সুশাসনকে আনতে হবে প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রভাগে

বিশ্বব্যাংকের ভাষ্যমতে, পদ্মা সেতু প্রকল্প ‘পরিষ্কার ও স্বচ্ছভাবে’ সম্পন্ন হবে—

এর নিশ্চয়তা হিসেবে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ সরকার থেকে ‘পর্যাপ্ত বা ইতিবাচক সাড়া’ না পাওয়ায় সংস্থাটির সাবেক প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিকের মেয়াদ শেষের দিন ওই ঋণ চুক্তি বাতিল করেন। ২ জুলাই এডিবিও তাদের ঋণ চুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাংকের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। তবে অন্য দুই সহযোগী ঋণদাতা এ প্রকল্পে তাদের অংশগ্রহণ এখনো প্রত্যাহার করেনি। সরকার বিশ্বব্যাংকের এ সিদ্ধান্তকে অসমর্থিত বা অসম্পূর্ণ অভিযোগের ভিত্তিতে গৃহীত হিসেবে অভিহিত করে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার বিকল্প অর্থায়নের মাধ্যমে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন ব্যক্তি নানা উত্স থেকে অর্থ সংগ্রহের পরামর্শ দিচ্ছেন। মালয়েশিয়া, চীন বা দেশের অভ্যন্তরের বিভিন্ন উত্স থেকে অর্থ সংগ্রহের কথাও বলা হচ্ছে। প্রবাসী বা বিদেশীদের কাছে ‘প্রবাসী বন্ড (Sovreign) বা সার্বভৌম (Diaspora Bond) বন্ড’ বিক্রির প্রসঙ্গও এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে অর্থ প্রদানের কথাও বলা হচ্ছে। এরই মধ্যে কিছু কিছু জায়গায় বেসরকারিভাবে অর্থ সংগ্রহের কথাও শোনা যাচ্ছে। পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থ সংগ্রহের সম্ভাব্য উত্স ও তার প্রক্রিয়া নিয়েই আজকের এ নিবন্ধ।

পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে সুচিন্তিত পথে এগোতে হবে সরকারকে। বিষয়টিকে শুধু রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে চলবে না। প্রকল্পটি বড় ও ব্যয়বহুল, তাতে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের উন্নয়নে এর ভবিষ্যত্ অবদান নিয়েও প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জন্য তো বটেই, সারা দেশের জন্যও উন্নয়নসহায়ক একটি প্রকল্প। তবে এটাকে সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করতে না পারলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য তা ক্ষতিকরও হয়ে যেতে পারে। পদ্মা সেতু প্রকল্পটি রাজনৈতিক বিবেচনায় জোর করে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সামগ্রিক অর্থনীতি এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হলে লাভের চেয়ে লোকসান বেশি হতে পারে। এ প্রকল্পের অর্থায়ন করতে গিয়ে অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ঋণ সরবরাহের একটি বড় অংশ এটি নির্মাণে ব্যয় করে ফেলা যৌক্তিক হবে না। এতে ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহ সংকুচিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রয়োজন হবে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা। কারণ এ ক্ষেত্রে ব্যয়ের ৭৫ শতাংশই হবে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট আমদানি ব্যয়। সম্প্রতি রফতানি খাতের প্রবৃদ্ধি কমা ও আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়াসহ নানা কারণে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর বেশ চাপ রয়েছে। টানাপড়েনের কারণে রিজার্ভ লেভেলটা কমে আসছে। সম্প্রতি তা ১০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে, যা আমাদের তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের তুলনায়ও কম। এ অবস্থায় দুই থেকে আড়াই বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ আমদানির বোঝা আমাদের বৈদেশিক খাতের ওপর চাপিয়ে দিতে পারব কি না, সেটি এক বড় প্রশ্ন। বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য। এসব বিষয় সামাল দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা না গেলে আরও বড় ক্ষতি ডেকে আনতে পারে এটি। প্রত্যাশা ছিল, প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে অর্থনৈতিক উন্নতি হবে; এর বদলে এমন কিছু করা যৌক্তিক হবে না যাতে ক্ষতি হয় অর্থনীতির। এ জন্য সুচিন্তিতভাবে সব দিক বিবেচনা করে অর্থায়নের বিকল্প প্রস্তাব তৈরি করতে হবে। এ বিকল্প নতুন করে তৈরিতে যে সময় ও কারিগরি সহায়তা লাগবে, সেসব বিষয় বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। এ বিষয়ে কতগুলো কথা বলা প্রয়োজন:

