতে পাব। আমাদের উৎপাদনশীলতা বাড়বে। বর্তমান চলতি হিসাবের ঘাটতির একটি বড় কারণ হলো, সরকার একই সঙ্গে ১০টি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এগুলোর সম্মিলিত বাজেটের পরিমাণ ৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। আগামী ১০ বছরে এগুলো বাস্তবায়ন হবে। এসব প্রকল্পের জন্য প্রচুর যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি করা হয়েছে। ১০টি মেগা প্রকল্প আমাদের ভৌত অবকাঠামো সংক্রান্ত। এগুলোর ফল আমরা খুব দ্রুত পাব না। পাঁচ বা ১০ বছর পর এর সুফল আমরা পাব। তখন আমাদের প্রবৃদ্ধির হার আরো বেড়ে যাবে, আয় বাড়বে, কর্মসংস্থান বাড়বে। চলতি হিসাবের ঘাটতি বলছে যে আমাদের বিনিয়োগ হচ্ছে, অবশ্যই এটি ভালো বিষয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ বিনিয়োগ কোথায় হচ্ছে? বিনিয়োগের বাস্তবায়ন ঠিকমতো হচ্ছে, নাকি আমরা স্বল্প সম্পদের অপচয় করছি প্রভৃতি দেখতে হবে।
চলতি হিসাবের ঘাটতি মেটানো হচ্ছে কীভাবে?
চলতি হিসাবের ঘাটতির অর্থায়ন অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ঘাটতি টেকসই কিনা দেখতে হবে। একটি হলো, আমাদের ২ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক বিনিয়োগ হয়েছে। দ্বিতীয়ত, আমরা মাল্টিলেটারাল ঋণ (যেমন বিশ্বব্যাংক থেকে নেয়া) নিয়ে কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। এটি ভালো। ভৌত অবকাঠামো বিনিয়োগে এ ঋণ খুবই ভালো। এর সুদের হার কম, সুবিধাও বেশি। অনেকে হয়তো বলবেন, আমরা নন-কনসেশনাল ঋণ নিচ্ছি। বেশির ভাগ ঋণ ব্যয় হচ্ছে সরকারি খাতে। সরকারি খাত বাইরে থেকে জিডিপির আড়াই শতাংশ ঋণ করে থাকে। এটি এখনো আমাদের আয়ত্তে। কিছু মেগা প্রকল্প দ্বিপক্ষীয় ঋণ নিয়ে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এতেও ভিন্নতা রয়েছে। জাপান দ্বিপক্ষীয় ঋণ দিলে তা ভালো। কারণ তারা অধিকাংশ সময় ঋণ মওকুফ করে দেয় বা সহায়তা হিসেবে অর্থ দিয়ে দেয়। অন্যান্য দেশ থেকে ঋণ নিতে হয় চড়া সুদে অধিক শর্তে। যদিও ঋণ নেয়ার সময় বলা হয়, ২ বা ৩ শতাংশ সুদে ঋণ দিচ্ছে। কিন্তু শর্ত থাকে, পণ্য কিনতে হবে তাদের দেশ থেকে। সে সময়ে অধিক দাম দিয়ে কম মানসম্পন্ন পণ্য কিনতে হতে পারে। তাদের পরামর্শক নিয়োগ দিতে হয়। এসব পরিপ্রেক্ষিতে ২ শতাংশ কনসেনশাল ঋণ আর কার্যকর থাকে না। চড়া সুদে বিদেশী ঋণে প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে আমাদের ঋণগ্রস্ততা বেড়ে যাবে। সেখানেও ভাবার বিষয় রয়েছে। ঋণ নিয়ে আমরা এখনো সংকট তৈরির পর্যায়ে পৌঁছেনি। আমরা এখনো স্বল্প ঋণগ্রস্ত দেশ। আমাদের সরকারি ঋণ জিডিপির ৩৩ শতাংশ। বৈদেশিক ঋণ জিডিপির মাত্র ১২ শতাংশ। আমাদের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতাও অনেক ভালো। প্রতি বছর আমরা বৈদেশিক ঋণের সুদাসল পরিশোধ বাবদ ব্যয় করি বৈদেশিক আয়ের মাত্র ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। আমাদের ঋণ নেয়ার অনেক সুযোগ রয়েছে। উন্নয়নশীল দেশের বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তার তুলনায় সঞ্চয়ের হার অপ্রতুল হওয়ায় বিনিয়োগের জন্য ঋণ করতে হয়। কিন্তু এ বিনিয়োগ আমরা কোথায় করছি, সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অযথা অর্থ ব্যয় করলে ঋণ পরিশোধে সমস্যা সৃষ্টি হবে, অর্থনীতিও কোনো উপযোগ পাবে না। কোথা থেকে কী সুদে আমরা ঋণ নিয়ে কোথায় বিনিয়োগ করছি, সেটি দেখাও গুরুত্বপূর্ণ।
চলতি হিসাবের ঘাটতি অর্থনীতিতে কি কোনো প্রভাব ফেলবে না?
