২০১৫ সাল রাজনৈতিকভাবে মোটামুটি শান্তই ছিল। প্রথম তিন মাসের পর থেকে অন্তত রাস্তায় সংঘাত-সংঘর্ষ হয়নি। ফলে বিনিয়োগ বাড়ার অনুকূল পরিবেশ ছিল। আমরাও আশা করেছিলাম, বিনিয়োগ বাড়বে। কিন্তু বিনিয়োগ বাড়েনি। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ চাহিদার ক্ষেত্রেও মন্দাভাব রয়েছে। ১২ বছর ধরে আমাদের প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের কোঠায় রয়েছে, ২০১৫ সালে এই অবস্থার উত্তরণ ঘটবে কি না সন্দেহ আছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এখন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ গত বছরের একই সময়ের তুলনায় কম, এমনকি এবার রেমিট্যান্সের প্রবাহও কম। মনে রাখা দরকার, রেমিট্যান্স অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির অন্যতম অনুঘটক। আমাদের আমদানি বৃদ্ধির হারও মূল্যের সাপেক্ষে ঋণাত্মক। এর একটা কারণ বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমে যাওয়া। সার্বিকভাবে আমদানির প্রকৃত পরিমাণে (Volume) ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি থাকলেও তা হয়তো এক অঙ্কের ঘরে, দুই অঙ্কের নয়। ওদিকে এবার রাজস্ব আহরণের অবস্থাও ভালো নয়। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, অর্থনীতির সব সূচকেই এবার আমরা পিছিয়ে আছি। অথচ আশা করেছিলাম, এ বছর প্রবৃদ্ধি অন্তত ৭ শতাংশের ঘরে পৌঁছাবে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে বিনিয়োগ বাড়াতে সরকার আগামী বছর কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে পারে। প্রথমত, বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে সহায়তা দেওয়ার জন্য সুদের হার আরও কমাতে পারলে ভালো। এর জন্য প্রথমত মূল্যস্ফীতি আরও কমাতে হবে, দ্বিতীয়ত ঋণ ও আমানতের সুদের হারের স্প্রেড কমিয়ে সাড়ে ৩ শতাংশে নামাতে হবে, যা বর্তমানে ৫ শতাংশ। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগামী দুই বছরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৪ শতাংশে নামিয়ে আনবে বলে লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছে। আমাদেরও সে রকম একটা দৃঢ় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। কারণ মূল্যস্ফীতি কমাতে না পারলে সুদের হার কমানো যাবে না। আমানতকারীদের গড়ে অন্তত ১ শতাংশ প্রকৃত সুদ দিতে হবে। এই ধাপগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে ঋণের সুদের হার এক অঙ্কের ঘরে নামানো সম্ভব হবে, আমাদের ব্যবসায়ীরা যেটা এত দিন ধরে দাবি করে আসছেন এবং সংগত কারণেই।
তবে কাজটি সহজ নয়। কারণ স্প্রেড কমাতে হলে ঋণের গুণগত মান বাড়ানোর বিকল্প নেই। একটি প্রতিবেদনে দেখলাম, সৌদি আরবের লোন-লসের হার মাত্র ১ দশমিক ২ শতাংশ, যেখানে আমাদের বেসরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে এই হার ৮-৯ শতাংশ, আর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ক্ষেত্রে তা ৩০ শতাংশেরও বেশি। আবার এটাও প্রকৃত হিসাব নয়, কারণ এটা নির্ভর করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত মানদণ্ডের ওপর, যা অনেক ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক মানের চেয়ে কিছুটা সহজ। এই মন্দ ঋণের হার না কমালে সুদের স্প্রেডও কমানো যাবে না। অর্থাৎ স্প্রেড সাড়ে ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা গেলে ঋণের সুদের হার সাড়ে ৮ শতাংশ নির্ধারণ করা সম্ভব হবে। আর সামষ্টিক অর্থনীতি যদি স্থিতিশীল থাকে, তাহলে এই হারও স্থিতিশীল থাকবে।
