চলমান সংকট ও উত্তরণের পথ

চলমান সংকট ও উত্তরণের পথ

সাম্প্রতিক সময়ে বড় দুটি দুর্ঘটনা এবং তদপরবর্তী আন্তর্জাতিক চাপে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের

সম্ভাবনা বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত দুই বা আড়াই দশকে আমরা যা অর্জন করেছি এবং যে দক্ষতার সঙ্গে আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম, তাতে ২০২২ সাল নাগাদ এ শিল্প ৫০ বিলিয়ন ডলারের একটি খাতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হচ্ছিল। ম্যাকেঞ্জির রিপোর্টে বিষয়টি আলোচনা করা হয়েছে। সম্প্রতি পোশাকশিল্পের নেতিবাচক কিছু দিক ফুটে উঠছে। এগুলো সুষ্ঠুভাবে মোকাবেলা করা না গেলে সমূহ বিপদ আসতে পারে। এর অনেকগুলো স্বল্পসময়ে সমাধান করা সম্ভব। কিছু সমস্যা সমাধানে মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন প্রয়োজন।

স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনায় ন্যূনতম মজুরির দিকে নজর দিতে হবে। বেঁচে থাকার মতো ন্যূনতম মুজরির ব্যবস্থা করা, যাতে গার্মেন্টকর্মীরা তাদের ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে পারে। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পকে যেভাবে “slave labor industry” বা “sweat shop industry” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, তা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে আইনগত বাস্তবায়ন পুরোপুরি নির্ভর করছে সরকার ও গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর ওপর। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটিই একমাত্র সমস্যা নয়। গার্মেন্ট খাতের সঙ্গে অন্য অনেক বিষয় যুক্ত। বাংলাদেশে এ শিল্প স্বতঃস্ফূর্ত ও বিশৃঙ্খলভাবে গড়ে উঠেছে। শুরুর দিকে এখানে সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ ছিল না। এটা একদিকে ভালো। আবার এর খারাপ দিক হচ্ছে, উপর্যুপরি দুর্ঘটনার শিকার হওয়া। সরকারের নিষ্পৃহতার খেসারত এখন দিতে হতে পারে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। এটা ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপারও।

গত দুই দশকে গার্মেন্ট খাতের বিস্তৃতি ঘটেছে ব্যাপক হারে।। কিন্তু এ কারখানাগুলো সরকারি নীতিমালা বা তার প্রয়োজনের অভাবে যেখানে-সেখানে গজিয়ে উঠেছে। এভাবে কোনো শিল্প  খাত সৃষ্টি হয় না। হওয়া উচিতও নয়। কিন্তু আমাদের দেশে সেটা হয়েছে। নির্মাণবিধি না মেনে নিচে দোকান ও অফিস আর ওপরে কারখানা— এভাবে শিল্প গড়ে ওঠে না। আশুলিয়ায় ও সাভারে এভাবেই চলছে অনেক কারখানা। এ ধরনের গার্মেন্টের সংখ্যা হাজারের ওপরে কিংবা আরো বেশি হতে পারে। এভাবে ঝুঁকি নিয়ে চলতে থাকলে আরো দুর্ঘটনা ঘটার শঙ্কা থেকেই যায়। সম্প্রতি আইএলও প্রধান ঢাকায় এসে বলেছিলেন, বাংলাদেশে শিল্প অবকাঠামো ব্যবস্থা দুর্বল এবং যেকোনো সময় রানা প্লাজার মতো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এ কারণে আমাদের সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে স্বল্পমেয়াদি কিছু ব্যবস্থা রয়েছে। যেমন— উদ্ধারকাজ দ্রুত সম্পন্ন করা, অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থাপনা রাখা, বহুতল ভবন ভেঙে পড়লে করণীয় সম্পর্কে প্রস্তুতি থাকা, বেশি মানুষকে বাঁচানোর দক্ষতা অর্জন, বিদেশী প্রশিক্ষণ প্রভৃতি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। শ্রমিককে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি অবকাঠামোগত সুবিধা বাড়াতে হবে। অবকাঠামোগত সুবিধা বলতে Fire exit-এর সিঁড়ি প্রশস্ত করা, সিঁড়ির আশপাশে মেশিনারি না রাখা। ন্যূনতম এসব আবশ্যক বিষয় বাস্তবায়নে খুব একটা সময় লাগবে না। এগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা অনেকাংশে কমে যাবে। দুর্ঘটনায় আহত হওয়া বা অঙ্গহানির ঘটনাও কমে আসবে এতে।

