বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ভালো করছে এমন দেশগুলোর দিকে তাকালে তিন
ধরনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন আমরা দেখতে পাব। এক. কিছু দেশ উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্থাৎ ৭ শতাংশ বা তার বেশি অর্জন করছে, যেমন— চীন, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া। দুই. এ শ্রেণীতে রয়েছে মধ্যম পর্যায়ের প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশ, যেমন— বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড। এরা ৫-৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। তৃতীয় পর্যায়ভুক্ত দেশগুলো অর্থনৈতিক অগ্রগতির দিক থেকে অনেক নিচে অবস্থান করছে, যাদের সামাজিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় অস্থিরতা বিদ্যমান। এসব দেশও প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে, তবে তা সাধারণত ২-৪ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এ শ্রেণীবিন্যাসে বাংলাদেশ দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত একটি দেশ, যার প্রবৃদ্ধিকে ‘উচ্চ-মধ্যম প্রবৃদ্ধির’ (medium-high growth) হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। এটা ৫-৬ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশ চেষ্টা করছে প্রথম পর্যায়ের দেশের অন্তর্ভুক্ত হতে।
এশিয়ার সবচেয়ে উন্নত দেশ জাপান। দেশটির অর্থনৈতিক অগ্রগতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, তাদের পুনর্গঠন কার্যক্রম শুরু হয়েছিল মেইজিদের (Meiji restoration) সময় থেকে। তারা লক্ষ্য নির্ধারণ করে— যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয়দের মতো হবে। তাদের প্রশ্ন ছিল, কেন জাপানিরা যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয়দের সমপর্যায়ের নয়? বিশ্লেষণে বেরিয়ে এল, শিক্ষার দিক দিয়ে তারা পিছিয়ে। সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, তারা প্রতিটি জাপানিকে শিক্ষিত করে তুলবে। আক্ষরিক অর্থে নয়, বিশ্ব পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তবতার ভিত্তিতে। নির্দিষ্ট কার্যক্রম হাতে নেয়া হলো, দ্রুত জাপানের শিক্ষিতের হার ১০০ শতাংশে পৌঁছে গেল। জাপানের সংস্কারের কেন্দ্রে ছিল শিক্ষা ও কারিগরি উন্নয়ন এবং এর মাধ্যমে প্রতিটি জনগণকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা। জাতি গঠনের এ সাফল্যের মূলে ছিল রাজনৈতিক দূরদর্শিতা।
একইভাবে দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক পরিবর্তন এসেছে। দেশটির পরিপ্রেক্ষিত ছিল ভিন্ন। কারণ, কোরিয়া তখন সামরিক শাসকের অধীনে চলছিল। বর্তমান কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের পিতা পার্ক চেং হি (Park Chung-hee) সে সময়ে ছিলেন রাষ্ট্রক্ষমতায়। সময়টা ষাট ও সত্তরের দশকের। তিনি ছিলেন ডিক্টেটর। কিন্তু তার ছিল সুদূরপ্রসারী স্বপ্ন। প্রধান লক্ষ্য ছিল— কোরিয়াকে জাপানের মতো গড়ে তোলা এবং ওই পর্যায়ে দেশকে নিয়ে যাওয়া। পার্ক চেং হির দৃষ্টি ছিল অর্থনৈতিক দক্ষতা বৃদ্ধি ও শিক্ষা বিস্তারের প্রতি। এটি কোরিয়ার অর্থনৈতিক পরিবর্তনে ও বিশ্বে দেশটিকে নতুনভাবে পরিচয় করিয়ে দিতে সহায়তা করেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার নিরাপত্তার স্বার্থে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় নজর দেন। তার হাতে বিকল্পও ছিল না। কারণ, দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য উত্তর কোরিয়ার হুমকি সবসময় ছিল। এখান থেকে মুক্ত হয়ে অর্থনৈতিক সংস্কার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের বন্ধুত্ব ছিল প্রয়োজনীয়। অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রম এখনো চলছে সেখানে এবং বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে তাল রেখে দ্রুত তা এগিয়ে নিচ্ছে সরকারগুলো। পঞ্চাশের দশকে কোরিয়া ও পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল প্রায় সমান। বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ার