আমি আগেই বলেছি, ১০ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো, এটি জাতীয় উৎপাদনের কত শতাংশ। জিডিপির সাড়ে ৩ শতাংশ এ ঘাটতি। ১৩ বছর উদ্বৃত্ত থাকলাম, আর তিন-চার বছর ঘাটতি হলেই বড় ধরনের প্রভাব অর্থনীতিতে পড়বে, এমনটি ভাবার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, এটি টেকসই কিনা। সেটি নির্ভর করছে আগামী বছরগুলোয় আমাদের প্রবৃদ্ধির হার, রফতানি ও রেমিট্যান্সপ্রবাহ কী পরিমাণে হবে এবং আগামীতে কনসেশনাল ও নন-কনসেশনাল ঋণের পরিমাণ কী হবে তার ওপর।
অনেকে অভিযোগ করছেন, অর্থ পাচারের কারণে লেনদেনের ভারসাম্যে প্রভাব পড়ছে। আপনি কি একমত?
অভিযোগটি উড়িয়ে দেয়া যাবে না, আসলেই মূলধনি যন্ত্রপাতি আসছে কিনা। আন্ডার বা ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে অর্থ পাচার হয়ে থাকতে পারে। এটি সম্পূর্ণ ধারণার ওপর নির্ভর করে বলা হচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে আমরা জানছি, কিছু ক্ষেত্রে যন্ত্রপাতি আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিং হতে পারে। কারণ যন্ত্রপাতি আমদানিতে অনেক ক্ষেত্রে শূন্য শুল্ক আছে, অনেক ক্ষেত্রে ১-৩ শতাংশ শুল্ক আছে, খুবই অল্প পরিমাণ। যন্ত্রপাতি আমদানির মাধ্যমে অর্থ পাচারের প্রবণতা আমাদের এখানে সবসময়ই ছিল এবং এখনো আছে। এ কারণেই আমি বলছি, মেগা প্রকল্প ঠিক আছে কিন্তু বিনিয়োগ সঠিক জায়গায় ও সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা সেটিই আলোচনার বিষয়, চলতি হিসাবের ঘাটতি নয়। অনেকে অভিযোগ করছেন, প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে। সেটি খতিয়ে দেখা সরকারের দায়িত্ব। প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় জোর দিতে হবে। অবৈধভাবে অর্থ পাচার হচ্ছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখতে হবে। সব দেশেই অর্থ পাচার হয়। আমাদের দেশে অনেক দিন ধরেই অর্থ পাচার হয়ে আসছে। দেশে সংকটের আশঙ্কা থাকলে অর্থ পাচারের প্রবণতা দেখা দেয়। এটি কি সংকটের পর্যায়ে চলে গেছে, নাকি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে তা আমাদের দেখতে হবে। অর্থ পাচার নিয়ে বড় ধরনের তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। শুধু তদন্ত করলেই হবে না, দৃশ্যমান ফল দেখতে চাই। একটি নিরপেক্ষ কমিশনের কাছে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে।
চলতি হিসাবের ঘাটতি রিজার্ভের ওপর চাপ ফেলবে কি?