এছাড়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বোঝাতে হবে সমস্যা সমাধানে আমরা মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কাজ করছি। সে জন্য দরকার ভালো একটি রূপরেখা বা পরিকল্পনা। এটি করা গেলে গার্মেন্টশিল্প আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হবে দ্রুত। এটা এক বা দুই বছরেই করা সম্ভব না হতে পারে। পাঁচ বছরও লাগতে পারে। মনে রাখতে হবে, এটি রফতানিমুখী শিল্প, দেশের আর দশটি শিল্পের মতো নয়। এর গ্রাহক বিদেশী, পরিদর্শকও বিদেশী। তারা এ ব্যাপারে খুবই সচেতন। সব বিষয় চিন্তা করেই আমাদের উন্নততর ব্যবস্থায় নিয়ে যেতে হবে এ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো।

নীতিনির্ধারকরা চাইলে শিল্প-রাজনীতি ভালো করা কঠিন নয়। আমরা জাতি হিসেবে অনেক অনিয়মই মেনে নিই নিয়মিতভাবে; কিন্তু বিদেশীরা তা মানবে না। বিদেশে পণ্য বিক্রি করতে হলে এ ধরনের ব্যাপক অনিয়ম করা যাবে না। ঠিক যেমন বিদেশে আম বিক্রি করতে গেলে তাতে ফরমালিন মেশানো যাবে না। নইলে সেটা সঙ্গে সঙ্গে ফেরত চলে আসবে। দেশের ক্রেতাকে হয়তো কোনোভাবে ফাঁকি দিয়ে পণ্য কেনানো যাবে; কিন্তু বিদেশীদের বেলায় তা করা যাবে না। ২০ বছর আগে ভবনের ছাদে কারখানা করা গেলেও এখন তা করা যাবে না। কারণ তখন খাতটির আয়তন ছিল খুবই ছোট। এখনকার মতো বড় বড় খুচরা ক্রেতাকে পণ্য সরবরাহ করা হতো না। বিশ্ববাজারে আমাদের বিশেষ বড় অবস্থান এবং যে ধরনের বড় বড় বহুজাতিক ক্রেতা নিয়ে কাজ করছি, সেটি আগে করতে পারতাম না আমরা। প্রাথমিক পর্যায়ে বেশির ভাগ কাজ করা হতো অন্যান্য দেশের বায়িং হাউসের কাছ থেকে সাব-কন্ট্রাক্টের ভিত্তিতে। সে পর্যায় থেকে আমাদের উত্তরণ ঘটেছে। এসব কারণে এ খাতে এখন বড় রকমের ট্রান্সফরমেশন ঘটাতে হবে।

সরকার এক্ষেত্রে বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। সম্প্রতি মন্ত্রিসভা একটি কমিটি গঠন করেছে এ শিল্পসংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে। ন্যূনতম মজুরি বোর্ড করা হয়েছে। শ্রমিকদের জীবনমান উন্নত করতে সরকার, বিজিএমইএ ও আইএলও একটি চুক্তিও করেছে। চুক্তিতে সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে প্রতিটি গার্মেন্টশিল্প ভবনের নিরাপত্তা, অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা উন্নত করা হবে। এটি বিজিএমইএরও প্রতিশ্রুতি। বিজিএমইএ জরুরি ভিত্তিতে কারখানাগুলোর কমপ্লায়েন্স অডিট করছে। আমরা আশা করব, এ অডিটের মান যেন ঠিক এবং নিরপেক্ষ থাকে। এখানে প্রভাব-প্রতিপত্তি যেন না দেখানো হয়। অর্থাৎ কারখানার অডিট হতে হবে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে।

