রাষ্ট্রীয় খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের বাড়তি সংখ্যা এবং পরপর দুটি বড় অঙ্কের অর্থ চুরি (সোনালী ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংক) ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, ব্যাংক পরিচালনায় সুশাসনের বড় অভাব রয়েছে। এসব কারণে ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্য নিয়ে সরকার চিন্তিত। বর্তমানে বাজেট থেকে বরাদ্দ দিতে হচ্ছে মূলধন কমে যাওয়ার কারণে। এ অবস্থায় রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তা আদৌ রয়েছে কি না, সেটা ভেবে দেখার সময় এসেছে। সরকারের ট্রেজারি কার্য সম্পাদনে সর্বোচ্চ একটি ব্যাংক রেখে অন্যগুলো বেসরকারি খাতে দেওয়ার উপযোগ্যতা যাচাই করা যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ভাইস চেয়ারম্যান ড. সাদিক আহমেদ সকালের খবরকে এক সাক্ষাত্কারে এসব কথা বলেন। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক আসাদুল্লাহিল গালিব।
সকালের খবর: বৈদেশিক মুদ্রার অবস্থা কীভাবে দেখছেন?
ড. সাদিক আহমেদ: বাংলাদেশ ব্যাংক ২২ বিলিয়ন ডলারের ওপরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অর্জন করেছে। এটি একটি ভালো দিক। তবে আমদানি কমে যদি রিজার্ভ বাড়ে তাহলে সেটি চিন্তার বিষয়। দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সে জন্য ক্যাপিটাল এবং মেশিনারি আমদানি বেড়ে যাবে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমাতে বাংলাদেশের সুবিধা হয়েছে। তাছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে ভালো বিনিয়োগকারীদের বিদেশি ঋণ গ্রহণের সুযোগ তৈরি করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইতিবাচক দিক। তবে বিদেশি ঋণের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। কেউ যদি বৈদেশিক মুদ্রায় অর্থ নিয়ে অন্য কাজে ব্যবহার করে সেটা ঠিক হবে না। ঋণের অর্থ সঠিক খাতে ব্যবহার নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম বাড়াতে হবে।
সকালের খবর : ব্যাংকিং খাতে কী কী চ্যালেঞ্জ রয়েছে?
ড. সাদিক আহমেদ : ব্যাংকিং খাতে অনেক উন্নতি হয়েছে, যেটা বেসরকারি বিনিয়োগকে ভালো সহায়তা করেছে। তবে এখন কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের সংখ্যা বাড়ছে। সোনালী ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংকে পরপর দুটি বড় আকারের চুরি হওয়াতে এসব ব্যাংকের পরিচালনা এবং আর্থিক টেকসই থাকার সম্ভাবনা নিয়ে প্রচুর প্রশ্ন উঠেছে। বাজেট থেকে টাকা দিয়ে ব্যাংক চালানো মোটেই যুক্তিযুক্ত নয়। অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকের মুনাফা কমে গেছে এবং খেলাপি ঋণের সংখ্যা বেড়েছে।
এসব চ্যালেঞ্জকে শক্তভাবে মোকাবেলা করতে হবে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক বেসরকারি ব্যাংকের সুপারভিশন কার্যক্রম বাড়ানোর ওপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছে। ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় দ্বৈততা রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি সব ব্যাংক দেখ-ভালের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেওয়া উচিত। ব্যাংকগুলোকে ঋণঝুঁকি বিবেচনাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। ব্যাংকিং নিয়মাচার ব্যতীত কোনো ঋণ অনুমোদন দেওয়া ঠিক হবে না। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও দীর্ঘমেয়াদে চিন্তা-ভাবনার সময় এসেছে। সরকারের ট্রেজারি কার্য সম্পাদনে সর্বোচ্চ একটি ব্যাংক রেখে অন্যগুলো বেসরকারি খাতে দেওয়ার উপযোগ্যতা যাচাই করা যেতে পারে।
সকালের খবর : বিনিয়োগ কীভাবে বাড়ানো যেতে পারে?