বর্তমানে বাণিজ্যের লেনদেনের ভারসাম্যের যে চিত্র পাচ্ছি, তাতে ২০১৮ আর্থিক বছরে বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলার। রফতানি থেকে আয় এসেছে ৩৬ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার এবং আমদানি করেছি প্রায় ৫৮ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু ১৫ বিলিয়ন ডলার আসছে রেমিট্যান্স। সুতরাং বাণিজ্যের ঘাটতি কিছুটা রেমিট্যান্সের মাধ্যমে মেটানো হচ্ছে। কিন্তু তার পরও আমাদের সেবা খাতে ৫-৭ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি রয়েছে। এগুলো নিয়েই আমাদের চলতি হিসাবের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। ঘাটতি ১০ বিলিয়ন ডলার হলেও সেটির অর্থায়ন হয়েছে। সার্বিক লেনদেনের (ওভারল ব্যালান্স) ভারসাম্যের কিছুটা ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। জাতীয় উৎপাদনের ১ শতাংশেরও কম এ ঘাটতি। সুতরাং এ ঘাটতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। রিজার্ভের ওপর একটু চাপ পড়বে। গেল বছর লেনদেনের ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত ছিল। ফলে রিজার্ভ বেড়েছে গত বছর। এ বছর রিজার্ভ এত বাড়েনি, যদিও রেমিট্যান্স আগের বছরের চেয়ে ৩ বিলিয়ন ডলার বেশি এসেছে। এতে রিজার্ভ বাড়ার কথা ছিল। কিন্তু যেহেতু আমরা অনেক বেশি আমদানি করেছি, সে তুলনায় রফতানি প্রবৃদ্ধি বাড়েনি, সেহেতু আমাদের রিজার্ভ কিছুটা কমেছে। এখনো ৩১ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ রয়েছে, যা সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী সাত মাসের বেশি আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য যথেষ্ট। বাণিজ্যে ঘাটতি হলে নামিক মুদ্রা বিনিময় হারের ওপর চাপ পড়ে। টাকার বিনিময় হার অবমূল্যায়ন করার কথা এবং করেছে কিছুটা। আরো বেশি অবমূল্যায়ন হতো যদি বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে ডলার ছেড়ে মুদ্রার পতন ঠেকানোর চেষ্টা না করত। বাংলাদেশ ব্যাংক ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে বলে জানা গেছে। ডলারের বিনিময় হার বর্তমানে ৮৩ দশমিক ৫ টাকায় নেমেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বাজারে না ছাড়লে সেটি ৮৬-৮৭ টাকায় চলে যেত। টাকার কিছু অবমূল্যায়ন হওয়াটা ভালো। টাকার অবমূল্যায়ন রোধ করতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরো ডলার ছাড়তে হবে। টাকার অবমূল্যায়ন রফতানিকারকদের উৎসাহের কারণ হবে। তবে আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে যায়। আমাদের গবেষণায় দেখেছি কৃত্রিমভাবে টাকার মান ধরে রেখে আমরা গেল কয়েক বছর রফতানিকারকদের ক্ষতি করেছি। গেল পাঁচ বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখছি রিয়েল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট (আরইইআর) ৪৫ শতাংশ অ্যাপ্রিশিয়েট করেছে। এর অর্থ আমাদের রফতানিকারকদের ৪৫ শতাংশ প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে গেছে অন্যান্য দেশের তুলনায়। ২০১৮ আর্থিক বছরে রফতানি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৮ শতাংশ হওয়ার এটিও একটি কারণ। যেখানে ভিয়েতনামের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২০-২৪ শতাংশ। এক্ষেত্রে টাকার কিছুটা অবমূল্যায়ন করতে পারলে রফতানিকারকরা উৎসাহিত হতে পারেন। কিন্তু আমাদের মূল্যস্ফীতি এখনো ৫ শতাংশের ওপর। সুতরাং আমাদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন না ঠেকিয়ে বাজারের মাধ্যমে মান নির্ধারণ করতে দিতে হবে। সেটি যেন বেশি না হয়ে যায়, তা তদারক করতে হবে।
বিনিময় হার অবমূল্যায়ন হলে আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে যাবে, মূল্যস্ফীতি বাড়বে?