এরই মধ্যে ইউরোপীয় ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খুচরা ক্রেতারাও (রিটেইলার) নিজ থেকে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। বড় ক্রেতারা বাংলাদেশের ভবননিরাপত্তা, অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ও কর্মক্ষেত্রের ব্যবস্থাপনা উন্নতকরণে একটি অঙ্গীকারনামায় (অ্যাকর্ড) স্বাক্ষর করেছে। ইউরোপীয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা দুটি পৃথক গ্রুপ করেছে নিজেদের মধ্যে। এর একটি প্রধান শর্ত হচ্ছে, যদি বাংলাদেশের পোশাক ইউরোপে বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যায়, তবে এ-সংক্রান্ত পৃথক পৃথক অ্যাকর্ডে স্বাক্ষর করতে হবে তাদের। নইলে তারা বাংলাদেশের পোশাক কিনবে না। আর স্বাক্ষর করলে অবশ্যই চুক্তি অনুযায়ী কমপ্লায়েন্স মানতে হবে। এ প্রস্তাবনার মাধ্যমে যদি কারখানার শ্রম পরিবেশ উন্নত হয় তবে একে অবশ্যই স্বাগত জানাতে হবে। ওয়ালমার্ট আবার নিজস্ব কমপ্লায়েন্স মানার কথা বলছে। আমাদের সমস্যা হচ্ছে, নিজেদের এ ধরনের আধুনিক কোনো আবশ্যক নীতিমালা নেই। ফলে বিদেশী ক্রেতাদের নীতিমালা মেনে নিতে হচ্ছে বা হবে আমাদের। উচিত হবে এমন নিয়মাবলি তৈরি করা, যার মাধ্যমে আমরা নিজেরাই দেশীয় নীতিমালার মাধ্যমে বিদেশী ক্রেতাদের আবশ্যক শর্তাবলিও পূরণ করতে পারি। তখন ক্রেতাদের বলা যাবে, তোমার শর্তাবলি নয়; মানতে হবে আমাদের দেশীয় উন্নতমানের শর্তাবলি। এ কারণে জাতীয় পর্যায়ে সমন্বয় প্রয়োজন। একেক কোম্পানির জন্য একেক ধরনের কমপ্লায়েন্স প্রত্যাশিতও নয়। ভবনের নিরাপত্তা ও অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা উন্নত করে বলতে হবে— এটা হচ্ছে আমাদের জাতীয় স্ট্যান্ডার্ড। এখানে সরকারের উদ্যোগ প্রয়োজন। সে স্ট্যান্ডার্ড মানতে সবাইকে উত্সাহিত ও বাধ্য করতে হবে। এটা অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানের হতে হবে। নইলে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের হারাতে হবে।

বর্তমানে প্রায় এক-দেড় হাজার কারখানার সামগ্রিক অবস্থা ভালো। সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। তবে এদের বেশির ভাগই সাব-কন্ট্রাক্টেও কাজ করে। দুর্ঘটনাগুলো কিন্তু বেশি ঘটছে এসব সাব-কন্ট্র্যাক্ট কারখানায়। এগুলোকে নতুন করে চিহ্নিত করে উন্নত করতে হবে। যারা শর্ত বা আইন মানবে না, তাদের কারখানা বন্ধ করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে খরচেরও বিষয় রয়েছে। এর তাত্ক্ষণিক কোনো সমাধান নেই। জায়গা লাগবে, ভবন নির্মাণ করতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন স্বল্পমেয়াদি কিছু কাজ করা যেতে পারে। ভবনধস রোধে বুয়েট বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী দিয়ে জরুরি ভিত্তিতে সমস্যার সাময়িক সমাধান করা যেতে পারে। সাময়িকভাবে সমাধান করা না গেলে বিরাটসংখ্যক মানুষ বেকার হয়ে পড়বে। রফতানিতে বিরাট নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এতে। তবে মনে রাখতে হবে, এটা স্থায়ী সমাধান নয়।