ড. সাদিক আহমেদ : বিনিয়োগের দুটো দিক; এক. সরকারি বিনিয়োগ এবং দুই. বেসরকারি বিনিয়োগ। উন্নয়নশীল দেশের জন্য বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ হল অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। আর বাংলাদেশে শতকরা ৯০ ভাগের বেশি অর্থনীতি বেসরকারি খাতকেন্দ্রিক। তবে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ চাঙ্গা করতে সরকারি পর্যায়ে কিছু উদ্যোগ নিতে হয়। বিদ্যুত্, গ্যাস, রাস্তাঘাট ইত্যাদি উন্নয়নে মূলত সরকারকে বিনিয়োগ করতে হয়। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্য, শিক্ষা খাত, সামাজিক সুরক্ষার প্রোগ্রাম বাস্তবায়নেও সরকারকে বিনিয়োগ করতে হবে—যা বেসরকারি বিনিয়োগকে উত্সাহিত করে।
একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করতে হলে গ্যাস-বিদ্যুত্ অবশ্যই প্রয়োজন। বিনিয়োগ বাড়াতে সরকারি ও বেসরকারি খাতে একটি সমন্বয় প্রয়োজন। তা না হলে উন্নয়ন নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়বে। উদাহরণস্বরূপ আগে শতকরা ৮৫ ভাগ বিদ্যুত্ উত্পাদন হতো গ্যাস দিয়ে, এখন গ্যাসের স্বল্পতায় সেটা ৬৫ ভাগে নেমে গেছে। ভবিষ্যতে আরও কমবে। এ পরিস্থিতিতে বিদ্যুত্ উত্পাদন বৃদ্ধি সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। বিদ্যুত্ উত্পাদনে কয়লাভিত্তিক প্রকল্প গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কয়লা উত্তোলনে এখনও কোনো নীতিমালা করা হয়নি। আমদানি করে কয়লা আনা ব্যয়সাপেক্ষ ও দুরূহ ব্যাপার। বিদেশ থেকে কয়লা আনতে হলে ভালো মানের বন্দর এবং ট্রেন যোগাযোগ প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের সেই অবকাঠামো নেই। সুতরাং অবকাঠামোগত বিষয়গুলোকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে হবে।
এ পর্যন্ত জিডিপির ২৬ শতাংশ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়েছে। এর মধ্যে বেসরকারি পর্যায়ে হয়েছে ২০ শতাংশ আর বাকিটা সরকারি বিনিয়োগ। তবে বেসরকারি বিনিয়োগ আরও বাড়ানো দরকার। কিন্তু কীভাবে বাড়ানো যায় সেটা নিয়ে বিশদ পরিকল্পনার প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে নতুন বিনিয়োগ বাড়াতে অগ্রাধিকারমূলক কিছু খাত উন্নত করতে হবে। তার মধ্যে রয়েছে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন। পরিবহন ব্যবস্থা, জ্বালানি ও বিদ্যুত্ খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। গত পাঁচ বছরে বেশকিছু কাজ হয়েছে, তবে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগের জন্য আরও জোর দেওয়া উচিত।
দেশে কারখানা স্থাপনে যে ধরনের শিল্পজমি প্রয়োজন তা পাওয়া যায় না। রফতানি উন্নয়ন জোন থেকে বারবার তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু জমি মিলছে না। উত্পাদনশীল খাতে নতুন বিনিয়োগ বাড়াতে হলে জমি খুবই দরকারি উপাদান। আমাদের দেশে জমি নিয়ে অনেক রাজনীতি হয়ে থাকে। সরকারি জমি বরাদ্দেও সমস্যা রয়েছে। সরকার যেসব এলাকায় অর্থনৈতিক জোন করার ঘোষণা দিয়েছে, তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা দরকার। দেশের বাইরে থেকেও অনেক বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনা রয়েছে, কিন্তু ভূমি জটিলতায় বেশ সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এসব বিষয়ে দ্রুত ও কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি।
অবকাঠামো ভিত্তিক বড় প্রকল্প দেশীয় অর্থায়নে না করাই ভালো। এগুলো আন্তর্জাতিক দরপত্র গ্রহণের মাধ্যমে সম্পন্ন করাই শ্রেয়। এতে কে কন্ট্রাক্ট পেল আর কে পেল না, তা নিয়ে কোনো ঝামেলা থাকে না। বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা যেমন- বিশ্বব্যাংক, জাইকা, এডিবির মতো সংগঠনগুলোকে আহ্বান জানানো যেতে পারে। নির্মাণ মান ও ব্যয় ঠিক আছে কি না, সেটা বিচার-বিশ্লেষণের দায়িত্বে থাকবেন আমাদের দেশীয় প্রকৌশলীরা।
উন্নয়নে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা জরুরি। বিনিয়োগের পরিবেশ গড়ে না উঠলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। দেশে যে হারে বিনিয়োগ বাড়ার দরকার ছিল সেটাতে ঘাটতি রয়েছে। বিনিয়োগ বাড়লে আমদানি বাড়বে। সম্প্রতি মূলধনী যন্ত্রপাতি বিশেষ করে টেক্সটাইল খাতে আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক। দেশের খাদ্য উত্পাদন অনেক বেড়েছে। প্রতিবছর যে পরিমাণ চাল উত্পাদন হচ্ছে, তাতে চাল রফতানির সক্ষমতা বাংলাদেশ অর্জন করতে পেরেছে। একই সঙ্গে কৃষি, মত্স্য, পশু পালনে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
সকালের খবর : সরকারি কর্মচারীদের নতুন পে-স্কেল সম্বন্ধে আপনার কী মন্তব্য?
ড. সাদিক আহমেদ: আমি মনে করি পে-স্কেল বাড়ানো যুক্তিযুক্ত। কারণ সরকারি কর্মচারীদের ভাতার মান বেশ কম। তবে সরকারকে তিনটি বিষয়ের ওপর নজর দিতে হবে। এক. সরকারি কর্মচারীদের যোগ্যতা ও দক্ষতার দিকে নজর দিতে হবে। দুই. সব খাতেই সরকারি ব্যয়ের মান উন্নত করতে হবে। তিন. রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। পে-স্কেল বাড়ানোর ফলে সরকারের ঘাটতি যেন বেড়ে না যায় এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারকে যাতে ঋণ নিতে না হয় সে দিকে নজর দিতে হবে। তা না হলে মুদ্রাস্ফীতির ওপর আঘাত পড়বে।