এরও উত্তর আছে। এর একটি প্রতিকার হচ্ছে আমদানি শুল্ক কমানো। বিনিময় হার অবমূল্যায়ন হলে তার নেতিবাচক প্রভাব শুল্ক কমিয়ে ঠেকানো যায়। তাহলে তো পণ্যের দাম বাড়ার কথা নয়। ধরুন, বিনিময় হার ৮০ থেকে ৮৪ (৫ শতাংশ) টাকায় চলে গেল ১০০ টাকার আমদানি করতে, তখন ১০৫ টাকা ব্যয় হবে। শুল্ক যদি ৫ শতাংশ কমিয়ে দেয়া হয়, তবে পণ্য আমদানিতে ১০০ টাকাই লাগবে। অবমূল্যায়নের কারণে আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে যাবে, সেটি কমানোর জন্য শুল্ক কমানো একটি সমাধান। সরকার রাজস্বও হারাবে না। মুদ্রার বিনিময় হার অবমূল্যায়ন হলে সরকারের রাজস্বও বাড়ে। এখানে যেটি হচ্ছে, মুদ্রার অবমূল্যায়ন হলে সরকার বাড়তি রাজস্ব পায়, সেটি ছাড় দিলেই পণ্যের দাম বাড়ে না। সরকার তো শুল্ক এমনিতেই অনেক বাড়িয়ে রেখেছে। আমরা বছরের পর বছর বলে যাচ্ছি, আমদানি শুল্ক কমানো হোক। অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের আমদানি শুল্ক বেশি। বেশি শুল্কের কারণে আমাদের পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের সাধারণ ভোক্তারা ১০০ টাকার পণ্য অনেক ক্ষেত্রে ২০০ টাকায় কিনতে বাধ্য হচ্ছে উচ্চ শুল্কের কারণে। এ অবস্থার পরিবর্তন জরুরি।
বিনিময় মূল্য বাড়লে রফতানিকারকরা লাভবান হবেন, তাদের প্রণোদনা বাড়ল। সরকারি কোষাগার থেকে কিছুই খরচ হলো না। তৈরি পোশাক শিল্প ছাড়া যেসব পণ্য উৎপাদন হয়, উদ্যোক্তা সেগুলো দেশীয় বাজারে বিক্রি করতে পারেন আবার রফতানিও করতে পারেন। তারা যদি দেখেন দেশীয় বাজারে বিক্রি করলে মুনাফা বেশি, তবে তারা দেশীয় বাজারে পণ্য বিক্রি করবেন, রফতানি করতে উৎসাহ পাবেন না। এ কারণেই আমরা দেখছি তৈরি পোশাকবহির্ভূত পণ্য রফতানি নেতিবাচক। অন্যদিকে তৈরি পোশাক রফতানির প্রবৃদ্ধি বেশি। আমরা বারবার বলে আসছি তৈরি পোশাকবহির্ভূত খাত খুবই অসুবিধার মধ্যে আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে ডলার ছাড়ার বিনিময়ে টাকা উঠিয়ে নিয়েছে। বাজারে এর কি কোনো প্রভাব পড়বে?
আর্থিক বাজারে তারল্য সংকট যেটি ছিল সেটি আরো বাড়বে। ব্যালান্স অব পেমেন্ট নেগেটিভ হওয়ায় ব্যাংকের রিজার্ভ মানিও কমে গেছে। এতেও তারল্যস্বল্পতা দেখা দিয়েছে। মুদ্রা সরবরাহের যে প্রবৃদ্ধি আশা করা হচ্ছিল তা হয়নি। আমানতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সবকিছু বিশ্লেষণে আমরা নীতির কিছু অসামঞ্জস্য লক্ষ করছি।
সরকারের নীতির অসামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হচ্ছে না?
নীতির অসামঞ্জস্যের কিছু নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যালান্স আনা উচিত। নীতির বৈপরীত্য থাকা উচিত নয়। তাহলে আমরা সংকটের দিকে যাব না। বর্তমানে নেতিবাচক যে বিষয়গুলো সংঘটিত হচ্ছে সেগুলোকে যদি আমরা প্রশ্রয় দিই, তাহলে আমাদের ভালো সূচকগুলোও খারাপের দিকে চলে যাবে।
বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে আরো কয়েক বছর লাগবে।তাহলে তো প্রতি বছরই বাণিজ্যের ভারসাম্যে ঘাটতি তৈরি হবে। এটি কীভাবে মোকাবেলাকরা হবে?