একই সঙ্গে আমাদের ভাবমূর্তি উদ্ধার এবং পুরনো গ্রাহক ফিরে পেতে হবে। এ খাতে নতুন আরো গ্রাহক আসবে বলে প্রত্যাশা। অনেক ক্রেতা চীন থেকে অন্য দেশে চলে যাচ্ছে, আমাদের দেশের প্রতি তাদের আকৃষ্ট করতে নিতে হবে উদ্যোগ। পোশাকশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, শ্রমিক সংগঠন, আইনজীবী, বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান— সবাইকে নিয়ে সম্মিলিত প্রচেষ্টা শুরু করতে হবে। সব স্টোকহোল্ডার এতে যুক্ত রয়েছে। এখানে ফ্যাক্টরি ক্ল্যাসিফিকেশন, ফ্যাক্টরি হেলথ অ্যান্ড সেফটি স্ট্যান্ডার্ডস, কমপ্লায়েন্স মনিটরিং রয়েছে; সঙ্গে বিজিএমইএর বড় রকমের দায়দায়িত্ব রয়েছে। সরকার বিজিএমইএকে যথেষ্ট ক্ষমতা দিয়েছে। বিজিএমইএর অনুমতি ছাড়া কেউ রফতানি করতে পারে না। সংগঠনটি ইচ্ছা করলে যেকোনো কোম্পানির রফতানি বন্ধ করে দিতে পারে। এতে আপনা আপনি বন্ধ হয়ে যাবে ওই কোম্পানি। কাজেই বিজিএমইএকে এ পোশাকশিল্পের স্বার্থেই স্ব-পর্যবেক্ষণ (self monitoring) করতে হবে নির্দলীয় এবং কঠোরভাবে।

টেকসই উপায়ে ন্যূনতম মজুরি বাড়াতে হলে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা (labor productivity) কীভাবে বাড়ানো যায়, সেটিও চিন্তা করতে হবে। শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়ানো না গেলে স্থায়ীভাবে মজুরি বাড়ানো সম্ভব হবে না। উন্নত কর্মপরিবেশের জন্য প্রয়োজন ট্রেড ইউনিয়ন। এটি মালিকপক্ষ ও শ্রমিকদের মধ্যে সেতু হিসেবে কাজ করবে। নিয়মিত দুই পক্ষ বসে, আলোচনা করে নানা সমস্যার সমাধান করবে। তবে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকেও প্রতিশ্রুতি দিতে হবে এ শিল্পের ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে যেন রাজনৈতিক কার্যক্রমে যুক্ত করা না হয়।

ওয়েলফেয়ার ফান্ড বা কল্যাণ তহবিল তৈরি করতে হবে। গার্মেন্টশিল্প শ্রম ব্যবস্থাপনার দিক থেকে খুবই অস্থির খাত। প্রতি মাসে প্রায় ১০-১২ শতাংশ শ্রমিক এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যায়। প্রতি ১০ হাজার শ্রমিকের মধ্যে প্রায় এক হাজার শ্রমিক চলে যাচ্ছে প্রতি মাসে। আবার নতুন শ্রমিক নিযুক্ত করতে হচ্ছে। এটা কেন হচ্ছে? এর পেছনে কিছু কারণ রয়েছে। এ খাত ডাইনামিক গ্রোয়িং ইন্ডাস্ট্রি। নতুন শিল্প-কারখানায় শ্রমিক দরকার হলে পুরনোটি থেকে নিয়ে যায়। এটিকে পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ কম। তবে শ্রমিকদের এমন প্রবণতা বন্ধে কিছু উপায় অবশ্য রয়েছে। শ্রমিক কল্যাণ তহবিল (যেমন— প্রভিডেন্ট ফান্ড, পেনশন ফান্ড) গঠন করা গেলে কিছুটা হলেও বাধাগ্রস্ত হবে নেতিবাচক এ প্রক্রিয়া। শ্রমিক যখন তহবিলে টাকা জমা দেবে, তখন সে হঠাৎ প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করতে পারবে না। তাকে ন্যূনতম কয়েক বছর কাজ করতেই হবে। আর পেনশন ফান্ড চালু হলে শ্রমিকের প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করার সুযোগ নিজ স্বার্থেই কমে আসবে। এতে শ্রমিকদের প্রতিষ্ঠান বদলের প্রবণতা (টার্নওভার) কমে যাবে। প্রতিষ্ঠানও উপকৃত হবে। কারণ শ্রমিক দক্ষতা বাড়বে। এতে এক প্রতিষ্ঠানে কাজ শিখে অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যাওয়ার প্রবণতা হ্রাস পাবে। সর্বোপরি এ ধরনের তহবিল গঠন করা গেলে কারখানার সঙ্গে শ্রমিকদের এক ধরনের আর্থিক স্বার্থ তৈরি হবে। তখন বিশৃঙ্খলা (যেমন— ভাঙচুর) বন্ধ হবে। এতে ফ্যাক্টরির প্রতি এক ধরনের আবেগও তৈরি হবে শ্রমিকের। কিন্তু এখন যেটা হচ্ছে, কারখানার প্রতি কোনো মায়া কাজ করে না শ্রমিকের। কারণ সে অর্থের জন্য কাজ করে। অপেক্ষাকৃত বেশি টাকা পেলে সেখানেই চলে যাবেন তিনি। ছোট কারখানা তো বটেই বড় বড় কারখানায়ও এ ধরনের উচ্চ টার্নওভার বিদ্যমান। লক্ষণীয়, কারখানা বদলের বেলায় বেশির ভাগ শ্রমিক কিন্তু এলাকার আশপাশের কারখানাগুলোকেই পছন্দ করে।