মাথাপিছু আয় প্রায় ৩০ হাজার ডলার। অন্যদিকে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় দেড় হাজার এবং বাংলাদেশের ১ হাজার ডলারের নিচে। ষাটের দশকের পাকিস্তানকে বলা হতো পরবর্তী কোরিয়া। কিন্তু সেটি হয়নি। কোরিয়ার সাবেক অর্থমন্ত্রী দক্ষিণ এশিয়া সফরে এসেছিলেন ১৯৯০ সালে। এটা আয়োজন করেছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এ সফরের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অর্থমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করবেন এবং কোরিয়ার উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পর্কে তাদের সম্মুখ ধারণা দেবেন তিনি। সংশ্লিষ্টদের আলোকপাত করলেন— কোরিয়ার অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রমগুলো কীভাবে গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। অর্থমন্ত্রী আমাদের বলেন, তিনি সপ্তাহে দুবার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতেন প্রাতরাশে অর্থনৈতিক নীতি ও সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে আলোচনার জন্য। কোথায় কী হচ্ছে, কী করা হলো, কেন এটা হলো, কী সংস্কার আনতে হচ্ছে, কেন করতে হচ্ছে প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনার পর সকালের নাশতা সারতেন কোরিয়ার তত্কালীন প্রেসিডেন্ট।
আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রীকে এমন মনোযোগসহকারে অর্থনীতি নিয়ে বিশেষ আলোচনা করতে দেখা যায় না। আমরা কি এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে পেরেছি যেখানে ৬ থেকে আমাদের প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ বা তার ওপরে চলে যাবে? পারিনি। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দলীয় রাজনীতি নিয়ে বেশি চিন্তিত। একদল নির্বাচনে জেতার পর পরই চিন্তা করে পরবর্তী নির্বাচনে কীভাবে জেতা যাবে। তারা অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা সংস্কার, জনগণের জীবনমান উন্নয়নের মাধ্যমে ভোটারের মন জয় করে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসার চেষ্টার চেয়ে বিরোধী দলকে দমন-নিপীড়ন-ম্যানিপুলেশনের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতায় রাখতে চায়। যেসব কার্যক্রম হাতে নেয়ার ফলে কোরিয়ার অর্থনীতিতে বড় ধরনের উল্লম্ফন ঘটেছে। তাদের কারিগরিসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আপগ্রেডেশন হয়েছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মান সামনের দিকে এগোনোর বদলে পিছিয়ে যাচ্ছে। গবেষণা ও শিক্ষা গ্রহণ-প্রদানের ক্ষেত্রে অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দিকেও দৃষ্টি দিলে অনেক বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠবে এক্ষেত্রে। ১৯৯০-৯১ সাল পর্যন্ত ভারত অন্তর্মুখী অর্থনীতির একটি দেশ ছিল। তাদের প্রবৃদ্ধি ছিল ২-৩ শতাংশের মধ্যে। উচ্চ সঞ্চয়, বড় বাজেট ঘাটতি, ক্লোজড ইকোনমি, সংস্কার নেই, জাতীয়তাবাদ ছিল ভারতের অর্থনীতির মূল বৈশিষ্ট্য। শিক্ষার্থী ও শিক্ষিত সমাজের একটি বড় অংশ বিদেশে চলে যেত। এ কারণে উন্নত দেশগুলোয় ভারতীয় প্রফেশনাল ও অধ্যাপকের সংখ্যা এত বেশি। এভাবে চলতে চলতে ভারতীয়দের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যায় একসময়ে। লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষায় সংকটে পড়ে যায় দেশটি। এমনকি তারা আমদানি বিল পরিশোধের সক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার কর্মকর্তাদের কাছ থেকে শুনেছি, ভারতের রিজার্ভ ব্যাংক থেকে স্বর্ণ ইংল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রাখার বিনিময়ে আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলো থেকে ভারত সরকারকে ঋণ নিতে হয়েছিল। তারা বাধ্য হলো আইএমএফের সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিতে। তখন ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস সমর্থিত একটি দল (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস)। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন পি ভি নরসীমা রাও। তিনি মনমোহন সিংকে আমন্ত্রণ জানান অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের। অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে ভারতের অর্থনীতিকে উন্মুক্ত করতে থাকেন। তিনি অর্থনৈতিক কার্যক্রমে সরকারের ভূমিকা কমিয়ে বেসরকারি খাতকে চাঙ্গা করেন। তার কার্যক্রম ভারতের প্রবৃদ্ধিকে ৯ শতাংশে নিয়ে যেতে সহায়তা করে। ভারতের বাজারকে বিশ্ববাজারের সঙ্গে সংযোগ সাধনে নেয়া হয়েছিল বহুবিধ উদ্যোগ। সংস্কার এমন একটি বিষয়, যার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হয়। মনমোহন সিংয়ের বর্তমান সময়ের ভারতের দিকে তাকালে কিছুটা বিপরীত চিত্র দেখতে পাব। রাজনৈতিক কারণে কংগ্রেস ও মনমোহন সিংয়ের সরকার দুর্বল হয়ে পড়ছে। এতে অর্থনীতির সংস্কার কার্যক্রম গতি হারিয়েছে। পুরনো ধ্যান-ধারণা আবারো সরকারকে প্রভাবিত করছে। এর প্রভাব পড়েছে প্রবৃদ্ধির ওপর। বর্তমানে ভারতের প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এসব উদাহরণ থেকে বোঝা যায়, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব কতটা গুরুত্বপূর্ণ। একই ব্যক্তি যাকে ভারতের অর্থনৈতিক পরিবর্তনের পিতা হিসেবে অভিহিত করা হয়, তিনিও ব্যর্থ হচ্ছেন এখন। কারণ তিনি আগের মতো সংস্কার আনতে পারছেন না। তার হাত-পা বাঁধা পড়েছে গতানুগতিক রাজনীতিতে। অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে হলে দূরদর্শী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে আর এর পেছনে অন্তর্নিহিত শক্তি হিসেবে কাজ করবে রাজনীতি।
নেতৃত্বে সংস্কার আনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার উদাহরণ রয়েছে মালয়েশিয়ার। সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহাথির মোহাম্মদ দেশটিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। আশির দশকের শুরুর দিকের কথা। আইএমএফের মিশন সদস্য হিসেবে মালয়েশিয়ায় কাজ করছি। তখন দেশটির জনগণ ও নেতাদের জিজ্ঞাসা করলে উত্তর মিলত, তাদের লক্ষ্য মালয়েশিয়াকে কোরিয়ার মতো বানানো। তারা ছিল অনেক বেশি বাস্তববাদী। তাদের ধারণা, কোরিয়া পারলে তারাও পারবে। এখনো মালয়েশিয়া কোরিয়ার পর্যায়ে পৌঁছতে পারেনি, তথাপি তারা এগিয়েছে এবং সঠিক পথেই রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রক্রিয়া বিশ্লেষণে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, আমাদেরকেও কঠিন অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। সংস্কার আনতে হবে নীতি কাঠামো ও পরিকল্পনায়। আর এজন্য প্রয়োজন সঠিক নেতৃত্ব, যেটা জাপান-কোরিয়া-ভারত ও মালয়েশিয়া পেয়েছে। সিদ্ধান্তগুলো হতে হবে বিশ্ববাজারনির্ভর। অনেক সময় আমাদের কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যা জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শুধু সিদ্ধান্ত নিলে হবে না, সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। অর্থনীতি উদারীকরণের বিষয় হতে পারে সেটি, আসতে পারে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণের প্রশ্ন। মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রশ্ন আসতে পারে এখানে। চীনের উন্নতির পেছনেও রয়েছে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অবদান। চীনের বর্তমান অর্থনীতির স্বপ্নদ্রষ্টা নেতা ছিলেন দেও শিন পেং (Deng Xiaoping)। যিনি একপর্যায়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে ছিলেন উপেক্ষিত। পরবর্তীতে তিনি শুধু রাজনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়াননি, চীনকেও ঘুরিয়ে দিয়েছেন। পঞ্চাশের দশকে চীনের দুর্ভিক্ষের কথা সবার মনে থাকার কথা। লাখ লাখ মানুষ মারা যায় এতে। সেই চীন আজ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতি তো বটেই, ব্যবসা-বাণিজ্যে বিশেষ স্থান অধিকার করে নিয়েছে দেশটি। বিপ্লবের ভূমিকা রয়েছে, তবে শুধু রাজনৈতিক বিপ্লব করে অর্থনৈতিক পরিবর্তন বা সংস্কার সম্ভব নয়। ১৯৫০-৬০ সালে চীন ভুল করেছিল সবকিছু জাতীয়করণ করে। বিপ্লবের