লেনদেনের ঘাটতি প্রতি বছরই কিছু হয়তো থাকবে। ঘাটতিটা যদি আমাদের জন্য টেকসই উন্নয়নের নির্দেশক হয় তাহলে সমস্যা নেই। আমাদের বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশ। এর বেশি হয় না। এটি অবশ্যই টেকসই। ঠিক তেমনি এক্সটার্নাল ঘাটতি, বিশেষ করে লেনদেনের চলতি ঘাটতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকলে আমাদের কোনো অসুবিধাই নেই। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে এ ঘাটতি থাকাটাই স্বাভাবিক। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ হলে বাংলাদেশে সে ঘাটতি সহজেই সহনীয় হতে পারে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ হলে সহনীয় হবে না। ৭ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সময়েও বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশে রাখা অবশ্যই টেকসই। ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে বাজেট ঘাটতি আরো বেশি হলেও সমস্যা হবে না। বাংলাদেশের অর্থনীতি এটি ম্যানেজ করার শক্তি অর্জন করেছে। মেগা প্রকল্পের যে অর্থ ব্যয় হচ্ছে, তার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এটি যেন অপব্যয় বা অপব্যবহার না হয়। প্রকল্প ব্যয় স্থির রেখে যথাসময়ে যেন বাস্তবায়ন করা যায়, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে যেন কাজ বণ্টন হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দেশে বিনিয়োগের রিটার্ন হচ্ছে প্রডাক্টিভিটি গ্রোথ। বিনিয়োগ হলে উৎপাদনশীলতা বাড়বে। অবকাঠামো, বিদ্যুৎ-গ্যাস-বন্দর, যানজট প্রভৃতি সমস্যার দ্রুত সমাধান করতে হবে। অবকাঠামো নির্মাণে আমাদের প্রচুর গ্যাপ রয়ে গেছে। চাহিদার তুলনায় অবকাঠামো এখনো অপ্রতুল। এখানে প্রচুর বিনিয়োগ করতে হবে। মেগা প্রকল্পগুলো এ গ্যাপ পূরণে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। তবে সেটি নির্ভর করছে যথাসময়ে যথাব্যয়ে প্রকল্প শেষ করার ওপর। ব্যয় বেড়ে গেলে উপযোগও কমে যাবে।
বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে না কেন?
বেসরকারি বিনিয়োগ প্রসঙ্গে আসতে হলে দেখতে হবে বিনিয়োগের আবহাওয়া বা পরিবেশটা কেমন রয়েছে। বিনিয়োগ পরিবেশ ভালো না থাকলে আমদানিও কমে যাবে। তবে রফতানি নৈপুণ্য (পারফরমেন্স) নির্ভর করছে আমরা কতটা প্রতিযোগিতাসক্ষম এর ওপর। আন্তর্জাতিক চাহিদার কোনো কমতি নেই। কম খরচে মানসম্পন্ন পণ্য তৈরি করলে চাহিদা আছে। রফতানিমুখী শিল্পে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রচুর সুযোগ রয়েছে। অবশ্য রফতানি বাড়াতে হলে একটু দৌড়ঝাঁপ করতে হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা সেটি করতে চান না। দৌড়ঝাঁপ করলে, বাজার পেলে রফতানির ক্ষেত্রে বিরাট দরজা খুলে যায়। কাজটি হচ্ছে না। আমাদের রফতানি প্রবৃদ্ধি হওয়া উচিত ১০-১৫ শতাংশ। ১৯৯১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত আমরা তা-ই দেখেছি। ২০১২ সাল থেকে রফতানিতে আমাদের একটু মন্দা যাচ্ছে। তার কিছু কারণ রয়েছে। ভর্তুকি দিয়ে রফতানি করা যাবে না। নীতিগুলো রফতানি সহায়ক করতে হবে। একটি নীতি এক্ষেত্রে বড় বাধা, সেটি হলো আমদানি শুল্ক। আমদানি শুল্ক এত বেশি যে দেশীয় বাজারে বিক্রি করলে মুনাফার হার অনেক বেশি।
অনেকে বলেন, পোশাক খাতকে বেশি প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে কিন্তু অন্য খাতকে তেমন দেয়া হচ্ছে না।