বিনিয়োগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে পুঁজিবাজারও বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে আমি নিঃসন্দেহে ফাটকাবাজির পুঁজিবাজারের কথা বলছি না। সরকার পুঁজিবাজারে যাওয়ার জন্য প্রণোদনা হিসেবে ১০ শতাংশ কর ছাড় দিলেও ভালো কোম্পানিগুলো এখনো সেখানে যাচ্ছে না। এই বাজার যদি স্থিতিশীল থাকে, তাহলে সেখান থেকে ভালো উদ্যোক্তা বেরিয়ে আসতে পারে। এ বিষয়ে সরকারকে আরেকটু উদ্যোগ নিতে হবে। ২০০৯-১০ সালে পুঁজিবাজার ধসের পর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার হয়েছে, কিন্তু তারপরও ভালো ভালো দেশি কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়নি। ফলে দেখা যাচ্ছে, শেয়ারের দাম উঠছে না, বরং আরও পড়ে যাচ্ছে। ফলে বিনিয়োগকারীরা জামানত হারাচ্ছেন। ভালো কোম্পানি বাজারে না এলে পুঁজিবাজার সুনাম অর্জন করতে পারবে না। ফলে আমাদের অর্থনীতি এখনো ব্যাংক–নির্ভর রয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ পুঁজি সংগ্রহের উৎস হিসেবে আমরা পুঁজিবাজারকে ব্যবহার করতে পারছি না।
ওদিকে টাকার মূল্য বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানিকারকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। একদিকে পৃথিবীর প্রায় সব দেশই মার্কিন ডলারের বিপক্ষে তাদের মুদ্রার মান কমাচ্ছে, অন্যদিকে যেসব দেশের সঙ্গে আমরা ব্যবসা করি, তাদের তুলনায় আমাদের মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি। ফলে আমরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাচ্ছি। তাই আগামী বছর সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক কিছুটা হলেও টাকার অবমূল্যায়ন করতে পারে। তা করা হলে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে দেশীয় উদ্যোক্তারা যে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন, সেটা কমিয়ে আনা যাবে। আরেকটি বিষয় হলো, আমাদের রিজার্ভের পরিমাণ যথেষ্ট। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক বিনিময় বাজার কিছুটা উদারীকরণ করতে পারে, চীন বা ভারতের মতো। যাতে কিছু কিছু উদ্যোক্তা চাইলে বিদেশেও বিনিয়োগ করতে পারে। ভারত ও চীনে রপ্তানিকারকেরা শতভাগ বৈদেশিক মুদ্রা নিজের ব্যাংকে রাখতে পারে। আমাদের দেশেও এই ব্যবস্থা ধাপে ধাপে উদারীকরণ করা যেতে পারে। এর ফলে বাংলাদেশ ব্যাংককে আর বাধ্যতামূলকভাবে ডলার কিনতে হবে না, দেশীয় ব্যাংকগুলোও ডলার লেনদেনের ও ঋণ প্রদানের সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে। এক ডলার কেনার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ৭৮ টাকা খরচ করতে হয়, এরপর আবার মুদ্রা বাজারের তারল্য কমানোর জন্য বন্ড ছাড়তে হয়। এর তো একটা খরচ আছে, যার পরিমাণ বড় অঙ্কের হতে পারে। সে কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এককভাবে এই দায়িত্ব নেওয়ার দরকার নেই। চীনের পরিবেশ আরেকটু উদার, সে দেশের রপ্তানিকারকেরা পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় তাঁদের বৈদেশিক মুদ্রা রাখতে পারেন। তাঁদের শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে হয়, টাকাটা কোথায় আছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরেকটি উদ্যোগ নিতে পারে। তাদের কাছে যদি ছয় মাসের অধিক প্রয়োজনীয় রিজার্ভ থাকে, তাহলে তারা সেই অতিরিক্ত অংশকে সার্বভৌম তহবিলে (Sovereign Fund) রূপান্তরিত করতে পারে। এই সম্পদ কেন্দ্রীয় ব্যাংক পদ্মা সেতুর মতো বড় ও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে পারে। এখন তারা বিদেশে বিনিয়োগ করলে শূন্য দশমিক ৫ বা ১ শতাংশেরও কম সুদ পায়, আর এটা করলে তারা অন্তত ৪-৫ শতাংশ সুদ পেতে পারে। এর মাধ্যমে বড় প্রকল্পে বিদেশি তহবিল-নির্ভরতাও কমানো যাবে।