প্রথমত. বিবেচনায় নিতে হবে প্রকল্পের ব্যয়। এটা যেহেতু আমদানিনির্ভর প্রকল্প, সেহেতু কেবল অভ্যন্তরীণ খাত থেকে সম্পদ আহরণপূর্বক এর বাস্তবায়ন করাটা সঠিক হবে না। বর্তমান রিজার্ভ লেভেলের ওপর চাপ সৃষ্টি করা এ মুহূর্তে সমীচীন হবে না। বড় বিষয় হলো, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের বিভিন্ন রকম ব্যবহার আছে। তার মধ্যে সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের দায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর পড়ে না। সড়ক বা সেতু নির্মাণ করতে হয় অন্য সম্পদ দিয়ে— সরকারি বাজেট বরাদ্দের মাধ্যমে অথবা পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (PPP) মাধ্যমে। সরাসরি সড়ক বা সেতু নির্মাণে অর্থায়ন করা কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব নয়, তাদের মূল কার্যক্রমের মধ্যে এটা পড়ে না। সুতরাং এ ধরনের কোনো দাবি তুলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অহেতুক বিব্রত করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।

দ্বিতীয় বিষয় হলো, যে পরিমাণ অর্থ অভ্যন্তরীণ খাত থেকে সংগ্রহ করতে হবে, সেটা জোগানোর সামর্থ্য আমাদের রয়েছে কি না। সরকার এরই মধ্যে বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে দেশীয় উত্স থেকে ২৩ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকঋণের প্রাক্কলন করেছে ২০১২-১৩ অর্থবছরে। এর বাইরে পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য অতিরিক্ত অর্থ আহরণ করা হলে চাপ বাড়বে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহে। আমাদের শেয়ারবাজারে তারল্যের অভাব রয়েছে। ব্যাংকিং খাতেও তারল্যের চাপ রয়েছে। বেসরকারি খাত চাহিদা অনুযায়ী ঋণ পাচ্ছে না বলে অভিযোগ করছে। মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সঙ্গত কারণেই তারল্যের ওপর কিছুটা চাপ থাকা প্রয়োজন। তবে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের মাধমে তারল্যের ওপর চাপটাকে বেশি কঠিন করে তোলা হলে আমাদের প্রবৃদ্ধির জন্য তা সহায়ক হবে না। আগেই বলছি, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন সঠিকভাবে হলে তা প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। কিন্তু এটা তৈরি করতে গিয়ে বেসরকারি খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করলে তা অর্থনীতির জন্য ঋণাত্মক হয়ে দেখা যেতে পারে। আমরা কীভাবে বহির্বিশ্ব থেকে সম্পদ আহরণ করতে পারি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য, সেটি সঠিকভাবে বিবেচনা করা কাম্য।

এখানে কিছু সমস্যা আছে। প্রকল্পটি বাণিজ্যিক কোনো প্রকল্প নয়, এটা আর্থসামাজিক প্রকল্প। আমরা কোনো শপিং প্লাজা বানাচ্ছি না। ঢাকায় নির্মিতব্য এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রজেক্টকে আমরা বলতে পারি আংশিক বাণিজ্যিকভাবে নির্মাণযোগ্য প্রকল্প। অথচ প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মিতব্য পদ্মা সেতুর মতো আর্থসামাজিক প্রকল্পে বাণিজ্যিকভাবে অর্থ তুলে অর্থায়ন করা হলে তা হবে চরম ভুল সিদ্ধান্ত। যদি মনে করি, টোল আদায় করে ২০-৩০ বছরের মধ্যে অর্থ পরিশোধ করে ফেলব বা ফেলতে পারব, তাহলে আমাদের অঙ্কের খাতায় ফেরত যেতে হবে আবার। শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশে যেটা করা সম্ভব, সেটা ৭ শতাংশ সুদে প্রায় ১০ গুণ বেশি দিয়ে অর্জন সম্ভব কি না, তা অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে। সে ক্ষেত্রে টোলের পরিমাণ কী হবে, ট্রাক ও বাসমালিকের কাছে সেটি বাণিজ্যিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে কি না, তা আমলে নিতে হবে। সেতু নির্মাণের ব্যয়, এর সুবিধার চেয়ে পারাপার ব্যয় অতিরিক্ত হয়ে গেলে এবং সেতুর ব্যবহার না বাড়লে তার মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আশা করা যায় না। উন্নয়নের যে চিন্তা নিয়ে আমরা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে চাইছি, সে উদ্দেশ্যই পূরণ হবে না তাতে। আমাদের উদ্দেশ্য হলো, যত বেশি যানবাহনকে সম্ভব এ সেতু ব্যবহারের সুযোগ দেয়া। সে জন্য সেতু ব্যবহারের খরচ যথাসম্ভব কম রাখতে হবে। এ বিষয়টি ভুলে গেলে চলবে না। আমাদের অভ্যন্তরীণ খাতে যে টানাপড়েন রয়েছে, সেটাকে না বাড়িয়ে কীভাবে সেতু নির্মাণে অর্থায়ন করতে পারি, সেটাই হওয়া উচিত এ মুহূর্তের লক্ষ্য। বর্তমান প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির নিম্নমুখী ধারাকে ব্যাহত না করে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করতে হবে। এটাই হবে আমাদের জন্য সঠিক কৌশল। প্রশ্ন হলো, এটা করতে গেলে আমাদের কী করতে হবে?

মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেছেন, ঋণ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে পুনরায় আলোচনা করা যেতে পারে। অর্থমন্ত্রীও বলেছেন বিষয়টি পুনরায় উত্থাপনের। আলোচনার পথ অবশ্যই খোলা রাখা উচিত। তা বন্ধ করে দেয়া ঠিক হবে না। তবে এরই মধ্যে অনেক বাকবিতণ্ডা হয়ে গেছে। বিশ্বব্যাংক সম্পর্কে অনেক তিক্ত কথাবার্তাও বলা হয়েছে, যা বহুলাংশে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কারণে। সে পরিপ্রেক্ষিতে সহসাই বিষয়টির সমাধান হওয়া কঠিন। আমাদের উচিত ছিল বিষয়টির এত দ্রুত রাজনৈতিকীকরণে না গিয়ে যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাদের মাধ্যমে গঠনমূলকভাবে এগিয়ে নেয়া। তবে বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনার পথ খোলা রেখেও বিকল্প অর্থায়নের বিষয়টি চিন্তা করতে হবে।

বিকল্প অর্থায়নের বিষয়টি চিন্তা করতে গেলে প্রথমেই যেটি দৃষ্টিতে আসে তা হলো— জাপানি সরকারি সাহায্য সংস্থা (জাইকা) ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) এখনো দ্বার বন্ধ করেনি। যদি ওই দ্বারগুলো আরও খুলতে পারি, সেটা আমাদের জন্য সহায়ক হবে। জাপান সরকার প্রদত্ত ঋণের সুদের হার কম। এক-দেড় শতাংশ সুদে অর্থ জোগায় তারা। অতীতে অনেক সময় সেটি মওকুফও করে দিয়েছে জাপান সরকার। আমাদের সবচেয়ে বড় দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন সহযোগীও তারা। প্রস্তাবিত পদ্মা সেতু প্রকল্পে জাপান সরকারের ঋণের পরিমাণ বেশি নয়, এটাকে বাড়ানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। জাপানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার চিন্তা করাও গুরুত্বপূর্ণ। বন্ধুপ্রতিম দেশ চীন ও ভারত আছে। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কিছু দেশকেও আমরা আমন্ত্রণ জানাতে পারি অনেকটা রাজনৈতিক কারণেও। দ্বিপক্ষীয় সরকারি সহায়তার একটা ন্যূনতম পরিমাণ জাপান ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু দেশের সমর্থন পেলে সরকার আবার এডিবির সহায়তা কামনা করতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে, বিশ্বব্যাংক বা এডিবি শুধু অর্থ জোগাতে সাহায্য করে না, তারা প্রকল্পের সুষ্ঠু বাস্তবায়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জাপান বা অন্য কোনো সরকার এডিবি বা বিশ্বব্যাংক ব্যতীত এত বড় প্রকল্পে সহায়তা প্রদানে হয়তো বিরত থাকবে। তবে এটাও ঠিক, যদি জাপান সরকার চায়, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংককে (এডিবি) এ প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।

জোরালো কূটনৈতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে এক-দেড় বিলিয়ন ডলার জোগাড় করা গেলে বিশ্বব্যাংক ঋণ চুক্তি বাতিলের ফলে যে আর্থিক লোকসান হলো, তা বহুলাংশে মেটানো যাবে। আরও ৫০০-৭০০ মিলিয়ন ডলারের মতো অর্থ, যেটা প্রধানমন্ত্রী বলেছেন সার্বভৌম বন্ড ইস্যু করে আহরণ করবেন, সেটাও সম্ভব হবে বলে ধারণা করা যায়। তবে এটা সম্ভব হবে তখনই, যখন অন্যান্য উত্স থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ আনা সম্ভব হবে। এটি আস্থা তৈরিতে সহায়তা করবে, যা গড়ে তোলা গেলে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সহায়তা পেতে কষ্ট হবে না। শুধু অভ্যন্তরীণ খাতের দিকে তাকিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পের বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। শুরু করা যেতে পারে, তবে শেষ করা যাবে বলে মনে হয় না। অভ্যন্তরীণ বা বিদেশের যেকোনো বাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করি না কেন, প্রকল্প ব্যয় বাড়বেই। এ ক্ষেত্রে তাই তুলনামূলক ব্যয়সাশ্রয়ী মাধ্যমকেই বেছে নিতে হবে আমাদের। যে ব্যবস্থা সাশ্রয়ী হবে, সেটা হলো দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে কনসেশনাল রেটে ঋণ গ্রহণ। এটা অবশ্যই সম্ভব। বাংলাদেশ অতীতে এমন অর্থ অনেক স্থান থেকেই পেয়েছে। সরকার দৃঢ়তা ও জোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলে বিষয়টি দুরূহ নয়।