এটা ঠিক নয়। অনেকে মনে করেন, পোশাক খাতকে বেশি প্রণোদনা দেয়া হয়। পোশাক খাতকে দেয়া হয় বন্ডেড ওয়্যারহাউজ ফ্যাসিলিটি আর ব্যাক টু ব্যাক এলসি। এটি ১৯৮০ সাল থেকে দেয়া হয়। এটি প্রণোদনা নয়। এটি যেকোনো রফতানিকারকের একান্ত প্রয়োজন বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করার জন্য। এটি দেয়া না হলে আজকে পোশাক খাত দাঁড়াতে পারত না। এটি অন্য রফতানি খাতগুলোকেও দেয়া উচিত।
আমরা বলে আসছি, এসব সুবিধা সবাইকে দেয়া হোক। তা না হলে কোনো রফতানি শিল্পের বিকাশ ঘটবে না। রফতানি বৈচিত্র্যকরণও সম্ভব হবে না। আমাদের দেশে উচ্চ শুল্ক ব্যবস্থা বিদ্যমান। উচ্চ শুল্ক ব্যবস্থায় রফতানিকারকরা নিরুৎসাহিত হন। একটি বিষয় হলো, রফতানির জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। আমদানির ওপর ৫ শতাংশ শুল্ক হলেও সেটি বেশি। কারণ তখন দেশীয় রফতানি খাত প্রতিযোগিতাসক্ষম হবে না। রফতানি করতে হলে যেসব কাঁচামাল আমদানি করতে হয় সেগুলো শূন্য শুল্কে আনতে হবে। আমাদের আপেক্ষিক সুবিধা কী? সেটি হলো নিম্ন ব্যয়ের শ্রম। এখন পর্যন্ত এটিই হচ্ছে আমাদের উন্নতির সূত্র। সেখান থেকেই আমাদের আপেক্ষিক সুবিধা আসবে। কিন্তু কাঁচামালের ওপর ৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হলে আমরা রফতানি করতে পারব না। পোশাক খাত ১৯৮০ সাল থেকে সেটি বুঝে গেছে। ওই সময় নুরুল কাদের খান— যিনি দেশ গার্মেন্টস করেছিলেন, নুরুল ইসলাম— যিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন, তারা ওই নীতি তখন করতে পেরেছিলেন। আমরা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে বছরের পর বছর শুল্ক কমানোর বিষয়টি বলে আসছি। তারা খালি বলে রাজস্ব, রাজস্ব। আসলে রাজস্ব নয়। যারা সংরক্ষণ করতে চায়, তারা তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করছে। এটি দেশের ভবিষ্যতের জন্য বড় ক্ষতি। আমরা ভিয়েতনামের মতো গতিশীল রফতানিকারক হতে পারছি না।
রফতানি বৈচিত্র্যকরণের কথা বলা হচ্ছে। এক্ষেত্রে উন্নতি নেই কেন?
রফতানি বৈচিত্র্যকরণের ক্ষেত্রে সমস্যা আছে। অনেকে হয়তো বলবেন, না, আমাদের কাঠামোগত সমস্যা। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুতের সুবিধা নেই। এগুলো রফতানির জন্য যেমন প্রযোজ্য, তেমনি আমদানির জন্য প্রযোজ্য, অন্য যেকোনো খাতের জন্যও প্রযোজ্য। আমি মনে করি, উচ্চ শুল্কই রফতানি বৈচিত্র্যকরণের ক্ষেত্রে বড় বাধা। রফতানি করতে হলে আমদানিকৃত কাঁচামাল শুল্কমুক্ত আনার সুযোগ দিতে হবে। রেয়াত সুবিধাও রফতানি করার সঙ্গে সঙ্গে দিতে হবে। এক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা হলে চলবে না। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা প্রকট, সেখানে কোনো সুরক্ষা (প্রটেকশন) নেই। সেক্ষেত্রে বড়জোর ভর্তুকি দেয়া যায়। আন্তর্জাতিক নিয়মে রফতানির ওপর ভর্তুকি অসীমিতভাবে দেয়া যায় না। কিন্তু দেশীয় বাজারে বিক্রয়ের জন্য অসীমিত ভর্তুকি বিরাজমান। কীভাবে?
এখন গামের্ন্টে ৩ শতাংশ ভর্তুকি আছে। সেটি প্রযোজ্য হবে যদি নতুন বাজারে (নন-ট্রাডিশনাল মার্কেট) রফতানি করে। যেমন পোশাক রফতানিকারকরা যদি চীন, কোরিয়া ও রাশিয়ায় রফতানি করেন। রফতানিতে ভর্তুকি কম। কারণ সেটি আমাদের বাজেট থেকে আসে। কিন্তু শিল্প সংরক্ষণ বা উচ্চ শুল্ক হার ৭০-৯০ শতাংশ আরোপ করা হয়, এটিও এক ধরনের ভর্তুকি অভ্যন্তরীণ বাজারে বিক্রির জন্য। তবে এ ভর্তুকি দিচ্ছে জনগণ।
বলা হচ্ছে কিছু শিল্প রফতানিতে সম্ভাবনাময়। যেমন ওষুধ শিল্প, জুতা, চামড়া।কিন্তু দেখা যাচ্ছে ওষুধ শিল্পের রফতানি মাত্র শূন্য দশমিক ২শতাংশ। তাহলে কোন দিক থেকে এগুলো সম্ভাবনাময়?