উচ্চ মূল্য (High value) আইটেমের দিকে আমাদের যেতে হবে। ভ্যালু আইটেম যদি তৈরি না করি, তাহলে উচ্চ মানের ক্রেতারা আমাদের কাছে আসবে না। এটি তৈরি করতে হলে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, শ্রমিক দক্ষতা, মধ্যপর্যায়ের ব্যবস্থাপনা (মিড-লেভেল ম্যানেজমেন্ট), ফ্যাশন ইনস্টিটিউট উন্নত করতে হবে। এ কারণে ভ্যালু চেইনকে সামনে রাখতে হবে। এ খাতকে টিকিয়ে রাখতেই সেটা করতে হবে। আমরা তো চাই, এ শিল্প আরো ৫০ বছর টিকে থাকুক।

আরেকটি বিষয়, আন্তর্জাতিক পরিসরে নিজেদের ব্র্যান্ডিং করা। এমনিতে আমরা এখন ইমেজ সংকটে ভুগছি। নানা ধরনের তদন্ত চলছে এ খাত নিয়ে। জিএসপি নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছে। এর নেতিবাচক-ইতিবাচক দিক যাই থাকুক না কেন, জনসংযোগের দিকে গুরুত্ব দিতেই হবে। মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নিতে হবে পরিকল্পনার ভিত্তিতে। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়তে না হয়, সে জন্য আগে থেকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। এ কারণে সবসময় মানসিক প্রস্তুতি রাখা ভালো। এ দৃষ্টিকোণ থেকে একটি রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে। কিছু স্টেকহোল্ডারের স্বেচ্ছাকর্মের মাধ্যমে এটা করা হয়েছে, যার বিশেষ কিছু দিক এখানে তুলে ধরা হলো—