যেহেতু সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে এখন একটু মন্দাভাব রয়েছে, সেহেতু সরকার যদি এখন একটু ধাক্কা দেয়, তাহলে তা চাঙা হতে পারে। এর জন্য সরকারকে এখন অবকাঠামো খাতে বড় বিনিয়োগ করতে হবে। আমাদের বড় বড় অবকাঠামোর প্রচণ্ড অভাব রয়েছে। অর্থনীতির গতি বাড়াতে রাস্তাঘাট, সেতু, সমুদ্র ও নদীবন্দর, বিমানবন্দর ইত্যাদির মানোন্নয়ন করতে হবে। নতুন নতুন রাস্তাঘাট বানাতে হবে। বিদ্যুৎ খাতেই আগামী দেড় দশকে ৬০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। একটি বিষয় আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, সরকার পারলে আগামী বাজেটেই যেন ২ শতাংশ ঘাটতি বাড়িয়ে দেয়। এতে প্রতিবছর চার বিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পদ আসবে, আর আগামী পাঁচ বছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে তার পরিমাণ হবে ২৫ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্বৃত্ত রিজার্ভ থেকে যদি আগামী পাঁচ বছরে সার্বভৌম তহবিল হিসেবে ১০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল গঠন করা যায়, তাহলে অবকাঠামো খাতে সর্বমোট অতিরিক্ত বিনিয়োগের পরিমাণ হবে ৩৫ বিলিয়ন ডলার। এই অর্থ দিয়ে অনেক রাস্তাঘাট ও অবকাঠামো নির্মাণ করা সম্ভব। আমি বলতে চাই, অর্থের সম্ভাব্য জোগান তো আমাদের আছে, একটু সৃজনশীলভাবে ও দক্ষতার সঙ্গে তা বিনিয়োগ করতে হবে।
২০০৯ সালে দেশে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করার লক্ষ্যে আইন হয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত একটি অঞ্চলও নির্মাণ করা হয়নি। ঘোষণাটা দেরিতে এলেও এটা প্রশংসনীয় যে প্রধানমন্ত্রী ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন। সরকারের হাতে অনেক খাসজমি আছে, সেখানে এগুলো নির্মাণ করা যেতে পারে। সরকারকে শুধু অবকাঠামো করে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে উল্লিখিত খাতের বিনিয়োগযোগ্য অর্থও ব্যয় করা যেতে পারে। এগুলো সবই এখন পর্যন্ত পরিকল্পনার আকারেই রয়েছে, ধীরে ধীরে এগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। যোগাযোগ ও আঞ্চলিক বাণিজ্যও অর্থনীতিকে চাঙা কারার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। ভারতের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ বাড়ছে, তাদের আমরা ট্রানজিট দিতে চাচ্ছি, এতে আমরা একদিকে তাদের কাছ থেকে মাশুল পাব, অন্যদিকে ভারত, নেপাল ও ভুটানে আমাদের রপ্তানি বাড়াতে পারি। বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমারের যে যৌথ উদ্যোগ নিয়েছে—বিসিআইএম ইনিশিয়েটিভ, সেখান থেকেও আমরা অনেক কিছু অর্জন করতে পারি। তবে এর জন্য আঞ্চলিক যোগাযোগব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে, যার পূর্বশর্ত অবকাঠামো নির্মাণ।
আরেকটি বিষয় হলো, বিশ্ব বাণিজ্যে যে বড় বড় জোট হচ্ছে, সেই ধারা থেকে বাংলাদেশ চিরকাল বাইরে থাকতে পারে না। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দোহা রাউন্ড প্রায় থমকে আছে, যার কারণে আঞ্চলিক বাণিজ্য ব্যবস্থা দ্রুত বাড়ছে। এ মুহূর্তে বিশ্ব বাণিজ্যের বড় বড় বহুপক্ষীয় জোট যেমন, টিপিপি ও আসিয়ানে যোগদানের সক্ষমতা আমাদের নেই। কিন্তু আমাদের আঞ্চলিক ও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের দিকে অবশ্যই যেতে হবে, তবে ধাপে ধাপে। প্রতিটি দেশই নিজের মতো করে জোট বা চুক্তি করছে, আমাদের পিছিয়ে থাকলে চলবে না। আগামী ১০ বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। আমরা দরিদ্র দেশ হিসেবে যেসব বাণিজ্যিক সুবিধা পাচ্ছি, তারপর থেকে ক্রমেই তা হারাব। তাই এখনই প্রস্তুতি শুরু করতে হবে, যাতে ১০ বছরের মধ্যে কয়েকটি বড় আঞ্চলিক জোটের সক্রিয় সদস্য হতে পারি।
শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমাদের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে, এটা সত্য। এর সঙ্গে সরকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে আমাদের অর্থনীতির বড় রকমের ঊর্ধ্বমুখী অগ্রযাত্রা শুরু হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। আমরা সে দিনের প্রতীক্ষায় আছি।