যদিও ওষুধ শিল্প আমাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পুরোপুরিভাবে মেটাতে পারছে কিন্তু ওষুধ শিল্পের রফতানিতে খুব কষ্ট করেও ১০০ মিলিয়ন ডলারে যেতে পারেনি। আমাদের ৫ বিলিয়ন, ১০ বিলিয়ন ডলারে যেতে হবে। সে ধরনের রফতানি পণ্য দেখতে হবে। এক্ষেত্রে ভালো একটি পণ্য হতে পারে পাট ও পাটজাত পণ্য। পাটের নতুন একটি বাজার দেখছি, সেটি হলো গাড়ির দরজার ফেব্রিক। এগুলো এখন পাট দিয়ে তৈরি হচ্ছে। আমরা পাটকে ঠিকমতো সাপোর্ট করিনি। কারণ এক্ষেত্রে কোনো গবেষণা হচ্ছে না। গবেষণা হলে কমার্শিয়াল গবেষণা হতে হবে। ব্যবসায়িকভাবে এর বাজার আছে কিনা, সেটি নিয়ে গবেষণা করতে হবে। এখন কিছু উদ্ভাবন হচ্ছে। যেমন পাটের ব্যাগ। প্লাস্টিক ব্যাগের স্থলে পাটের ব্যাগ প্রতিস্থাপন করতে হবে। এটি করলে পাটের আন্তর্জাতিক বাজার অবারিত হবে।
এবার জুতা শিল্পের প্রসঙ্গে আসা যাক। জুতা একেবারে পোশাক শিল্পের মতো; একই ধাঁচের। পোশাকের মতো এটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে। জুতার বড় বড় কোম্পানি আছে। যেমন নাইকি, এডিডাস, নিউ ব্যালান্স, পুমা, রিবক প্রভৃতি। এদের কারো ফ্যাক্টরি নেই। তারা সব বড় কোম্পানি। এরা ডিজাইন করে। তারপর তারা চীন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভারত প্রভৃতি জায়গায় জুতা তৈরি করে। বাংলাদেশে খুব একটা আসে না। এখানে নাইকি কিছু জুতা তৈরি করে রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে। ছোটখাটো কিছু কোম্পানি আছে এখানে। কিন্তু জুতা আমাদের পোশাক শিল্পের মতো। বিশেষ করে নন-লেদার ফুটওয়্যার। আজকাল এটি ফ্যাশন হয়ে গেছে। সবাই এ জুতা পরছে। কিন্তু বড় বড় কোম্পানি বাংলাদেশে আসতে চায় না।
আমার মনে হয়, বিদেশী বিনিয়োগকে আমরা স্বাগত (ওয়েলকাম) জানাই না। গত ১০ বছরে ভিয়েতনামে প্রতি বছর ১০-১২ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ নতুন বিনিয়োগ এসেছে। এমনকি কম্বোডিয়ায় পর্যন্ত ভালো বিনিয়োগ আসছে। অথচ আমাদের বিদেশী বিনিয়োগ এখনো ১-২ বিলিয়ন ডলারে আটকে আছে, তাও সম্পূর্ণ নতুন বিনিয়োগ নয়। কিছু বিদেশী প্রতিষ্ঠান মুনাফার ভিত্তিতে পুনর্বিনিয়োগ করে। সেটি হিসাব করলে দেখা যায়, প্রতি বছর আমাদের বিদেশী বিনিয়োগ ১ দশমিক ৫ বা ২ বিলিয়ন ডলারের মতো। আর তাদের ওখানে প্রতি বছর ৫-৭ শতাংশ করে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। ভিয়েতনামে সর্বশেষ বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ দেখলাম ১২ বিলিয়ন ডলার।
তাহলে আমরা কেন বলছি বাংলাদেশ বিদেশী বিনিয়োগের জন্য স্বর্গভূমি?