প্রথমেই ফ্যাক্টরি ক্ল্যাসিফিকেশন করতে হবে। প্রত্যেকটি কারখানার অবকাঠামোগত দিকগুলো মূল্যায়ন করতে হবে। সরকার ও বিজিএমইএর উদ্যোগে এ নিরীক্ষা (অডিট) কার্যক্রম শুরু হয়েছে, তবে এ প্রক্রিয়া অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে করতে হবে। বিজিএমইএ, বুয়েট— সবার সমন্বয়ে গঠিত টিম বিভিন্ন কারখানা পরিদর্শন শুরু করেছে। তবে বিজিএমইএকে নিশ্চিত করতে হবে, পরিদর্শক টিমের চূড়ান্ত প্রতিবেদন যেন কেউ এড়িয়ে যেতে না পারে। সবাইকে মানতে হবে এটি এবং এ পরিদর্শন প্রক্রিয়াকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। ওই পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী চূড়ান্তভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে। এখানে নীতিনির্ধারকরা যেন পরিদর্শক বা তদন্ত দলের ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরিতে আইএলওর সঙ্গে সমন্বয় করা প্রয়োজন। তাদের ‘seal of approval’ আমাদের দরকার। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে ফ্যাক্টরি হেলথ, সেফটি অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স মনিটরিং। বিল্ডিং সেফটি স্ট্যান্ডার্ডস, ফ্যাক্টরি সেফটি, ফায়ার এক্সিট, ওয়ার্ক স্পেস, হেলথ ইস্যুজ, ভেন্টিলেশন, টয়লেট— এসব ভিত্তিতে কারখানাগুলোকে শ্রেণীকরণ— প্রথম শ্রেণী, দ্বিতীয় শ্রেণী এবং তৃতীয় শ্রেণী প্রভৃতি করতে হবে। প্রথম শ্রেণীর কারখানা হবে, যারা সবচেয়ে বেশি কমপ্লায়েন্স মেনে চলে। দ্বিতীয় শ্রেণী হচ্ছে তারা, যাদের অবকাঠামোগত দিক ঠিক আছে, তবে বেশ কিছু ঘাটতি রয়েছে। যেমন— দুটি বাথরুমের জায়গায় পাঁচটি করতে হবে। দুটি এক্সিটের জায়গায় চারটি এক্সিট সিঁড়ি নির্মাণ করতে হবে প্রভৃতি। তৃতীয় শ্রেণীর কারখানা হচ্ছে সেগুলো, যাদের প্রচুর সমস্যা রয়েছে এবং এগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। তবে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ মনে না হলে এবং অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা কিংবা অন্যান্য ঝুঁকি কমিয়ে আনতে পারলে তদারকির মাধ্যমে তাদের কারখানা চালাতে দেয়া যেতে পারে।

এখানে রয়েছে সুশাসনের ইস্যু। বিজিএমইএর এখানে বড় ভূমিকা রয়েছে। এক্ষেত্রে অবশ্য বিজেএমইএর নিজস্ব কিছু সংস্কার প্রয়োজন। সেখানে অনেক সদস্য রয়েছে কেবল ভোট দেয়ার জন্য। এর সংখ্যা পাঁচ-ছয়শর মতো বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়। বিজিএমইএর সদস্যপদ পেতে নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য রফতানির সীমা বেঁধে দিতে হবে। যেমন রফতানির পরিমাণ ৫ লাখ ডলারের কম হলে এর সদস্য হতে পারবে না। রফতানি নেই অথচ রাজনৈতিক পরিচয় ও মেম্বারদের ভোটে নির্বাহী কমিটির সদস্য হয়ে অনৈতিক প্রভাব খাটানোর প্রচেষ্টা বন্ধ করতে হবে।

তৃতীয় শ্রেণীর কারখানা অপসারণ ও নতুন পোশাকশিল্প স্থাপনের জন্য পোশাকশিল্প অর্থনৈতিক জোন গঠনের স্থান দিতে হবে। অবশ্য এটি করতে হবে সরকারকেই। প্রায় এক হাজারের বেশি তৃতীয় শ্রেণীর কারখানাকে নতুন জায়গা দিতে হবে। এ স্থানান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে খরচ হবে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। প্রশ্ন হলো, কীভাবে এ অর্থ আসবে। অর্থায়নেরও কিছু প্রস্তাব আমরা আগে আলোচনা করেছি। এক. সরকার আংশিকভাবে দিতে পারে ভূমি উন্নয়ন প্রভৃতির মাধ্যমে। দুই. ডিসকাউন্ট লোন (৮ থেকে ১০ শতাংশ সুদে) তিন. রফতানি ক্ষেত্রে এক থেকে দুই শতাংশ করারোপ (পোশাকশিল্প উন্নয়ন সারচার্জ)। এর যৌক্তিকতা রয়েছে। ‘ফেয়ার প্রাইস’ বলে বিশ্বে কিছু নেই, থাকতে পারে না। মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে এমন ধারণা অযৌক্তিকও বটে। দাম সবসময় ক্রেতা-বিক্রেতার সমঝোতা অর্থাৎ দরকষাকষির মাধ্যমেই নির্ধারিত হবে। একই পণ্যের জন্য বিভিন্ন দাম হতে পারে। এটাই বাস্তবতা। বিক্রেতারা সস্তায় কিনে নিজেদের মতো বিক্রি করবে। এ প্রেক্ষাপটে রফতানির ওপর স্বল্প হারে উন্নয়ন সারচার্জ বসিয়ে দেয়া সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত। ২ শতাংশ কর বসালে রাজস্ব আসবে বছরে ৪৫০ মিলিয়ন ডলার (আমাদের তৈরি পোশাক রফতানির পরিমাণ ২ হাজার ৫০০ কোটি ডলার)। তিন বছর এ কর বাজায় রাখলে সব তৃতীয় শ্রেণীর কারখানা স্থানান্তর হয়ে যাবে। এর মাধ্যমে পোশাকশিল্প নিজেই নিজেদের অর্থায়ন করবে। এটা কিন্তু বিরাট অঙ্কের অর্থ। এ অর্থ কেউ দেবে না স্বেচ্ছায়। এ প্রক্রিয়ায় পরোক্ষভাবে ক্রেতাদের বাধ্য করা হচ্ছে এ অর্থের সংস্থান করতে। এভাবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা থেকে গার্মেন্টশিল্পকে পুনর্বাসন করা সম্ভব। উন্নয়ন সারচার্জের মাধ্যমে সরকার ও ক্রেতা সংগঠনের পাশাপাশি দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকেও কিছু অর্থ আসতে পারে। সব মিলিয়ে এ খাতের বিপুল অর্থের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কিন্তু সম্মিলিতভাবে তা মেটানো সম্ভব।

প্রশিক্ষণ, স্থানান্তর, নিরাপত্তা— এসব উন্নত করা গেলে পাঁচ বছরের মধ্যে এ শিল্পে বড় রকমের গুণগত পরিবর্তন আনা সম্ভব। তবে তা করতে হবে দ্রুত ও স্বচ্ছতার সঙ্গে। ট্রেড ইউনিয়ন করার প্রক্রিয়া এখানে শুরু হয়েছে। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, ট্রেড ইউনিয়নগুলোয় দলীয় অপরাজনীতি যেন প্রবেশ না করে, সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। এজন্য সরকারকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সরকার এর মধ্যে রাজনীতি শুরু করলে বিরোধী দলও চলে আসবে। তখন চরম ক্ষতি হবে এ শিল্পের। এটি খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। ট্রেড ইউনিয়ন কাজ করবে কেবল বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের জন্য, রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য নয়। বিষয়টি সব রাজনৈতিক দলগুলোকে মনে রাখতে হবে। মালিক, ক্রেতাদের সমন্বয়ে শ্রমিক কল্যাণ তহবিল গঠন করা প্রয়োজন। ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে আলোচনা করে শ্রমিকদের কল্যাণেই তহবিল থেকে অর্থ ব্যয় করা যেতে পারে। এসব করলে শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়বে, কারখানা পরিবর্তনের প্রবণতা কমবে। এছাড়া ভ্যালু চেইন, ব্র্যান্ডিংয়ের ওপর নজর রাখতে হবে। ড. ইউনূসের ‘গ্লোবাল মিনিমাম ওয়েজে’র আইডিয়া ভালো, তবে বাস্তবিক অর্থে এটা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কারণ বিশ্বের সব দেশের সংসদে এটি পাস হওয়া কঠিন। ফলে আমাদের সর্বনিম্ন মজুরি নির্ণয়ের কাজ আমাদেরই করতে হবে। নিজেদেরই উদ্যোগ নিতে হবে কমপ্লায়েন্স বাস্তবায়নে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং ড. ইউনূস পোশাকশিল্পের স্বচ্ছতা বিষয়ে যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তা আমাদের শিল্পের জন্য ভালো এবং এটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হলে এসব উন্নয়ন ও সংস্কার কার্যক্রম স্বচ্ছতার সঙ্গে বাস্তবায়ন ও তদারক করা যাবে।

Dr. Ahsan H. Mansur

Dr. Ahsan H. Mansur

Dr. Mansur started his career as a Lecturer, Department of Economics, Dhaka University in 1976. He left for Canada for higher studies in economics in the same year. As a graduate student and research assistant, he was also offering regular economics courses at the undergraduate level at the University of ...

gog