আমরা যেভাবেই অর্থায়নের প্রচেষ্টা নিই না কেন, সবকিছুর আগে প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দুর্নীতির বিষয়কে সামনে রাখতে হবে। ভবিষ্যতে এ নিয়ে যেন প্রশ্ন না ওঠে, সে বিষয়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়ার মাধ্যমে জনগণ বা অন্যদের কাছে এ প্রকল্পের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে হবে সরকারকে। দাতা দেশের ক্ষেত্রে তো বটেই, আন্তর্জাতিক বাজারে গেলেও তারা প্রশ্ন করবে— বিনিয়োগকারীরা যে অর্থ বিনিয়োগ করবে, সেটা কীভাবে ব্যয় হবে। অভ্যন্তরীণ খাতের অর্থের ক্ষেত্রেও এ প্রশ্ন ওঠা যৌক্তিক। গঠনমূলকভাবে বিষয়টিকে অনুধাবন করে প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে সঠিকভাবে এগিয়ে নেয়া গেলেই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধান হবে সেটি।

আরেকটি বড় বিষয়, প্রকল্পটির বাস্তবায়নকে রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে নিতে হবে। দেড় বছরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এমন সময়ে কোনোভাবেই এ ধরনের বড় প্রকল্প পুরোপুরিভাবে রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকবে না। তা সত্ত্বেও বর্তমান সরকারকে এমনভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিতে হবে যেন পরবর্তী সরকার সেটা বাতিল করার চিন্তাও না করে। এ জন্য স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে।

বর্তমান সরকারের মেয়াদে পদ্মা সেতু প্রকল্পটি শেষ করা যাবে না, এটি নিশ্চিত। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নে রাজনৈতিক ঐকমত্য গুরুত্বপূর্ণ। যেসব কার্যক্রম বা রিফর্ম ভালো ফল দেয়, পরবর্তী সময়ে কোনো সরকারই সেটাকে সাধারণত বন্ধ করে না বা পাল্টায় না। যেসব কার্যক্রম বিতর্কিত হয়, ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে পরবর্তী সরকার সাধারণত তা বন্ধ করে দেয় এবং নতুনভাবে নিজেদের মতো করে প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টা করে, যা প্রকল্পের বিরতিহীন ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে মোটেও সহায়ক হবে না। যদি সুশাসন নিশ্চিত করে দাতাগোষ্ঠীর কাছে ভালো বার্তা পৌঁছানো যায়, তা শুধু প্রকল্পের অর্থায়নেই সহায়ক হবে না, পরবর্তী সময়ে কোনো সরকারই চাইবে না গুরুত্বপূর্ণ দাতা দেশ ও সংস্থার সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষতি করে প্রকল্পের বাস্তবায়ন রোধ করতে। আর তা করলে সহায়তার জন্য ওই সব গুরুত্বপূর্ণ দাতার কাছে হয়তো ভবিষ্যতে যেতে পারবে না সরকার।

প্রকল্পটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানসম্মতভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে বিকল্প সূত্র থেকে অর্থায়নের পরিমাণ এবং অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক অর্থের অনুপাত প্রভৃতি বিষয়ে অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশ ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ভিত্তিতে সুচিন্তিতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে এটা এখনই বলা যায় যে, বেশির ভাগ অর্থায়ন বাইরে থেকে হলেই সামগ্রিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখায় তা সহায়ক হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের এগোতে হবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক কৌশল অনুসরণের মাধ্যমে। সুশাসনকে প্রকল্প বাস্তবায়নের আগেই আনতে হবে, পরে নয়।

লেখক: অর্থনীতিবিদ ও নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)!

Dr. Ahsan H. Mansur

Dr. Ahsan H. Mansur

Dr. Mansur started his career as a Lecturer, Department of Economics, Dhaka University in 1976. He left for Canada for higher studies in economics in the same year. As a graduate student and research assistant, he was also offering regular economics courses at the undergraduate level at the University of ...

gog