এটি কেবল মুখেই বলছি। কিন্তু কাজে প্রতিফলন হচ্ছে না। বিনিয়োগ না হওয়ার পেছনে কিছু কারণ আছে। এক. অবকাঠামোগত সমস্যা আছে। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক কারণেও বিনিয়োগ হয় না। বিশেষ করে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখলে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা আসে না। এখন দেশে এক রকম স্থিতিশীলতা আছে বটে। আবার অন্যদিক থেকে অস্থিতিশীলও। কারণ রাজনৈতিক ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ সমাধান না দেখলে তারা আসবে না। তারা বড় বিনিয়োগকারী। তারা সবকিছু হিসাব করে আসে। বিনিয়োগ করে এখান থেকে তারা কী রিটার্ন পাবে, সেটি হিসাব করেই আসে। তবে বাংলাদেশের রেকর্ড ভালো। যারা এসেছে তারা থেকেছে। কিন্তু আসাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
আশা করা হয়েছিল, আইসিটি সেক্টরে বড় বিদেশী বিনিয়োগ আসবে। এটা সত্য, আইসিটি অবকাঠামোয় আমাদের ঘাটতি রয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা, বিদেশীরা নীতি ঠিক আছে কিনা, সেটি দেখে। নীতিনির্ধারক কারা, নীতি সম্পর্কে তাদের বোঝাপড়া কেমন, তাও দেখে। তারপর সার্বিক আর্থরাজনৈতিক অবস্থা দেখে। দেখে এখানে গণ্ডগোল হবে কিনা। আবার রানা প্লাজা, হলি আর্টিজান এসব ঘটনাও দেখে। এগুলোর নেতিবাচক প্রচার অনেক বেশি হয়। আমাদের ওপর এসব ঘটনার আঘাত এখনো আছে। এসব দিক থেকে ভিয়েতনাম এগিয়ে। ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধ করল। অথচ সেখানকার বাজার ভিয়েতনামি পণ্যে সয়লাব। জুতা, পোশাক সবই এখন মেড ইন ভিয়েতনাম। আমরা বলি, বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পোশাক রফতানিকারক। এখন ভিয়েতনাম এগিয়ে গেছে। ভিয়েতনামের চেয়ে আমাদের রফতানির পরিমাণ কম। বাংলাদেশ যেখানে ২০১৭ সালে ৩০ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে, সেখানে ভিয়েতনাম ৩২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। কাজেই ভিয়েতনাম আমাদের ধরে ফেলছে।
ভিয়েতনাম কী নীতি নিল, যে কারণে তারা আমাদের তুলনায় এগিয়ে গেল?
পোশাক খাতে একটি বড় নীতি হচ্ছে বিদেশী বিনিয়োগ। বিদেশী বিনিয়োগ কেন? বিদেশী বিনিয়োগ শুধু পুঁজি আনে না, প্রযুক্তি আনে। সবচেয়ে বড় কথা, এটি বাজারের সুযোগ আনে। আমাদের দৌড়ঝাঁপ করতে হবে না, তারা এসে বলবে, আমার এত বিলিয়ন শার্ট চাই। ইউরোপে, লাতিন আমেরিকায় আমার বাজার আছে, তুমি সেখানে সরবরাহ করো। আর কিছু করতে হচ্ছে না। শুধু প্রস্তুত করতে হচ্ছে। ফলে স্থানীয় লোকজনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে। এটাই তাদের এগিয়ে যাওয়ার রহস্য।
কিন্তু আমাদের পোশাক খাতে বিদেশী বিনিয়োগের অনুমতি দেয়া হয় না!
২০০৪ সাল পর্যন্ত আইনি নিষেধাজ্ঞা ছিল। এখন অনুমতি দিচ্ছে। কিন্তু নানা বাধা রয়েছে। তবে ভারতীয় কিছু ব্যবসায়ী এসব বাধা পাশ কাটিয়ে যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশের পোশাক খাতে আসছেন। আমাদের প্রধান শিল্পে বিদেশী বিনিয়োগ বাধা দিলে অন্য খাতে তা আসাটা কঠিন হবে।
বাণিজ্য বৃদ্ধিতে আপনার পরামর্শ কী?
বাণিজ্যে আমাদের নীতি সামঞ্জস্যহীনতা দূর করতে হবে। এখানে প্রচুর স্ববিরোধিতা আছে। আমরা বলছি, রফতানি করতে চাই। কিন্তু করছি ঠিক উল্টোটা। রফতানির পরিবর্তে অভ্যন্তরীণ বাজারের জন্য প্রস্তুত ও পণ্য বিক্রি প্রশ্রয় দিচ্ছি বেশি। এটি নীতির বড় স্ববিরোধিতা। এটা পাল্টাতে না পারলে আমরা শিল্পায়ন ত্বরান্বিত করতে পারব না। অভ্যন্তরীণ বড় বাজার সত্ত্বেও চীন ২৫ বছর ধরে রফতানির ওপর ভর করে প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হয়েছে। ভারত ৫০ বছরের জন্য একটি নীতি নিয়েছিল। তারা দেখল সেটি ভুল। মানে অভ্যন্তরীণ বাজারের ওপর ভরসা করা যায় না। পরে সেটি তারা পরিবর্তন করল। তারা পারলে আমরা কেন পারব না? আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজার যত বড়ই হোক না কেন বিশ্ববাজারের তুলনায় এটি অতি নগণ্য।