মাধ্যম মাও সে তুং রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন। দেশের সবকিছু জাতীয়করণ করেন। কৃষিও জাতীয়করণ করা হলো। অথচ এ প্রক্রিয়া বিশ্বের কোথাও কাজ করেনি। শেষ পর্যন্ত এটি চীনেও সমস্যা সৃষ্টি করে। কৃষি উত্পাদন মারাত্মক কমে যায়। কৃষকরা উত্পাদিত পণ্যের দাম পাচ্ছিলেন না। উর্বর জমি আক্ষরিক অর্থে অনুর্বর হয়ে পড়ল। জমি পতিত পড়ে থাকল। কালেক্টিভ ফার্মিংয়ের ধারণা ব্যর্থ হলো। পরবর্তী সময়ে সাংস্কৃতিক বিপ্লব হলো চীনে। মাও সে তুংয়ের স্ত্রী এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এটাও ছিল রাজনৈতিক বিপ্লব, অর্থনৈতিক কাঠামো পরিবর্তনের চিন্তা ছিল না এতে। এ বিপ্লবও ব্যর্থ হলো। সে সময়ে দেও শিন পেং রাষ্ট্রক্ষমতায় এলেন। যিনি আগে ছিলেন জেলে। তিনি চীনের অর্থনীতিতে ব্যাপক সংস্কার আনলেন। প্রথমেই কৃষকদের জন্য জমি উন্মুক্ত করে দিলেন। অনুমতি দেয়া হলো উত্পাদিত পণ্য খোলাবাজারে বিক্রির। এটা চীনের গ্রামীণ অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছে। চীনের বর্তমান অবস্থা এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তনের পরিচালক ছিলেন দেন জেন পিং। তার দেখানো পথে চীন এগিয়ে যাচ্ছে। এর পর থেকে দেশটিকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পরবর্তী প্রতিটি শাসক ছিলেন আরো বিজ্ঞ এবং আরো বিচক্ষণ। অর্থনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রে তারা ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছেন। তারা সবসময় ২০ বছর এগিয়ে থাকে, যখন আমরা অন্ততপক্ষে ২০ বছর পিছিয়ে। এ কারণে দেশটি এত দ্রুত অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক শক্তি মানে রাজনৈতিক শক্তি, সামরিক শক্তি।
এসব বিষয় বাংলাদেশের জন্যও সমভাবে প্রযোজ্য। আমাদের জনগণ বাংলায় কথা বলে বিশ্বের কাছ থেকে সম্মান আদায় করে নিতে পারবে না। স্বাধীনতা অর্জন করেছি বলে বিশ্ব আমাদেরকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখবে না। বিশ্বে আমাদের অবস্থান আমাদেরকে অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্য আজ ভিন্ন দৃষ্টিতে বিবেচিত হচ্ছে। বাংলাদেশী ড. মুহাম্মদ ইউনূস নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, আছেন স্যার ফজলে হাসান আবেদের মতো ব্যক্তিত্ব। যারা বাংলাদেশকে বিশ্বের সামনে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করতে সমর্থ হয়েছেন। গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক বিশ্বে উন্নয়নের প্রতিষ্ঠানিক আইকন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এর ‘সিম্বলিক’ মূল্য অনেক। এদের সম্মান জানাতে হবে। আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতির অগ্রগতি ও সংস্কারের জন্যই এটি করা প্রয়োজন। তারা দেশের সম্পদ। তাদের অর্জনকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে আমরা এগিয়ে যেতে পারি। দেশে এখন প্রয়োজন নতুন ধারার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যারা দেশকে এগিয়ে নেবেন সামনে থেকে। অর্থনীতিকে নিয়ে যাবেন অন্য এক উচ্চতায়। নেতা সামনে থেকে অর্থনৈতিক সংস্কারের নেতৃত্ব দেবেন। আমাদের প্রয়োজন ব্যাপক সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সংস্কার। সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নতি করা। গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো। বিশ্বের বাজারের সঙ্গে দেশের অর্থনীতির সংযোগ আরো বাড়ানো। জলবায়ু, কৃষি, মানুষ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। অনেক চ্যালেঞ্জ সামনে রয়েছে বাংলাদেশের। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এগুলো আমলে নিচ্ছে না। বাংলাদেশের পরিবর্তনের জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব হচ্ছে মূল চাবিকাঠি। রাজনীতিবিদরাই পারেন এর অবয়ব পরিবর্তন করতে। হতাশার বিষয় হলো, তারা এগুলো নিয়ে কথা বলছেন না; এমনকি চিন্তাও করছেন না। তাদের কার্যক্রম দেখে এটিই মনে হয়। এ অবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন।